অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে সম্পদ চাই

মুশফিকুর রহমান

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশে যে ব্যাপক বৈরী প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশের মানুষ সাহসিকতার সাথে সে পরিবেশে টিকে থাকা ও লড়াই করার অসংখ্য উদাহরণ তৈরি করেছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সহায়তা না পেলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশের  অভিযোজিত হবার প্রশংসনীয় অর্জন ধরে রাখা দুরূহ হবে বলে লন্ডনের ‘দি গার্ডিয়ান’ (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সম্মেলন ২০২৪ এ তাঁর বক্তৃতায় যুক্তিহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সে সম্পদ কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, এমপি অন্যান্য বিষয়ের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বাংলাদেশের মানুষের সাফল্যের কথা বলতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি গিয়েছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ ২০২৪ কেনিয়ায় জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউনেপ) সম্মেলনের ‘হাই লেভেল সেগমেন্ট’-এ মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী যোগ দিয়ে বাংলাদেশের ‘কান্ট্রি স্টেটমেন্ট’ তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘের পরিবেশ সম্মেলনে বিশ্ব সম্প্রদায় জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও জীববৈচিত্র্যের অব্যাহত বিলুপ্তি রোধ করবার পন্থাসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্কোচন অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন দেশসমূহের অন্যতম। ২০২১ সালের ‘বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি’ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ নম্বরে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ইন্ধন, আবহাওয়ামণ্ডলীতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে বাংলাদেশের দায়ভার নগণ্য।

ঢাকা ভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (আইসিসিসিএডি) তাদের গবেষণার ফলাফল উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার সঙ্গে অভিযোজিত হবার ক্ষমতার সীমানায় পৌঁছে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি, পরিবেশ দূষণ সীমিত করার নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও, আবহাওয়ামণ্ডলীতে পুঞ্জীভূত গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে বাংলাদেশের পরিবেশে উষ্ণায়ন অব্যাহত ভাবে বৃদ্ধি পাবে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলমান শতকের শেষ নাগাদ আবহাওয়ামণ্ডলীর তাপমাত্রা দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবার আশংকা রয়েছে। আইসিসিসিএডি-এর আশঙ্কা সঠিক হলে, দেশে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা বাড়বে। দেশে আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা গবেষক ও নীতি নির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলছে। পৃথক এক গবেষণায়, বাংলাদেশ ও নরওয়ে’র আবহাওয়াবিদগণ চিহ্নিত করেছেন যে, বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে; বর্ষা আসছে দেরিতে, যাচ্ছেও দেরিতে।

গরমের সময়ে তাপপ্রবাহ-দাবদাহের ঘটনা বাড়ছে। এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে সীমিত না থেকে তাপপ্রবাহের ঘটনা অক্টোবর অবধি বিস্তৃত হচ্ছে। শীতকালে ঠান্ডার তীব্রতা বাড়ছে। শৈত্য প্রবাহের সংখ্যা ও দৈর্ঘ্য বাড়ছে। দাবদাহের ঘটনা গ্রীষ্মকাল ছাড়িয়ে বর্ষা অবধি বিস্তৃত হচ্ছে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তন সমূহ বাংলাদেশের কৃষির উপর বৈরী প্রভাব অবধারিত করছে। মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কেবল বৃষ্টিপাত বা তাপমাত্রার পরিবর্তনে সীমিত থাকছে না। নদ-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, নদীর বুকে জেগে উঠছে প্রলম্বিত চর। লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধর, জিনচিরাম সহ ২৬টি নদ-নদীর প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নিয়ে রিপোর্ট বেরিয়েছে। নদীর উপর নির্ভরশীল মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। জেলে, মাঝি থেকে শুরু করে নদীকেন্দ্রিক ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। মানুষ পেশা বদল করে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে।

বাংলাদেশের অদম্য কৃষক আর সৃষ্টিশীল মানুষ পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেবার নিরন্তর চেষ্টাও করছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বন্যা, জলাবদ্ধতার মধ্যে ‘ভাসমান ক্ষেত’ তৈরি করে চাষাবাদের কৌশল কাজে লাগাচ্ছে। কৃষি গবেষণার আধুনিক কৌশল রপ্ত করে লবণ সহিষ্ণু ফসল চাষ করছে। বন্যা ও ঢলের পানিতে পাকা ধান যেন অসময়ে ডুবে না যায়, সেজন্য প্রচলিত ধান যতদিনে ঘরে তোলা যায় তার চেয়ে স্বল্প সময়ে পরিপুষ্ট হয়, এমন ধানের চাষপদ্ধতি আয়ত্ব করছে। বছরজুড়ে চাষ করছে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, প্রচলিত-অপ্রচলিত সবজি। উপকূলের ভাঙ্গন ঠেকাতে, নতুন জেগে ওঠা চরগুলোকে স্থায়ী করতে উপকূলে সবুজ বনের বেষ্টনী গড়ে তুলছে। বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা করে টিকে থাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে  বার্ষিক বাজেটের ৬-৭ শতাংশ ব্যয় করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে দ্রুত পরিবর্তিত পরিবেশ এবং মানুষের জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে সহায়তা করবার মতো পর্যাপ্ত আর্থিক সঙ্গতি সরকারের নেই।

তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ঘটনার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব স্পষ্ট করছে, বাংলাদেশের একক প্রচেষ্টায় তা মোকাবেলা দুরূহ। তাছাড়া কেবল দেশের খাদ্যনিরাপত্তার হুমকি নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের ভেতরে ও বাইরে যে বিপুল পরিমাণ ‘জলবায়ু শরনার্থী’র চাপ তৈরি হচ্ছে, জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি অবধারিত হচ্ছে তা বৈশ্বিক স্থিতি, শান্তিপূর্ণ বিকাশ ও সুস্থ জীবন-যাপনের জন্য হুমকি তৈরি করছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায় রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ ও সে সারিতে থাকা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়া দেশগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া। এ লক্ষ্যে ইতিপূর্বে সুনির্দিষ্ট সময় ও তহবিলের প্রয়োজন, পরিমাণ নিয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ঐকমত্য হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় তহবিল গঠনে অগ্রগতি কম। জলবায়ু পরিবর্তনে মানবসৃষ্ট কারণগুলোতে যাদের দায় বেশি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের অনেককে যুদ্ধ, সমরপ্রস্তুতি, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় তহবিল অপচয়ে যত উৎসাহী হতে দেখা যায়, জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলার লড়াইয়ে এগিয়ে আসতে তারা সামান্যই উৎসাহী।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 − five =