আনন্দের ফেরিওয়ালা রুমির বিদায়

মাধবী লতা

অভিনেতা অলিউল হক রুমি ছিলেন এক আনন্দের ফেরিওয়ালা। এক জীবনে মানুষের মাঝে আনন্দ বিলিয়ে গেছেন তিনি। যারা নিয়মিত নাটক দেখেন তারা এক নামেই চেনেন তাকে। এটা বললে ভুল বলা হবে না, বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাতে বেশি অভিনয় করতেন  রুমি। এতে তাকে মানাতোও বেশ। প্রচুর নাটকে এ ভাষাতেই দর্শকদের হাসিয়েছেন ও কাঁদিয়েছেন তিনি। সিরিয়াস চরিত্রে তার দেখা মিলেছে তুলনামূলক কমই। কমেডি চরিত্রের জন্যই বুঝি নিজে প্রস্তুত করেছিলেন। ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল অসংখ্য ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে চির বিদায় নিয়েছেন নন্দিত অভিনেতা অলিউল হক রুমি। রঙবেরঙ পত্রিকার পক্ষ থেকে তার প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা।

একজন রুমি

১৯৬৪ সালে বরগুনা জেলার বামনা উপজেলায় জন্ম রুমির। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক ও মা হামিদা হক। পরিবারে তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে রুমি ছিলেন মেজো। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। অভিনয় জীবনের তিন দশকেরও বেশি সময় পার করেছেন রুমি। দীর্ঘ এ পথচলায় অভিনয় করেছেন অনেক নাটক ও সিনেমায়। অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। অভিনয় দিয়েই এক জীবনে অসংখ্য মানুষের মন ভালো করে দিয়েছেন তিনি। মানুষকে হাসানোর মতো কঠিন কোনো কাজ নেই। এই কঠিন কাজটি খুব সহজভাবেই করতে পারতেন তিনি।

থিয়েটার দিয়ে পথচলা শুরু

মঞ্চ অভিনয়ের মাধ্যমেই নিজেকে তৈরি করেছিলেন অলিউল হক রুমি। তার অভিনয়জীবন শুরু হয় থিয়েটার বেইলি রোডের ‘এখনও ক্রীতদাস’ নাটক দিয়ে। সেটা ১৯৮৮ সালে। এরপর আরও বেশকিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। শুধু মঞ্চ অভিনয়েই থেমে থাকেননি এই অভিনেতা। নিজেকে মেলে ধরেছেন নানা মাধ্যমে।

ছোট পর্দায়

১৯৮৮ সালেই ‘কোন কাননের ফুল’ নাটকের মাধ্যমে ছোট পর্দায় অভিষেক হয় রুমির। এরপর থেকে অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটক হলো: সাজেশন সেলিম, বোকাসোকা তিনজন, মেকআপ ম্যান, ঢাকা টু বরিশাল, ঢাকা মেট্রো লাভ, বাপ বেটা দৌড়ের উপর, আমেরিকান সাহেব, জার্নি বাই বাস, বাকির নাম ফাঁকি, রতনে রতন চিনে, আকাশ চুরি, চৈতা পাগল, জীবনের অলিগলি, মেঘে ঢাকা শহর ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ‘জমজ’ নাটকে অভিনয় করে বেশ প্রশংসা পান।

চলচ্চিত্রে

টেলিভিশনের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন সিনেমাতেও। ২০০৯ সালে ‘দরিয়াপাড়ের দৌলতি’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। তবে নাটকের তুলনায় তার অভিনীত সিনেমার সংখ্যা কম। আসলে অভিনয়টা ছিল তার নেশা। অভিনয়ের বাইরেও অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই অভিনেতা।

সাংবাদিক

অলিউল হক রুমি যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। দেশের ঐতিহ্যবাহী জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’র সম্পাদনা সহকারী ছিলেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি দীর্ঘ সময় সাংবাদিকতা করেছেন। তবে সব ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনেকের প্রিয় অভিনেতা।

ক্যান্সার

দীর্ঘদিন ধরে কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন রুমি। ভারতের চেন্নাইয়ে চিকিৎসা নিতেও গিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে ওঠার লড়াইটা চলছিল অনেক দিন থেকেই। ভারত থেকে দেশে ফিরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এই অভিনেতা। কিন্তু আর সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা হলো না তার। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল  ৫৯ বছর।

মায়ের পাশে চিরনিদ্রায়

হাজারো ভক্ত ও স্বজনদের কাঁদিয়ে মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন অলিউল হক রুমি। বরগুনা পৌর শহরের আবুল হোসেন ঈদগাহ মাঠে তার দ্বিতীয় জানাজা শেষে পৌর গণকবরে তার মায়ের পাশে দাফন করা হয়। এ সময় অভিনেতা রাশেদ সিমান্ত, শফিক খান নীলুসহ তার সহকর্মী শিল্পীবৃন্দ, আত্মীয় স্বজনসহ স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

পরিবার

স্ত্রী ও দুই সন্তানকে রেখে গেলেন প্রিয় এই অভিনেতা। তার মেয়ে আফরা আঞ্জুমান রুজবা স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন কানাডায়। আর ছেলে ফারদিন হক রিতম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি লেখাপড়া শেষ করেছেন।

শোবিজ পাড়ায় শোক

রুমির মৃত্যুতে শোবিজ পাড়ায় শোকের ছায়া নামে। বিশেষ করে নাটক পাড়ায় তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশ ছোঁয়া। রুমির চিরপ্রস্থানের সংবাদে সবার মনে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে আনন্দ-বেদনার কথা।

মীর সাব্বির বলেন, ‘আজকের সকালটা আমার জন্য খুবই বিষাদময়। কারণ সবার প্রিয় অলিউল হক রুমি ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। গত ৩ মাস আগে ওনার কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে অনেক চেষ্টা করেও আমরা তাকে ধরে রাখতে পারলাম না। রুমি ভাইয়ের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ পথচলা, অসংখ্য নাটকে অভিনয় করা। কত মান-অভিমান! আমরা মনে রাখার মতো একজন মানুষকে হারালাম। সবাই রুমি ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন।’ চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘ভেবেছিলাম একটু সুস্থ হয়ে উঠবেন, আপনাকে দেখতে যাবো। আর দেখা হলো না। এ কেমন বিদায় রুমি ভাই! নিয়তির কাছে সকলেই হার মানে, মানতে হয়। তবে আপনি একটু তাড়াতাড়িই চলে গেলেন। অন্যলোকে শান্তিতে থাকুন রুমি ভাই।’

শাহনাজ খুশি ফেসবুকে লিখেন, ‘চলে গেলেন রুমি ভাই! মৃত্যুটা কত সহজ, জীবনটাই অনেক বেশি কঠিন। এই প্রথমবার, এমন খবর শুনে, সবাইকে জানাবার জন্য লিখতে গিয়ে, লিখলাম আর মুছলাম অসংখ্যবার! আপনার ছবির সাথে কোনোভাবেই ‘শেষ বিদায়’-এর কিছু লিখতে পারছিলাম না রুমি ভাই! সব সম্ভব মাত্র দেড়/দুই মাস, সব চেষ্টা শেষ হলো! কোনোভাবেই ঠেকানো গেল না কিছু! আপনার পরিবারকে আল্লাহ এ শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দিক, এ প্রার্থনা করি।’ ফারজানা চুমকি লিখেছেন, ‘রুমি ভাই, শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন। ভালো থাকবেন ওপারে। আমার জন্মদিনের প্রথম যে ফোনটি আসত, সেটা আপনার ফোন। সেই কলটি আর আসবে না। সাব্বিরের সাথে কত অভিমান কে করবে রুমি ভাই ক্ষমা করেন ভাই।’

রোকেয়া প্রাচী বলেন, ‘রুমি ভাই, বিদায়। আমার পরিচালনায় প্রথম ধারাবাহিক ‘সেলাই পরিবার’ নাটকের সময়টা মনে হচ্ছে খুব। আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসিব করুন।’ গোলাম ফরিদা ছন্দা তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আহা রুমি ভাই! খুব করে অপেক্ষা করছিলাম যে ভালো কোনো খবর শুনবো। মাত্র দেড়-দু’মাস! আর শোনা হলো না। সবাইকেই যেতে হবে। কিন্তু তুমি এত তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলে! অবিশ্বাস্য ঠেকছে! আমার দাদির সেই কথাটাই মনে হচ্ছে কেবল ‘কতকাল জানি বাঁচমু আর কুনসুম জানি মইরা যামু।’ জীবন এমনই। বিদায় রুমি ভাই। চির শান্তিতে থাকো ওপারে।’ রাশেদ সীমান্ত বলেন, ‘যে সবসময় আমাকে শুটিং সেটে পাহারা দিয়ে রাখত আজ আমি তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আসল ঠিকানায়। আল্লাহ আমার ভাইকে আপনি জান্নাত দান করুন। আমিন।’

এছাড়াও অভিনেত্রী তারিন জাহান, শামীমা তুষ্টি, অহনা রহমান, জ্যোতিকা জ্যোতি, কেয়া, রোজী সিদ্দিকী, মৌসুমী হামিদ, অভিনেতা অপূর্ব, সাজু খাদেম, আমিন আজাদ, জামিলসহ অনেকেই শোক প্রকাশ করেছেন।

শেষ কথা

সৃজনশীল মানুষরা কখনোই চিরকালের মতো হারিয়ে যান না। তারা বেঁচে থাকেন তাদের কাজের মাধ্যমে। তেমনি রুমি বেঁচে থাকবেন তার নাটকের মধ্যে, সিনেমায় তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ওপারে ভালো থাকুন রুমি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty − 8 =