শুটিং করছেন, লিখছেন, সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন, দেখলে বোঝার উপায় নেই ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। বলছিলাম আবুল হায়াতের কথা। তিন বছর ধরে তিনি লড়ছেন ক্যানসারের সঙ্গে। তিনি না বললে হয়তো কেউ বুঝতেই পারতেন না কতটা নীরবে, কতটা শক্ত মনোবল নিয়ে তিনি যুদ্ধটা চালিয়ে গেছেন ক্যানসারের বিরুদ্ধে। প্রথম যেদিন এই অসুখের খবর জানলেন, মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও স্ত্রী শিরিন হায়াত তাঁকে নুয়ে যেতে দেননি। যোদ্ধা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ক্যানসারের বিরুদ্ধে—নিজের আত্মজীবনী ‘রবি পথ’-এর মোড়ক উন্মোচনে সেই কথা জানালেন আবুল হায়াত।
গত শনিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয় আবুল হায়াতের আত্মজীবনী ‘রবি পথ’-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। অভিনয়শিল্পী সংঘ আয়োজিত ‘রবি পথ—কর্মময় ৮০’ অনুষ্ঠানে আবুল হায়াতের আত্মজীবনী রবি পথ থেকে নির্বাচিত অংশ বিশেষ উপস্থিত অতিথিদের সামনে পড়ে শোনান নাট্যাঙ্গনের পরিচিতমুখেরা। এ তালিকায় ছিলেন আজাদ আবুল কালাম, অপি করিম, দীপা খন্দকার, ইন্তেখাব দিনার, রওনক হাসান প্রমুখ। ফাঁকে ফাঁকে আবুল হায়াতকে নিয়ে কথা বলেন মামুনুর রশীদ, সারা যাকের, তারিক আনাম খান, নরেশ ভূঁইয়ারা।
মোড়ক উন্মোচনের শেষ দিকে কথা বলতে মঞ্চে ওঠেন আবুল হায়াত। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। প্রথমেই নিজের আত্মজীবনী লেখার কারণ শোনালেন। আবুল হায়াত বলেন, ‘অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছে, এই বইটি কেন আপনি লিখছেন? এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। হঠাৎ একদিন মনে হলো আমার জীবনেও তো অনেক ঘটনা আছে। এরপর লেখা শুরু করে দিলাম। যে ঘটনাটি আমাকে নাড়া দিত, সেটা হলো মুর্শিদাবাদ থেকে একটি পরিবার চট্টগ্রামে আসল শুধুমাত্র টেবিলে বসে একটি দাগ টানার কারণে। রেডক্লিফ সাহেব টেবিলে বসে দাগ টেনে ঠিক করে দিলেন এটা হিন্দুস্তান আর এটা পাকিস্তান। একটা হিন্দুদের আরেকটা মুসলমানদের রাষ্ট্র। যার কারণে আমার বাবা চলে এলেন। বললেন ওইটা আমাদের দেশ নয়। তাঁদের সেই কষ্টটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এরপর, আমি যে তিন বছর বয়সে এখানে এলাম, সেই সময়ে কীভাবে কাটালাম সেটা লিখলাম। এরপর মনে তাহলে বাকি জীবনটাও লিখে ফেলি।’
আবুল হায়াত আরও বলেন, ‘১০ বছর ধরে এই বইটি লিখেছি। অনেকেই মনে করতে পারেন লোকটা পাগল নাকি! অনেকবার ফেলে রেখেছি। আবার কিছু লিখি, সেটা আবার ছিঁড়ে ফেলি। বিপাশা আমাকে বলত, এটা শেষ করো। আমি তাকে বলতাম, আমার জীবনী কে পড়বে? সে আমাকে বলত, কে পড়বে সেটা বড় বিষয় নয়। কিন্তু তুমি লিখবে। তুমি তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখক। তোমার জীবনী তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ লিখতে পারবে না। তখন মনে হলো, আসলেই তো আমার জীবনী আমার চেয়ে ভালো কেউ তো লিখতে পারবে না।’
রবি পথ নিয়ে কথা বলতে বলতেই একসময় স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে ক্যানসারের যুদ্ধের গল্পটা বলতে শুরু করলেন আবুল হায়াত। তিনি বলেন, ‘তিন বছর আগে জানতে পারলাম আমি ক্যানসার রোগী। হাসপাতাল থেকে বাসা পর্যন্ত আমি আর কথা বলতে পারিনি। এই মহিলা (স্ত্রী শিরিন হায়াতকে দেখিয়ে) সারাক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আরে কী হয়েছে। আমরা আছি। ট্রিটমেন্ট করব, যেখানে যা দরকার হয় আমরা করব। তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি কিন্তু কোনো কথা বলিনি। আমার মেয়েরা খবর পেয়েছে। তারাও বিভিন্নভাবে বলেছে, আব্বু, এটা নিয়ে চিন্তা কোরো না। যা-ই হোক, আমার তো মন মানে না। রাতে খাবার খেয়েছি কি খাইনি, জানি না। বিছানায় শুয়ে পড়েছি। অন্ধকারে একা কাঁদছি। হঠাৎ টের পেলাম, সে (শিরিন হায়াত) পাশে এসে শুয়েছে। আমি তখনো নিঃশব্দে কাঁদছি। হঠাৎ তার একটা হাত আমার গায়ে এসে পড়ল। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তখন সে বলল, “আল্লাহ তাআলা এই রোগটা তোমাকে কেন দিল, আমাকে দেখতে পেল না?” বলেই হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সারাটা জীবন আমার সঙ্গে; আমার দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আনন্দ—সবকিছুতে সে। আজকে আমি এই যে তিনটা বছর ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, শুধু তাঁর কারণে। সে আমার সবচেয়ে বড় সহযোদ্ধা, আমাকে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছে, আই অ্যাম আ ফাইটার। আমি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা করতে চাই। আপনারা দোয়া করবেন। আরেকজনের কথা না বললেই নয়, চিকিৎসক অসিত কুমার সেনগুপ্ত। তিনি প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কারণে আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি।’
কথা বলতে বলতেই কাঁদলেন আবুল হায়াত, সেই সঙ্গে কাঁদলেন তাঁর স্ত্রী শিরিন হায়াত, মেয়ে বিপাশা-নাতাশাসহ উপস্থিত অনেকেই। হলজুড়ে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। অনেকেই তখন চোখের জল মুছছিলেন।
আবুল হায়াতের আত্মজীবনী রবি পথের প্রচ্ছদ এঁকেছেন তাঁর বড় মেয়ে অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত। প্রকাশ হচ্ছে সুবর্ণ প্রকাশনী থেকে, এটি আবুল হায়াতের ছোট মেয়ে নাতাশার বান্ধবীর প্রকাশনা সংস্থা।