আলাউদ্দিন আলী: বাংলা সংগীতের দাপুটে ব্যক্তিত্ব

অলকানন্দা মালা

পরিবারের সবাই কোনো না কোনোভাবে সংগীতের সাথে যুক্ত ছিলেন। বাবা এস্রাজ বাজাতেন। বোন বাজাতেন সেতার। চাচারাও ছিলেন সুরের সাধক। এমন একটি পরিবারে জন্মে ছেলেটি খেলার সংগী হিসেবে পেয়েছিলেন হারমনিয়াম তবলাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। সেসবে টুকটাক সুরও তুলতেন তিনি। কিন্তু টানত বেশি বেহালা। বেহালার চেহারা ও সুর ভীষণভাবে পেয়ে বসেছিল তাকে। এমনটা দেখে চাচা ওস্তাদ সাদেক আলী ছোট্ট একটি বেহালা কিনে দেন তাকে। মাত্র সাত বছর বয়সে চলচ্চিত্রের গানে বেহালায় সুর তুলে শুরু হয় তার পথচলা।

প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক, সুরকার ও গীতিকার আলাউদ্দিন আলী। যার নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় ওগো বাংলা মা আমার, সুখে থাক ও আমার নন্দিনী, ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়সহ অনেক কালজয়ী গান। তার সুরে তৈরি এমন গানের সাথে বাংলা ভাষাভাষীদের রয়েছে আত্মার সম্পর্ক।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

আলাউদ্দিন আলী ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ওস্তাদ জাবেদ আলী ছিলেন একজন যন্ত্রশিল্পী। আর মায়ের নাম জোহরা খাতুন। তার বেড়ে ওঠা মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে। সুরের সাথে প্রকৃতির একটি যোগসূত্র থাকে। আলাউদ্দিন আলীর ক্ষেত্রেও হয়ত এটি প্রযোজ্য। ঢাকায় বেড়ে উঠেও তিনি সান্নিধ্য পেয়েছিলেন নিখাঁদ প্রকৃতির। সেসময় মতিঝিল ছিল গ্রামীণ সবুজ আবহে ঘেরা। ছিল পুকুর, খেলার মাঠ। কমলাপুর রেলস্টেশন যেখানে সেখানে তখন ভিড়ত বড় বড় পাল তোলা নৌকা। তার ওপাশে ছিল আম বাগান ও গাছগাছালিতে ভরপুর। শৈশবে বেশ দূরন্তও ছিলেন। ছিল হেসে খেলে বেড়াবার পরিবেশ। কিন্তু খেলাধূলা করে বেড়ে ওঠার সুযোগ মেলেনি এই সংগীতজ্ঞের। অ আ শেখার বয়সেই সুরের সাধনা শুরু হয় তার। ছোটবেলায় বড় বোনের সাথে বাজাতেন তবলা। সুর তুলতেন বাবার এস্রাজে। আর চাচা বেহেলা কিনে দিলে সেটার সাথেই বাঁধেন নিজেকে।

চলচ্চিত্রে অভিষেক

আলাউদ্দিন আলী অল্প বয়সেই রেডিওতে নিয়মিত বেহালা বাজাতেন। সেসময় ‘মিশর কুমারী’ নামের এক সিনেমার সংগীত পরিচালনায় ছিলেন কিংবদন্তি সুরকার আলতাফ মাহমুদ। ছবিটির একটি গানে প্রায় ২০-২৫ জন বেহালা বাদকের প্রয়োজন বোধ করছিলেন তিনি। সেসময় আলাউদ্দিন আলী সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তবে এরইমধ্যে বেহালাবাদক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। বেতারে নিয়মিত বাজাতেন। ফলে তার ডাক পড়ে আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে। চলচ্চিত্রে বেহালা বাদক হিসেবে আলাউদ্দিন আলীর যাত্রা শুরু হয়ে। এরপর চলচ্চিত্রে বেহালা বাদক হিসেবে নিয়মিত হন। এসময় আলতাফ মাহমুদের সাথে সখ্যতা হয় আলাউদ্দিন আলীর। আলতাফ মাহমুদ প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি। তিনি আলাউদ্দিন আলীকে নিজের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন।

সুরকার হিসেবে পথচলা

আলাউদ্দিন আলীর স্বপ্ন ছিল উচ্চাঙ্গসংগীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। তবে বাস্তব কারণে সেটি আর হয়ে উঠেনি। তার বাবা-চাচা ছিলেন যন্ত্রশিল্পী। তিনি চোখের সামনেই দেখছিলেন, সংগীতাঙ্গনে যন্ত্রশিল্পীদের ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। তাই নিজের পথ পরিবর্তনের কথা ভাবছিলেন। এমন সময় একটি সুযোগ পেয়ে যান তিনি। তখন ১৯৭২ সাল। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্মৃতিতে তখনও স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষত। আবার শত্রুমুক্ত দেশের আলো-বাতাস আলিঙ্গনের পরম সুখ। এমন স্মৃতি নিয়েই আবুল ওমরাহ মো. ফখরুদ্দিন লিখেছিলেন, ‘ও আমার বাংলা মা তোর…’ শিরোনামের একটি গান। ওদিকে আলাউদ্দিন আলীর মনেও তখন একই অনুভূতি। তাই গানটি হাতে নিয়েই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। মুহূর্তেই সুর চলে আসে ভেতর থেকে। জন্ম নেয় এক কালজয়ী গান। বিটিভিতে গানটি প্রচারিত হলে সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষজন মুহূর্তেই লুফে নেয়। সুরকার হিসেবে আলাউদ্দিন আলী পরিচিতি পেয়ে যান। প্রথম গান জনপ্রিয় হওয়ায় আরও কিছু গানে সুর করেন আলাউদ্দিন আলী। সুর নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন।

সিনেমায় সংগীত পরিচালনা

এর কয়েক বছর পর চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনায় অভিষেক ঘটে তার। এটি ছিল ১৯৭৫ সালের ঘটনা। সে বছর ‘সন্ধিক্ষণ’ নামক একটি ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেন। এখানেও প্রশংসিত হন তিনি। সত্তরের দশকে তিনি সংগীত পরিচালনা করেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার। এটি তার ক্যারিয়ারের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল। এ সিনেমায় তার করা গান ভীষণভাবে টেনেছিল মানুষকে। ফলে দেশজুড়ে পেয়েছিল দারুণ জনপ্রিয়তা। পরের বছর তার ক্যারিয়ারের আরও উল্লেখযোগ্য একটি ছবি ‘সুন্দরী’ যুক্ত হয়। এ ছবিটির সংগীতও দারুণ প্রশংসিত হয়। ফলে আলাউদ্দিন আলী চলচ্চিত্রের গানে হয়ে ওঠেন এক আস্থার নাম। একের পর এক সিনেমার গানের কাজ পেতে থাকেন তিনি। বেতার, টেলিভিশনের জন্যও গান করছিলেন তিনি। এসব গানের অধিকাংশই পাচ্ছিল ভীষণ জনপ্রিয়তা।

আলাউদ্দিন আলীর জনপ্রিয় গান

আলাউদ্দিন আলীর জনপ্রিয় এবং শ্রোতাপ্রিয় অনেক গান রয়েছে। এরমধ্যে ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো’, ‘ভালোবাসা যত বড়ো জীবন তত বড় নয়’, ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’, ‘দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়’, ‘সুখে থাকো, ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ’, ‘এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে, মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে’, ‘আমায় গেঁথে দাওনা মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে’, ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো, পারি না ভুলে যেতে, স্মৃতিরা মালা গেঁথে’, উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বরেকর্ড

সংগীত পরিচালক হিসেবে শুধু দেশেই সমাদৃত হননি আলাউদ্দিন আলী। করেছেন বিশ্বরেকর্ড। একদিনে তিরিশটি গান রেকর্ড করেছিলেন তিনি। তবে এর পেছনে রয়েছে একটি টানাপোড়েনের গল্প। ঘটনাটি নব্বই দশকের। সে সময় আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন আলাউদ্দিন আলী। বিশেষ কোনো কাজে মোটা অংকের টাকা প্রয়োজন ছিল তার। ওই অর্থের জন্যই হাতে নিয়েছিলেন একগাদা কাজ। নির্দিষ্ট সময়ে ডেলিভারি দিতে গিয়ে দেখলেন, একদিনে তিরিশটি গান রেকর্ড করতে হবে তাকে। সেইসঙ্গে কাজের প্রয়োজনে থাকতে হবে মুম্বাই। সেসময় বাংলাদেশে তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন ফুয়াদ নাসের বাবু। অন্যদিকে কলকাতায়ও ছিলেন একজন। আলাউদ্দিন দুই সহকারীকে দশটি করে গান রেকর্ডের দায়িত্ব দিলেন। নিজে দশটি গান নিয়ে বসে গেলেন মুম্বাইয়ে। সেইসঙ্গে টেলিফোনে খোঁজ নিচ্ছিলেন সহকারীদের। এভাবেই একদিনে ৩০টি গান রেকর্ড করে বিশ্বে নজীর স্থাপন করেছিলেন এই সংগীতজ্ঞ।

পুরস্কার

অনেক কালজয়ী গান করেছেন আলাউদ্দিন আলী। সেসব পেয়েছে জনপ্রিয়তাও। ফলে অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। টানা আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের স্বাদ নিয়েছেন আলাউদ্দিন আলী। এখানেও করেছেন রেকর্ড। ১৯৭৯, ৮০ ও ৮১ সালে পরপর তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে করেছেন হ্যাট্রিক। তার এ রেকর্ড আজও ভাঙতে পারেননি কেউ। গীতিকারও ছিলেন আলাউদ্দিন আলী। তবে তিনি গান লিখতেন বাধ্য হয়ে। গীতিকার হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি।

আলাউদ্দিন আলী তখন কলকাতায়। পরের দিন রেকর্ডিং। কথা ছিল গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার কলকাতায় যাবেন গান লিখে দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার আর যাওয়া হয়নি। শেষে আলাউদ্দিন আলী বাধ্য হয়ে লিখে ফেলেন ‘আমার মনের ভেতর অনেক জ্বালা’ শিরোনামের একটি গান। ‘প্রেমিক’ ছবির  এই গান ১৯৮৫ সালে  সেরা গীতিকার হিসেবে তাকে এনে দেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’ গানটিও তার লেখা। ১৯৮২ সালে ‘দুই পয়সার আলতা সিনেমা’য় যুক্ত হয় গানটি। একজীবনে আলাউদ্দিন কাজ করেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য কণ্ঠশিল্পীর সাথে। অনেকেই তার হাত ধরে দেশের সংগীতাঙ্গনে হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত।

মৃত্যু

প্রখ্যাত এই সংগীতজ্ঞের শরীরে ২০১৫ সালে ক্যানসার ধরা পড়ে। ২০২০ সালের ৯ আগস্ট মরণঘাতী এই রোগের কাছে পরাস্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে সংগীতাঙ্গনের দাপুটে এক অধ্যায়ের। তবে তার সুরের দাপট ঠিকই রয়ে গেছে বাংলা সংগীতে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × five =