ইতিহাসে নাম লেখাল ‘চিতা’

সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনের রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। বিধ্বস্ত ভবনের নিচে অনেকে আটকা পড়েছেন– এমন দাবি করা হচ্ছিল। তবে ফায়ার সার্ভিস বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিখোঁজদের সন্ধান পাচ্ছিলেন না। কারও কারও সংশয় ছিল ধ্বংসস্তূপের নিচে লোকজনের চাপা পড়ে থাকা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত র‍্যাবের ডগ স্কোয়াডের একটি কুকুর সব প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে দিল। ওর নাম ‘চিতা’। পুরান ঢাকায় এ বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পর চিতার সংকেত পেয়েই প্রথমে পাওয়া যায় দু’জনের মরদেহ। পরদিন চিতার মাধ্যমে আরও একজনের লাশের খোঁজ মেলে। বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ এই কাজের পুরস্কার পেল এই কুকুর। দেশে প্রথমবারের মতো র‍্যাব ডগ স্কোয়াডের একটি কুকুর বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য র‍্যাব মহাপরিচালক পদক পেল। র‍্যাবের ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও র‍্যাব মেমোরিয়াল ডে-২০২৩ উপলক্ষে মহাপরিচালকের দরবার অনুষ্ঠানে গতকাল সোমবার মহাপরিচালক পদক দেওয়া হয়েছে চিতাকে। এর মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস গড়ল সে।

চিতার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাংলাদেশে ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এর জন্ম। সে হিসাবে ওর বয়স তিন বছর এক মাসের মতো। এটি ল্যাবরেডর প্রজাতির। ওর মা-বাবাকে ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। র‍্যাবের ৫৮ সদস্যের ডগ স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে চিতার মা-বাবাও রয়েছে। জন্মের পর কুকরটিকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। চিতা হলো উদ্ধারকারী ডগ। এ বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জনে ওকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গন্ধ শুঁকে ধ্বংসস্তূপের কোনো জায়গায় কোনো মানুষ আটকা থাকলে শনাক্ত করতে পারদর্শী সে। সুনির্দিষ্ট করে জায়গাটি শনাক্ত করার পর কুকুরটি ওই জায়গা ঘিরে এক ধরনের সংকেত দেয়। ওই সংকেত চিহ্ন বুঝে উদ্ধার অভিযান চালানো হয়।

র‍্যাবের ডগ স্কোয়াডের উপপরিচালক মেজর এমদাদুল হক সমকালকে বলেন, ‘সিদ্দিকবাজারের দুর্ঘটনাস্থলে আমরা চারটি কুকুর নিয়ে গিয়েছিলাম। তার মধ্যে দুটি ছিল উদ্ধারকারী দলের সদস্য। আর দুটি কুকুর ছিল গোলাবারুদ, বোমা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। দুর্ঘটনার পর যখন ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলো, তখন ফায়ার সার্ভিসসহ অন্য সংস্থার সদস্যদের সেখানে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে যাচ্ছিল। আরেকদিকে নিখোঁজদের স্বজনের হাহাকার। এমন বাস্তবতায় চিতাই প্রথম আমাদের ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান পেতে সহযোগিতা করল।’

মেজর এমাদুল আরও বলেন, বাংলাদেশে র‍্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীতে ডগ স্কোয়াড রয়েছে। তারাও হয়তো সাহসী কাজ করছে। তবে বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য ডগ স্কোয়াডের সদস্যকে পুরস্কৃত করার বিষয়টি র‍্যাব প্রথমে ভেবেছে। মহাপরিচালকের দেওয়া পদক তারই প্রতিফলন।

র‍্যাবের আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানালেন, ডগ স্কোয়াডের সদস্যদের প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষকরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের কোনো কর্মসূচি থাকলে সেখানে র‍্যাবের ডগ স্কোয়াডের সদস্যদের মাধ্যমে অনুষ্ঠানস্থল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। প্রায়ই অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজ ওরা করছে। মা-বাবার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রথম অভিযানে বীরত্ব দেখাল চিতা। প্রথমবার সিদ্দিকবাজারের ওই অপারেশনে অংশ নেয় কুকুরটি।

একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাধারণত ডগ স্কোয়াডের সদস্যরা অপারেশনাল কার্যক্রমে এক যুগ দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়। এরপর ধীরে ধীরে দক্ষতা কমতে থাকে। আর আট বছর পর থেকে একটু একটু করে অপারেশনাল কার্যক্রম থেকে কুকুরকে সরিয়ে নেওয়া হয়। যে কুকুর সরিয়ে নেওয়া হয়, তার স্থলে নতুন একটি আনা হয়। খাবার হিসেবে ডগ স্কোয়াডের সদস্যদের প্রতিদিন মাংস, সবজি ও ভাত দেওয়া হয়। নিয়মিত ওদের চিকিৎসা করানো হয়ে থাকে। বিদেশে ডগ স্কোয়াডের সদস্যদের ‘র‍্যাংক ব্যাজ’ দেওয়ার প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে নেই। বিদেশে কোনো কোনো কুকুরকে ‘কর্নেল’ পদ দেওয়া হয়। আবার ডগ স্কোয়াডের কোনো সদস্য মারা গেলে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। কোনো ইউনিটের সদস্যরা মারা গেলে বীরত্বপূর্ণ যে মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়, কুকুরের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় হয় না। তবে বাংলাদেশে ওই রেওয়াজ নেই।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সিদ্দিকবাজারের উদ্ধার অভিযানে সফলতার জন্য ভূয়সী প্রশংসা চিতা পেয়েছে। মহাপরিচালক পদক প্রদান করে যথাযথ সম্মান দেওয়া হলো। এটা ডগ স্কোয়াডের জন্য নতুন মাইলফলক।

জানা গেছে, গতকাল উত্তরায় র‍্যাব সদরদপ্তরে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন র‍্যাব মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল কামরুল হাসান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − two =