উন্নত দেশগুলো যুদ্ধে বিনিয়োগে আগ্রহী তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে অর্থায়নে নয়: মনজুরুল হান্নান খান

আফরোজা আখতার পারভীন 

যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য উন্নত দেশগুলো প্রতি মাসে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে আগ্রহী হলেও জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ বা ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে সাহায্য করতে তাদের মধ্যে ততটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেনকে যুদ্ধে সহায়তা করতে ইউরোপীয় দেশগুলো বিল পাস করছে। অথচ জলবায়ু তহবিলে গত তিন বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার জমা হওয়ার কথা থাকলেও জমা হয়েছে মাত্র ১১ বিলিয়ন ডলার। উন্নত দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে আন্তরিক হতে হবে। যুদ্ধের কারণেও জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বা জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিসিপিসিএল-ইপি ক্লাইমেট টস-এ অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন, ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মনজুরুল হান্নান খান।

তিনি বলেন, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় আলোচনার গতি খুবই ধীর। জলবায়ু দূষণ বা লস অ্যান্ড ড্যামেজ বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ছাড়া অন্য কেউই সামনে আনতে চায় না। কারণ এ বিষয়টি সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাবকে সামনে নিয়ে আসে। অন্যান্য বিষয়গুলো অস্বীকার করার সুযোগ থাকে। কিন্তু লস অ্যান্ড ড্যামেজের বেলাতে তা অস্বীকার করা যায় না। কারণ তা সরাসরি চোখে দেখা যায়। আমাদের মত ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর জন্য লস অ্যান্ড ড্যামেজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তিনি জানান, প্যারিস সম্মেলনের মূল আলোচনা ছিলো দূষণ কমানো। কীভাবে আপনি বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমাবেন। সে সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলো না। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে তবু কিছু টাকা আছে। কিন্তু লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলে কিছুই নেই। গত কপে এ বিষয়ে অর্থ সংস্থানের বিষয়ে কথা ছিলো। কিন্তু গত এক বছরে এ বিষয়ে আর আলোচনা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশগুলো লস অ্যান্ড ড্যানেজের বিষয়টা সামনে আনতে চায় না, কারণ এখানে সবচেয়ে বড় শর্ত হলো ক্ষতিপূরণের বিষয়টি। এখানে আইনগত ভিত্তি বা দায়বদ্ধতা আছে। এবার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে ক্ষতিপূরণ শব্দটার বেলায় বড় ছাড় দিয়ে বা আপোস করে। এবার লস এন্ড ড্যামেজ তহবিল হঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে সাপোর্ট মেকানিজমের ভিত্তিতে। সহায়তার শর্তে। ক্ষতিপূরণ নয়।

অ্যানার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিন আয়োজিত অনুষ্ঠানে ড. খান বলেন, এবার যে লস অ্যান্ড ড্যামেজ প্রস্তাব পাস হয়েছে, তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। কিন্তু এটা যেন অবশ্যই শুধু মাত্র প্যারিস চুক্তির আওতার পরিচালিত না হয়ে ওয়ারসো ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম এবং প্যারিস চুক্তির যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। না হলে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো সুফল পারে না।

তিনি আরও বলেন, কপ একটা একটা বৈশ্বিক রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্র। এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই এখানে শেষ সিদ্ধান্ত। কপে আমরা যারা আলোচনাকারী বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করি, তারা কেউ কোন দেশের জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যাই না। আমরা আইনী বা প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলি, বাস্তব চিত্র তুলে ধরি। সিদ্ধান্তগুলো কিন্তু নেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সুতরাং এখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সংশ্লিষ্টতা যত বাড়বে, সফলতার তত বাড়বে।

ড. খান আরও বলেন, এবারের কপ যে কোন সময়ের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পৃথিবী কোভিড মহামারীর বৈশ্বিক সংকট এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধাবস্থা প্রত্যক্ষ করছে। এ দুটো ঘটনা পৃথিবীর অনেক কিছুকেই বদলে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।

মনজুরুল হান্নান বলেন, লস অ্যান্ড ড্যামেজের ব্যাপারটাকে কেউ কেউ ফাঁদ বললেও, আমি বলবো, বৈশ্বিক আলোচনার সময় কখনও কখনও ফাঁদ জেনেও ফাঁদে পা দিতে হয় এবং আলোচনায় বসতে হয়। অভিযোজন প্রজেক্ট যদি পুরোপুরি বা ১০০ শতাংশ বাস্তবায়ন করা যায়, তবে তো লস অ্যান্ড ড্যামেজের খরচ খুবই কমে যাবে। যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে বাঁধ, রাস্তাঘাট তৈরি করা যায় তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমে যাবে।

ক্লাইমেট টকস-এ আলোচনায় অংশ নিয়ে হান্নান খান বলেন, উন্নত দেশগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদেরও দায় আছে, ব্যর্থতা আছে। কোন অভিযোগ উত্থাপনের সময়, ক্ষতিপূরণ দাবি করার সময় যে তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন পড়ে, তার জন্য যে পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হয়, আমাদের তা থাকে না। যথাযথ, কাগজ-পত্র ও প্রস্তুতির অভাবে প্রায়শই আমাদের ন্যায্য দাবিগুলো আমরা উত্থাপন করতে পারি না বা বিলম্বিত হয়ত। সে কারণেই তারা এটা দীর্ঘায়িত করে। কারণ তারাও এ আলোচনায় আসতে চায় না। দেখতে হবে, ২০১৩ সাল থেকে আজকে পর্যন্ত আমরা কী ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি, জাতীয় কর্মকৌশল তৈরি করেছি? আমাদের একটা দীর্ঘমেয়াদী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা দরকার এবং সে মতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, জলবায়ু দূষণ রোধে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে প্রত্যেকটি দেশের সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে । শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর দোষ চাপালে হবে না। শুধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সময় কথা বললে যা হবে না। তাদেরকে লাগাতার কাজ করতে হবে। নিজ নিজ দেশের সরকারকে তাদের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। জনমত তৈরি করে সরকারকে বাধ্য করতে পারেন তারা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen − 10 =