একই দিনে না ফেরার দেশে দুই গীতিকার

রঙ বেরঙ ডেস্ক: ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে একই দিনে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাংলাদেশের দুই স্বনামধন্য গীতিকবি বিশু শিকদার ও সৈয়দ আশেক মাহমুদ। এই গীতিকবিদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে রঙবেরঙ।

কে এই বিশু শিকদার

সৃষ্টিশীল মানুষরা বেঁচে থাকেন তাদের সৃষ্টির মাঝে। বিশু শিকদাদের নাম শুনে অপরিচিত কেউ মনে হতে পারে। কিন্তু তার লেখা গানগুলোর শিরোনাম পড়ে আপনি চমকে যাবেন। বলে উঠবেন, ‘এই গানগুলোর গীতিকার বিশু!হ্যাঁ আমাদের অনেকগুলো প্রিয় গানের গীতিকার বিশু শিকদার।

দেশের ব্যান্ড গানের সুপারস্টার জেমসের সঙ্গে ভীষণ সখ্যতা ছিল তার। বলা যায় তার লেখা অধিকাংশ গানের শিল্পী জেমস।

তারা জুটি হয়ে বেশ কয়েকটি কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন। এই তালিকায় আছে দুষ্টু ছেলের দল’, ‘বিজলী’, ‘তুফান’, ‘সেলাই দিদিমণি’, ‘যদি এই শীতে’, ‘আমি তোমাদেরই লোক’, ‘অবশেষে জেনেছিসহ আরও অনেক গান। মাঝে দীর্ঘ এক যুগ নতুন কোনো গান প্রকাশ করেননি জেমস। গত বছরের ঈদে আই লাভ ইউশিরোনামের গান প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেই বিরতি ভাঙেন তিনি। জেমসের গাওয়া এই গানও যৌথভাবে লিখেছিলেন জেমস ও বিশু শিকদার। এই গীতিকবির লেখা নতুন আরেকটি গানও আছে মুক্তির অপেক্ষায়।

হঠাৎ মৃত্যু

এসএম সেলিম শিকদার ওরফে বিশু শিকদার নামে পরিচিত এই গীতিকার। হঠাৎ মৃত্যুর খবর এলো বিশুর। ২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি বিকাল ৫টায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান এই গুণী গীতিকার। নিজের ফেসবুক আইডি থেকে গীতিকারের একটি ছবিসহ খবরটি জানান নন্দিত গায়ক জেমস। জেমস জানান, ২১ জানুয়ারি বিকাল ৫টায় নড়াইলের লোহাগড়ায় নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন বিশু শিকদার। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক কেড়ে নিয়েছে প্রিয় গীতিকারের প্রাণ।

নড়াইল ছুটে যান জেমস

বিশু শিকদারের মৃত্যুর খবর পেয়ে মুষড়ে পড়েছিলেন জেমস। ২৩ জানুয়ারি নড়াইলের লোহাগড়ার ধোপাদহ গ্রামে অকাল প্রয়াত গীতিকার বিশু শিকদারের বাড়িতে ছুটে যান তিনি। জেমস বিশু শিকদারের কবর জিয়ারত করেন।

অকাল প্রয়াত গীতিকার বিশু শিকদারের রয়েছে দুই মেয়ে সঙ্গীতা ও সুকন্যা। পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে এই দুই কন্যার সার্বিক দায়িত্ব নেন জেমস। অনেকেই স্যালুট জানিয়েছেন জেমসের দায়িত্ববোধ, দায়বদ্ধতা এবং মানবিকতাকে।

সৈয়দ আশেক মাহমুদ

বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের গীতিকবি সৈয়দ আশেক মাহমুদও না ফেরার দেশে চলে গেছেন ২৩২৩ সালের ২১ জানুয়ারি। ওই দিন ভোরে ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। একইদিনে আসরের নামাজের পর রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। সৈয়দ আশেক মাহমুদ ছিলেন গীতিকবি সংঘ বাংলাদেশের উপদেষ্টা। তার মৃত্যুতে গীতিকবি সংঘের পক্ষ থেকে শোক জানিয়েছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আসিফ ইকবাল। শিল্পী তপন চৌধুরীর গাওয়া জনপ্রিয় গান আমি সব কিছু ছাড়তে পারিসৈয়দ আশেক মাহমুদের লেখা গানের মধ্যে অন্যতম। মৃত্যুকালে আশেক মাহমুদের বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি দুই সন্তানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

আশেক মাহমুদের লেখা গান

সৈয়দ আশেক মাহমুদের লেখা প্রণব ঘোষের সুরে শিল্পী তপন চৌধুরীর গাওয়া আমি সবকিছু ছাড়তে পারি তোমাকে ছাড়তে পারব না’, রবি চৌধুরীর গাওয়া পৃথিবীকে চিনি আর তোমাকে চিনি’, শুভ্র দেবের গাওয়া ও বেহুলা বাঁচাও’, কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা দূরন্তদারুন জনপ্রিয়।

আশেক মাহমুদের পরিচয়

সৈয়দ আশেক মাহমুদ শুধু একজন গীতিকারই ছিলেন না; বহমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। ছিলেন একজন নন্দিত শিশু সাহিত্যিক। আশেক মাহমুদের জন্ম যশোর শহরে। তার পিতা সৈয়দ লাল মুহম্মদ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সহযোগী ছিলেন। সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন নবযুগ’, ‘অমৃত বাজারপত্রিকায়। সৈয়দ আশেক মাহমুদের মা সৈয়দা ফাতেমা খাতুন সওগাতবেগমপত্রিকায় নিয়মিত লেখক ছিলেন। আশেক মাহমুদের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় মাত্র নয় বছর বয়সে মাসউল আজম সম্পাদিত শতদলপত্রিকায়। প্রথম বই প্রকাশিত হয় নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে। বইটির নাম ছিল বড়দিনের উপহার। তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ১৫০-এরও বেশি। তার লেখা শিশু সাহিত্যের বইগুলোর মধ্যে আছে আমাদের গল্প’, ‘মেঘ বৃষ্টি’, ‘বাঘমামাবঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

ফাদার লুসিওর উপদেশ

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কিশোর সৈয়দ আশেক মাহমুদ যখন তথাকথিত আধুনিক সাহিত্যচর্চা গদ্য কবিতা রচনায় এক ধরনের উন্মাদনায় আক্রান্ত; তখন যশোর ক্যাথলিক মিশনের প্রধান ধর্ম যাজক ফাদার লুসিও চেচিত আশেক মাহমুদকে বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক অর্থাৎ ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জন্য জাগরণমূলক সাহিত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন। আশেক মাহমুদ তার লেখনীর ধারা পরিবর্তন করে লিখতে থাকেন। তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য লেখার অঙ্গীকার থেকে কখনো কক্ষচ্যূত হননি। তার প্রমাণ তার রচিত অসংখ্য বইপত্র এবং রেডিও টেলিভিশন অনুষ্ঠান। মানবতার জন্য, দেশের জন্য অনুষ্ঠান রচনা ও সম্প্রচারে তিনি বাংলাদেশ রেডিও টেলিভিশনে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নানা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, মাইকেল সংগীত একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, বাংলাদেশ ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সৈয়দ আশেক মাহমুদ।

মেধাবী আশেক

ব্র্যাক থেকে শুরু করে অনেক দেশি-বিদেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে তার চিন্তা-চেতনার বাস্তবায়ন হয়েছে। পক্ষান্তরে গণমাধ্যমে, বিশেষত রেডিও টেলিভিশনে একাধারে তিনি অনুষ্ঠান রচয়িতা, পরিচালক, নির্মাতা, উপস্থাপক এবং প্রযোজক হিসেবে কাজ করেও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে সৈয়দ আশেক মাহমুদ নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ইন্টিগ্রেটেড ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার গড়ে তোলেন। দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি কোনো বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া সম্পূর্ণ নিজেদের উপার্জিত অর্থে পরিচালিত।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × 5 =