একজন মাহফুজ আনাম

রফিক হাসান

সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত এবং সম্মানিত সম্পাদক সম্ভবত মাহফুজ আনাম। তিনি সম্প্রতি সফলতার সাথে সম্পাদক হিসেবে একটানা তিরিশ বছরের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন। বাংলাদেশের কোনো সম্পাদকের এমন সফল পেশাদারিত্ব সত্যিই বিরল।

নব্বইয়ের দশকের ঊষালগ্নে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পরপরই দেশের সবচেয়ে স্বাধীন পেশাদারী পত্রিকা দি ডেইলি স্টারের প্রকাশ ঘটে। প্রথমদিকে এর সম্পাদক ছিলেন স্বনামধন্য সাংবাদিক জনাব এস এম আলী। তখন মাহফুজ আনাম ছিলেন পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৯৪ সালে এস এম আলীর অকাল প্রয়াণের পর সম্পাদক হিসেবে হাল ধরেন মাহফুজ আনাম। সেই থেকে দীর্ঘ তিন দশক তিনি তার তীক্ষ¥ মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন এই ইংরেজি দৈনিকটি।

শুধু তাই নয় সাংবাদিতার ছাত্র হিসেবেও আমি বলতে পারি মানের দিক থেকে তিনি ডেইলি স্টারকে যে উচ্চতায় উন্নীত করেছেন সেটা অতিক্রম করা অদূর ভবিষ্যতে খুব একটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ সাংবাদিকতার মান দিনদিন নিম্নগামীই হতে দেখা যাচ্ছে।

কোনো দল বা গোষ্ঠীর লেজুড়বৃত্তি না করে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করে যে আমাদের মতো অনুন্নত একটি দেশে দীর্ঘদিন টিকে থাকা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দি ডেইলি স্টার ও এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম। মাহফুজ আনাম সাংবাদিকসহ বহু সাধারণ মানুষের কাছে খুবই সম্মানিত একজন ব্যক্তি। গত তিন দশকের কার্যকলাপ ও আলোচনা সমালোচনার ফলে তিনি রীতিমত এক জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন।

কিন্তু তিনি সবার কাছে প্রিয় নন। সেটা সম্ভবও না। সবার কাছে একজন মানুষ প্রিয় হতে পারে না। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা কখনই তাকে ভালো চোখে দেখেনি কারণ তিনি সরকারের সমালোচনা করেন। অনিয়ম, দুর্নীতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। সে যেইই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। আর এ জন্যই তিনি প্রায়শই ক্ষমতাসীনদের আক্রমণের শিকার হন। তিনি এমন একজন সাংবাদিক ও সম্পাদক যাকে নিয়ে দেশের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তিনিও বহুবার প্রধানমন্ত্রীর মতো ক্ষমতাসীনদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন।

গণতন্ত্র, নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার বিশেষ করে সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ সুরক্ষা ও নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি সবসময় সোচ্চার। এগুলি কি দেশের জন্য ভালো না মন্দ? এসব ব্যাপারে সচেতন না হলে কোনো দেশ বা সমাজ কি টিকতে পারে আধুনিক যুগে?

তিনি শুধু সাংবাদিকতাই নয় এদেশের আর্থসামাজিক উন্ন্য়নেরও চেষ্টা করেন আপ্রাণ। বেসরকারি সফল উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি বার্ষিক পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। যে পুরস্কারের নিরপেক্ষতা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো বিতর্কের কথা শোনা যায়নি।

মাহফুজ আনাম কেন আলোচিত ও বিতর্কিত? আমার জানামতে বাংলাদেশের আর কোনো সম্পাদক সাংবাদিকতার প্রশ্নে এতটা ঝুঁকি নেননি যেটি নিয়েছেন তিনি। কোনো সন্দেহ নেই পৃথিবীর সবদেশেই সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। ঝুঁকি নিতে না পারলে এই পেশায় সাফল্য লাভ করা যায় না। এই ক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমেদের পুত্র যে পরিমাণ ঝুঁকি মোকাবেলা করেছেন তা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বহুকাল। পারিপার্শ্বিক নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাধ্যমত তিনি সঠিক তথ্যটি পরিবেশন করার চেষ্টা করেছেন সব সময়।

মাহফুজ ভাইয়ের সম্পাদকীয় সময়ের প্রায় অর্ধেক সময় অর্থাৎ দীর্ঘ চৌদ্দ বছর তার সাথে কাজ করার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি দেখেছি কী পরিমাণ নিষ্ঠা ও সততার সাথে তিনি পেশাদারিত্ব বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এখন আমি আর ডেইলি স্টারে নেই। ডেইলি স্টার ছেড়েছি তাও প্রায় পনেরো বছর হতে চলল। ডেইলি স্টার ছাড়ার পরেও আমি মাহফুজ ভাইকে দূর থেকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। একথা আজ বলতে মোটেও দ্বিধা নেই যে দীর্ঘ তিরিশ বছরের অধিক সময় ধরে আমি যত সম্পাদকের অধীনে কাজ করেছি তার মধ্যে মাহফুজ হচ্ছেন সেরা। তিনি যেমন জ্ঞানী তেমনি গুণী। প্রচুর পড়াশোনা করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির এমন কোনো বিষয় নেই যে ব্যাপারে তিনি কথা বলতে বা লিখতে পারেন না। অনেকের ধারনা ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি বোধহয় বাংলা জানেন না। এ বিষয়টাও ভুল। তিনি খুবই ভালো বাংলা বলেন এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণে।

বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক ধারা অর্থাৎ ডানপন্থী ও বামপন্থী উভয় দলই ডেইলি স্টার ও তার সম্পাদক মাহফুজ আনামকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে থাকে। ডানপন্থীদের কাছে তিনি ইসলামবিরোধী ভারতের দালাল। আবার বামপন্থীদের কাছে তিনি সমাজতন্ত্রবিরোধী পেটি বুর্জোয়াদের পৃষ্ঠপোষক। দুই ধারার প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র তিনি চক্ষুশূল। আমি মনে করি এর মাধ্যমেও বোঝা যায় তিনি কতটা নিরপেক্ষ ও সফল সাংবাদিক। এটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সেটা মনে রাখেন না।

তার বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনে ভূমিকা রাখার জন্য। সে সময় শুধু তিনি নন দেশের বহু সুশীল, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি দলীয় সরকারগুলোর দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় বিরক্ত ছিলেন। তারা এর থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেটা সফল হয়নি। দলীয়করণ ও দুর্নীতি লুটপাট বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার জন্য কি মাহফুজ আনাম একা দায়ী? সেই সরকারের তিনি কেনো উচ্চপদেও আসীন হননি। ব্যর্থতা বুঝতে পেরে তিনি নিরবে সরে আসেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল এখনও তার বিরুদ্ধে খাপপা হয়ে আছে। তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করে হেনস্থা ও নাস্তানাবুদ করছে। এমন একজন সম্মানিত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের আচরণ সাধারণ জনগণ ভালো চোখে দেখছে না। কিন্তু মনে মনে কষ্ট পাওয়া ছাড়া তাদের তো কিছু করারও নেই।

অনেক সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিককে দেখেছি তার সমালোচনা করতে। আমি তাদের সাথে আলাপ করে যেটা বুঝেছি সেটা হল স্রেফ ঈর্ষাবশত। বিষয়টি হলো তারা যেটা করতে পারেননি মাহফুজ আনাম সেটা পারলেন কীভাবে? কাজেই তারা নানা সমালোচনা করে মনের ঝাল মেটান।

সমাজতন্ত্রীদের ক্ষোভের কারণ ডেইলি স্টার সবসময় দেশের ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষ করে বেসরকারিখাত বিকাশের পক্ষপাতি। কিন্তু অর্থ পাচার ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে লিখতে তার একটুও হাত কাঁপেনি। ডেইলি স্টারের সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে এর অনন্য পরিচালনা পরিষদ। একদল ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে গঠিত এই পরিষদ প্রকাশিত প্রতিবেদন কিংবা মতামতের ব্যাপারে কোনদিনই সামান্যতম নাক গলায়নি। তারা সব সময় মাহফুজ আনামের উপর গভীর আস্থা ও ভরসা করে আসছে। এমন একটি পরিচালনা পরিষদ পাওয়া যে কোনো পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।

আমি অনেক ইসলামপন্থী লোকদের মুখে ডেইলি স্টার ও মাহফুজ আনামকে নাস্তিক ও ভারতের দালাল বলে কঠোর সমালোচনা করতে শুনেছি। আসলে কি তাই? হ্যাঁ এটা ঠিক তিনি ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও জঙ্গীবাদের কঠোর সমালোচক। তিনি বহুবার দেশে জঙ্গীবাদের উত্থানের ব্যাপারে তার লেখনির মাধ্যমে জাতিকে সতর্ক ও সাবধান করেছেন। তবে আমি যতটুকু দেখেছি তিনি মোটেই ইসলামবিরোধী কিংবা নাস্তিক নন। রোজার মাসে দেখেছি নিয়মিত রোজা রাখতে। তার মুখে কোনদিন ইসলামবিরোধী কথা শোনা যায়নি। ডেইলি স্টারেও ইসলামের মৌলিক আক্বিদা বিশ্বাসকে কটাক্ষ করে কোনো লেখা প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। হ্যাঁ এটা ঠিক অধিকাংশ দৈনিকের মতো সেখানে ইসলামের বা ধর্মের উপর বিশেষ কোনো ফিচার পাতা প্রকাশিত হয় না।

মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে এই প্রচারণার মূল কারণ সম্ভবত তার ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে ভারতের দালাল হিসেবে তার বিরুদ্ধে যে তকমা রয়েছে তার প্রধান কারণ সম্ভবত তিনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পক্ষপাতি। তিনি মনে করেন প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে অবকাঠামোগত সম্পর্ক উন্ন্য়ন ব্যতিত দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে। এই বিষয়টিও তিনি বহুবার তার লেখা ও কথাবার্তায় পরিষ্কার করে বলেছেন।

বিরোধী দলের উপর নিপীড়ন ও ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় লাঠিয়ালদের অত্যাচার ও মারধরের সমালোচনা করে তিনি বহুবার কলম ধরেছেন। এ দেশের নদীনালা-খালবিল দখল আর পরিবেশ বিনষ্টের বিরুদ্ধে তিনি যতটা সোচ্চার আর কাউকে তো তেমন দেখা যায় না। এ সব তিনি অর্থবান কোনো গ্রুপের পক্ষ হয়ে করছেন তা মোটেই নয়। করছেন তার বিবেকের দংশন থেকে। দেশের ভালোর জন্য। আমি মনে করি দি ডেইলি স্টার ও এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম আমাদের দেশের জন্য একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান ও অমূল্য সম্পদ। এর লালন পালন ও সমৃদ্ধি অতীতে যেমন হয়েছে ভবিষ্যতেও দেশ ও জাতির জন্য কল্যান বয়ে আনবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − fourteen =