একজন শ্রীলেখা মিত্র

মাসুম আওয়াল: ভারতীয় বাংলা সিনেমার যে কয়জন আলোচিত সাহসী অভিনেত্রী আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রীলেখা মিত্র। ভিন্নমাত্রার সব চরিত্রে অভিনয় করে তিনি যেমন আলোচিত হন, তেমনি নিজের ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্যও নানা সময়ই টক অব দ্য টাউন হন। কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে সগৌরবে এখনো টিকে আছেন তিনি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আরও অনেক কিছুই করতে পারতেন হয়তো শ্রীলেখা। কিন্তু নানা বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে তাকে। হয়তো তুলনামূলক ভাবে কাজের সংখ্যা কম তবে ঝরে পড়েননি অনেকের মতো। তার দিকে তাকিয়ে অনেক নতুন নায়িকারাও পথ খুঁজে পান। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কিভাবে টিকে থাকতে হয় তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ শ্রীলেখা। মাস খানেক আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন নিজের নির্মিত সিনেমা নিয়ে। প্রতিটি মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে লুকিয়ে থাকে স্ট্রাগলের গল্প। তার ব্যতিক্রম নন এই নায়িকাও। চলার পথে শুধু প্রশংসা নয় অনেক সময় হতে হয় বিতর্কিত। শ্রীলেখার জীবনের গল্পটি হয়তো আপনাকে কিছুটা হলেও সাহসী করে তুলবে।

বালিকার প্রেম দিয়ে শুরু, অতঃপর
শ্রীলেখা মিত্রের জন্ম ৩০ আগস্ট ১৯৭২। টলিউডের জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবেই সবাই চেনেন শ্রীলেখা মিত্রকে। না, দুম করে ইন্ড্রাস্ট্রিতে পা রেখেই নায়িকা হয়ে যাননি শ্রীলেখা মিত্র। তার শুরুটা হয়েছিল একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে সফলতার চূড়ায় উঠেছেন তিনি। তাজ হোটেলে তিনি তখন কর্মরত। পরিচালক দুলাল লাহিড়ী বাংলা ধারাবাহিক ‘বালিকার প্রেম’ এ একটি চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন শ্রীলেখা মিত্রকে। এই ধারাবাহিকে অভিনয়ের সুবাদে আরও কয়েকটি ধারাবাহিকে তার ডাক পড়ে। একটু একটু করে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন এই অভিনেত্রী। ১৯৯৬ সালে ‘তৃষ্ণা’ নামে একটি ধারাবাহিকে মানসী চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান। এই ধারাবাহিকে অভিনয় করে জনপ্রিয় হতে শুরু করেন তিনি। আর এর পরপরই তার কাজের পরিসরও বাড়তে শুরু করে।

ডাক পড়ে সিনেমায়
ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে পরিচালক-প্রযোজকের নজরে চলে আসেন শ্রীলেখা। একই সঙ্গে বাংলা ও ওড়িয়া চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ আসতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালে বাসু চ্যাটার্জীর ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান। প্রধান চরিত্র না হলেও তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। এই সিনেমাটি দারুণ সাফল্য পায়। শ্রীলেখা মিত্রেরও বাংলা সিনেমার দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। এরপর একের পর এক সিনেমার নায়িকা হওয়ার কথা তার। কিন্তু সেটা হয়নি। শ্রীলেখার দাবি, ফিল্ম পলিটিক্সের শিকার হয়েছিলেন তিনি।

শ্রীলেখার শত্রু প্রসেনজিৎ
শোনা যায়, নায়িকা শ্রীলেখার পথের কাঁটা হয়েছিলেন নাকি টালিউড সুপারস্টার বুম্বাদা। এই অভিনেত্রীর দাবি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমার সাফল্যের পরেও বড় পর্দায় কোনো উল্লেখযোগ্য কাজের প্রস্তাব তার কাছে আসেনি। তার কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। তার দাবি প্রসেনজিৎ এর প্রেমপ্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ার অনেক বাংলা সিনেমার নায়িকা হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। তবে বড় পর্দায় তেমন কাজ না জুটলেও হতাশ হয়ে অভিনয় ছেড়ে যাননি তিনি। সমান তালে ছোটপর্দায় অভিনয় চালিয়ে গেছেন। তার সৌন্দর্য ও অভিনয় প্রতিভা তাকে ঠিকই এগিয়ে নিয়েছে।

আমির খানের বিপরীতে শ্রীলেখা
ছোট পর্দায় অভিনয় করতে করতেই বড় একটি কাজের ডাক পান শ্রীলেখা মিত্র। তবে সেটা সিনেমা নয় বিজ্ঞাপন। তাতে কী! এই বিজ্ঞাপনে তার বিপরীতে থাকবেন বলিউড সুপারস্টার আমির খান। তখন ২০০৪ সাল। প্রদীপ সরকারের পরিচালনায় আমির খানের বিপরীতে কোকা-কোলার বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেন শ্রীলেখা মিত্র। এরপর এই অভিনেত্রীর সামনে চলার পথ খুলে যেতে শুরু করে। প্রদীপ সরকার শ্রীলেখাকে তার পরিণীতা (২০০৫) সিনেমায় একটি চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। যদিও এই সিনেমায় তার অভিনয় করা হয়নি। সেই সময় অন্তস্বত্ত্বা হওয়ার কারণে এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি।

সাফল্য ধরা দেয় শ্রীলেখার হাতে
শ্রীলেখা মিত্র সিনেমায় সফল হতে শুরু করেন ২০০৬ সালের পর থেকে। অভিনয় জীবনের টার্নিং পয়েন্ট এসে হাজির হয় তার জীবনে। বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাঁটাতার’ (২০০৬) সিনেমায় অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর বিএফজেএ ও আনন্দলোক পুরস্কার অর্জন করেন শ্রীলেখা মিত্র। একই বছরে রীমা মুখোপাধ্যায়ের ‘অর্ধাঙ্গিনী এক অর্ধসত্য’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন তিনি। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকানো নয়। একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করতে থাকেন। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘উড়ো চিঠি’ (২০১১) সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ সহঅভিনেত্রী বিভাগে পান জি বাংলা গৌরব সম্মান। অনীক দত্ত পরিচালিত ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ (২০১৩) সিনেমার জন্য পান ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ও জি বাংলা গৌরব সম্মানের মনোনয়ন। সৌকর্য ঘোষালের ‘রেনবো জেলি’ (২০১৮) সিনেমায় পরী পিসির চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এই সিনেমাতে অভিনয় করেও দারুণ প্রশংসিত হন। এছাড়া তার আলোচিত সিনেমাগুলোর মধ্যে আছে ‘দেবদূত’, ‘তিন একে তিন’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘অন্নদাতা’, ‘টক মিষ্টি জীবন’, ‘জবাব চাই’, ‘আমাদের সংসার’, ‘আপন হল পর’, ‘গরীবের সংসার’ ‘সাত ভাই’, ‘খেলাঘর’, ‘কৃষ্ণ কাবেরি’, ‘মধু মালতী’, ‘শাঁখা সিঁদুরের দিব্যি’ ও ‘বাবা কেন চাকর’।

শ্রীলেখার স্ট্রাগল, বর্তমান ও উপদেশ
শ্রীলেখার জীবনে স্ট্রাগল অনেক। স্পষ্ট কথা বলেন তিনি। বহুবার ট্রোল সামলাতে হয়েছে। কিন্তু কোনও কিছুতেই ভেঙে পড়া তার স্বভাব নয়। নিজের অভিজ্ঞতা নানা সময় ভিডিও বার্তায় শেয়ার করেন তিনি। সম্প্রতি শ্রীলেখার কাছে তার এক ভক্ত জানতে চান, জীবনে স্ট্রাগল কিভাবে সামাল দেওয়া যায়? প্রশ্নের উত্তরে শ্রীলেখা বলেন, ‘আমি তো মোটিভেশনাল স্পিকার নই। কিন্তু একটা জিনিস বলতে পারি, জীবনে তোমাকে নামানোর চেষ্টা করবে লোকে। তাদের ছোট না করে তুমি বড় হও, তারা আপনা থেকেই ছোট হবে। মেডিটেশন ট্রাই করতে পারো। সেটা সাহায্য করে।’ এদিকে শ্রীলেখা অভিনীত ‘ওয়ানস আপন এ টাইম ইন কলকাতা’ ৭৮তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্থান করে নিয়েছে। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন আদিত্য বিক্রম। আর এরই মধ্যে পরবর্তী সিনেমা পরিচালনার জন্যও নাকি তৈরি হচ্ছেন শ্রীলেখা মিত্র।

শ্রীলেখাকে ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্ক
সম্প্রতি শ্রীলেখা ‘বিনোদিনী’ সিনেমা নিয়ে একটি মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দেন। নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রীলেখা লেখেন, ‘রোগা ছিলেন কি বিনোদিনী? ক্যাজুয়াল প্রশ্ন, এমনিতেই শত্রুর অভাব নেই, পার্সোনালি নেবেন না, প্লিজ।’ শ্রীলেখা মিত্রের এ পোস্ট নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। কেউ তাকে সমর্থন করেন আবার অনেকেই করেননি। ‘বিনোদিনী’ এক নটীর উপাখ্যান। সিনেমার পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায়। এতে বিনোদিনী চরিত্রে দেখা যাবে অভিনেত্রী রুক্সিনী মৈত্রকে। দীর্ঘদিন ধরে বিনোদিনী হয়ে ওঠার ওয়ার্কশপ শুরু করেছেন অভিনেত্রী। নিচ্ছেন নাচের তালিম। অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কাছে শিখছেন অভিনয়। তাকে খোঁচা নিয়ে পোস্ট করেছেন বলে সমালোচনার ঝড় ওঠে শ্রীলেখার পোস্টকে ঘিরে। আর এর জেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়তে চেয়েছেন শ্রীরেখা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শ্রীলেখা নিজের ফেসবুকে বিষয়টি জানিয়েছেন। পোস্ট করে শ্রীলেখা লেখেন, ‘ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সাময়িক বিরতি নিলাম, পেজ অ্যাকটিভ থাকবে। নিজেকে এবং নিজের ফ্রেন্ডলিস্টকে পরিশুদ্ধ করার পর আশা করি ফিরে আসব। বিষাক্তকে বিদায়।’

ঢাকায় শ্রীলেখা
ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ২১তম আসরে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন টালিগঞ্জের অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র। তার পরিচালনায় নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘এবং ছাদ’-এর প্রদর্শনী হয়েছে সেখানে। এতে মধ্যবয়সী এক গৃহবধূর চরিত্রে অভিনয় করেছেন শ্রীলেখা। পরিচালনার পাশাপাশি ছবিটি প্রযোজনাও করেছেন শ্রীলেখা। সম্প্রতি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শ্রীলেখা বলেছেন, অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখি ও নির্মাণে মনোযোগী হবেন তিনি। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রীলেখার সিনেমাটি নির্বাচিত হয়েছিল নারী নির্মাতা বিভাগে। ‘এবং ছাদ’ শ্রীলেখার দ্বিতীয় নির্মাণ। এর আগে ‘বেটার হাফ’ নামের আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি।

শেষ কথা
শ্রীলেখা মিত্রের পূর্বপুরুষের বসত ছিল মাদারীপুরের ঘটমাঝি গ্রামে। দেশভাগের সময় ভারতে পাড়ি দিয়েছেন তারা। শ্রীলেখার জন্ম ভারতে হলেও বাবার মুখে ঘটমাঝি গ্রামের গল্প শুনে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ২০১৭ সালের আগে বাবা সন্তোষ মিত্রকে নিয়ে পূর্বপুরুষের ভিটার খোঁজে বাংলাদেশে এসেছিলেন শ্রীলেখা। এর কয়েক বছর পর তার বাবার মৃত্যু হয়। এক সাক্ষাৎকারে শ্রীলেখা বলেন, ‘বাংলাদেশ আমার বাবার দেশ।’

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি ২

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − six =