একটি দালানে শহরের বেশির ভাগ মানুষ!

রঙবেরঙ ডেস্ক

একবার ভাবুন তো, আপনার বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে শহরের পরিচিত প্রায় সবাইকে এক ছাদের নিচে পেয়ে গেলে কেমন হবে? এমনকি ডাকঘর, মুদি দোকান আর পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে যেতে পারবেন লিফটে চড়লেই। অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনাটি সত্যি যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার হুইটারের বেলায়। শহরের প্রায় ৩০০ বাসিন্দার শতকরা ৮৫ শতাংশের বাস ১৪তলা একটি দালানে।

আলাস্কার শীতল ওই শহর হুইটারের বিখ্যাত ওই দালানের নাম বেগিচ টাওয়ার। ১৯৫০-এর দশকে এটি ছিল একটি সেনা ব্যারাক। চৌদ্দতলা দালানটিতে ১৫০টি দুই ও তিন কামরার অ্যাপার্টমেন্ট আছে। এ ছাড়া আছে ডরমিটরি। বেগিচ টাওয়ার ছাড়াও অবশ্য শহরে অল্প কয়েকটা দালান আছে। সেখানে কিছু মানুষও বাস করে। তবে সংখ্যাটা একেবারেই কম।

পাহাড়মাঝের শহর হুইটারে স্থলপথে পৌঁছাতে পারবেন কেবল চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে। সেটির দুয়ার আবার বন্ধ হয়ে যায় রাত ১০টার দিকে। অর্থাৎ সকাল হওয়ার আগ পর্যন্ত শহরে প্রবেশ বা শহর থেকে বের হতে পারবেন না বড় কোনো বিপদ ছাড়া। ট্রেন কিংবা গাড়িতে যেভাবেই আসতে চান না কেন, শহরে প্রবেশ করতে হবে ওই সুড়ঙ্গ দিয়েই। অবশ্য আশপাশের বসতিগুলো থেকে ইঞ্জিনের নৌকা বা ট্রলারে চেপেও পৌঁছা যায় শহরটিতে।

প্রিন্স উইলিয়াম প্রণালির ‘প্যাসেজ ক্যানেলে’র তীরে অবস্থিত শহরটি। প্রমোদতরী ও বড় জাহাজগুলো ভেড়ার জন্য এখানে একটি পোতাশ্রয় আছে। হুইটার থেকে প্রমোদতরীতে চেপে পর্যটকেরা ঘুরতে পারেন আশপাশের এলাকায়।

শহরের পুলিশ স্টেশনটি ওই দালানেই; এটি তো আগেই জেনেছেন, এখন জানবেন বেগিচ টাওয়ারেই পাবেন একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লন্ড্রিও। বেগিচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল সামরিক ঘাঁটি হিসেবেই। তখন এর বন্দরটি ব্যবহার করা হতো আলাস্কা রাজ্যের নানা জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করতে।

গরমের দিনে জায়গাটিতে অনেক পর্যটকই আসেন। তবে শীতের সময় বরফে ছেয়ে যায় গোটা শহর। সেই সঙ্গে থাকে ঝোড়ো, শীতল হাওয়া। কাজেই বাইরে থেকে লোকজন আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শহরের বাসিন্দারাও বের হতে পারেন কম। বছরের মোটামুটি ছয় মাসই বরফ পড়ে এই শহরে। বাকি ছয় মাস আবার নিয়মিত পাবেন বৃষ্টির দেখা।

খুব বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করলে হুইটারের বাসিন্দারা মেইনার্ড পর্বতের সুড়ঙ্গ ধরে যেতে পারেন সবচেয়ে কাছের শহর অঙ্কোরেজে। শহরটি থেকে হুইটারের দূরত্ব প্রায় ৬০ মাইল। তবে ছুটির দিন ছাড়া সাধারণত হুইটারের বাসিন্দারা সেখানে যাওয়ার সুযোগ পান কমই।

শহরের বাসিন্দাদের বড় একটি অংশের কাজ বরফ পরিষ্কার, দালানটির দেখভাল করা কিংবা শহরের প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন। তবে বাণিজ্যিকভাবে মাছ আহরণ করা হয় এই এলাকা থেকে। তাই কিছু মৎস্যজীবীরও দেখা পাবেন এখানে। তেমনি গরমের মৌসুমে আসেন শৌখিন মৎস্য শিকারিরা।

‘লোকজন শহরটাকে অদ্ভুত ভাবেন।’ বলেন এর বাসিন্দা অ্যান। ‘ঠিক, আলাস্কার সবচেয়ে অদ্ভুত শহর হিসেবেই এটি পরিচিত।’ একমত তার স্বামী ও হুইটারের মেয়র ডেভ ডেকেসন।

ডেভ, অ্যানা ও তাদের ১৮ বছরের মেয়ে জেনেসা বলেন, বেশির ভাগ প্রয়োজনীয় জিনিস তাদের বাসস্থান মানে বেগিচ টাওয়ারেই পেয়ে যান তারা। তাই এখান থেকে বাইরে কোথাও যাওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন নেই তাদের।

২০২১ সালে জেনেসা আলাস্কার হুইটারে এক দালানের নিচে তাদের জীবনের নানা বিষয় নিয়ে পোস্ট করা শুরু করেন টুইটারে। দ্রুতই তার ভিডিওগুলোর ভিউ বাড়তে থাকে। ব্যাস, এর মাধ্যমেই হঠাৎ পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়ে যায় এক দালানের ছোট্ট শহরটি।

শহরটিতে একটি বিদ্যালয়ও আছে। এটি বেগিচ টাওয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত একটি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে। সেখানে মোটামুটি ৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী জনা পঞ্চাশেক ছাত্র-ছাত্রী আছে। লিন্ডসের এর্ক নামের এক নারী দক্ষিণ ডাকোটা থেকে এখানে এসেছেন ছোট্ট শহরের একমাত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করাতে। তাকে সাহায্য করেন ভিক্টর শেন। স্নাতক করা ভিক্টরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা হুইটারে। ফিরে এসেছেন, কারণ এটাই তার বাড়ি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি ব্যুরোর দেওয়া তথ্যে শহরটির আয়তন ১৯.৭ বর্গমাইল বা ৫১ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৩২ বর্গকিলোমিটার ডাঙ্গা আর ১৯ বর্গকিলোমিটার জলভাগ।

হুইটার পরিচালনায় মেয়রকে সহায়তা করেন ছয়জন কাউন্সিল সদস্য। এই সদস্যরাই ফি বছর মেয়র নির্বাচিত করেন। ১৯৭৪ সালে হুইটার পুলিশ বিভাগ গঠিত হয়। তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। তবে গরমের মৌসুমে যখন শহরে পর্যটকের আগমন ঘটে, তখন অস্থায়ীভাবে কিছু স্থানীয় অধিবাসীকে নিয়োগ দেওয়া হয় ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাহায্য করতে। বেগিচ টাওয়ারের দোতলায় অবস্থিত পুলিশ স্টেশনটিতে কাউকে আটকে রাখা বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোনো কামরা নেই। অবশ্য এখানে সেরকম কোনো বড় ঝামেলা সাধারণত পাকায়ও না।

কানাডার আশ্চর্য এই শহরের গল্প শুনে সেখানে যেতে ইচ্ছা করছে? কোনো সমস্যা নেই। বেগিচ টাওয়ারে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। মুফতে পর্যটকেরা কাছের চুগাচ জাতীয় উদ্যান ও হিমবাহের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগও পেয়ে যান।

যে শহরের মানুষ এখনো গুহাবাসী

দক্ষিণ তিউনিসিয়ার মাতমাতা শহরে গেলে অবাক হবেন। কারণ সেখানকার মানুষেরা এখনো বাস করে গুহায়। মূলত আরব আঞ্চলের গরম আবহাওয়ায় একটু আরাম পেতেই বহু বছর ধরে এভাবে গুহা বানিয়ে বাস করে আসছেন তারা।

দজেবাল দাহার অঞ্চলের উষর মালভূমি এলাকায় মাতমাতার অবস্থান। এখানকার বারবার গোত্রের লোকদের এই গুহাজীবনের কারণে জায়গাটি তিউনিসিয়া ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে মোটামুটি পরিচিতি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় ‘স্টার ওয়ারস’ চলচ্চিত্রটি। ছবিটির কিছু দৃশ্যায়ন হয় মাতমাতার পাতাল রাজ্যে। ব্যাস পর্যটকদের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠল মাতমাতা।

লিবিয়া এবং তিউনিসিয়ার সীমান্ত এলাকায় বাস করা বারবার গোত্রের লোকেরা দস্যুদের আক্রমণের শিকার হতো বেশি। এতে বাধ্য হয় মাতমাতা মালভূমিতে এসে পর্বতের উপরে গর্ত খুঁড়ে আবাস তৈরি করতে শুরু করেন। পরে পরিস্থিতির উন্নতি হলে, তাদের অনেকেই পর্বতের নিচের দিকে ঢালে এমনকী সমতলে গ্রাম তৈরি করতে থাকতে শুরু করেন।

মাতমতার বসতি গড়ে উঠেছে বেলে পাথরের তাকের ওপর। এখানে সাধারণ যন্ত্রপাতির সাহায্যেও অনায়াসে খনন করা যায়। এভাবে এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে ঘর তৈরি করে আসছে মাতমাতার বারবাররা। যখন তৈরি হয়ে যায় এ বাড়িগুলো হয়ে ওঠে আরব অঞ্চলের অত্যাধিক গরম থেকে বাঁচার একটি বড় আশ্রয়। এ ধরনের বাড়িগুলো বেশ শক্তপোক্ত, অনেক বছর টিকে থাকে। অবশ্য ১৯৬০-র দশকের সেই প্রবল বৃষ্টির মতো কিছু হলে আলাদা কথা। তখন বৃষ্টি ও বন্যায় মাতমাতার পাতাল বসতিরও ক্ষতি হয়।

পৃথিবীতে আরও কিছু এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা গুহায় থাকার নজির আছে। তবে ওই সব জায়গার অধিবাসীরা সাধারণত পাহাড় বা পর্বতঘেঁষে বাসস্থান তৈরি করলেও মাতমাতা ব্যাতিক্রম। এর বদলে মাটিতে বড় একটি গর্ত খুঁড়ে তারা। তারপর ওই গর্তের চারপাশে গুহা তৈরি করে রুম হিসেবে ব্যবহার করেন। গর্তের মাঝের সমতল জায়গাটি ব্যবহৃত হয় বাড়ির উঠান হিসেবে।

মাতমাতার এমন একটি পাতাল বাড়িতে ভ্রমণ আসলেই অসাধারণ অভিজ্ঞতা। উঠান থেকে একটি কামরায় প্রবেশের পর বিভিন্ন সুড়ঙ্গের মাধ্যমে সহজেই অন্যান্য কামরায় চলে যেতে পারবেন। আমাদের সাধারণ বাসা কিংবা বাড়ির মতোই কামরাগুলোর কোনোটা শোবার ঘর, কোনো রান্নাঘর, কোনোটা ডাইনিং, কোনোটা ড্রইং রুম। মাঝখানের উঠোনটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি প্রয়োজনীয় তাজা বাতাসের যোগান দেয়। পরিবারের সদস্যদের আড্ডা কিংবা আত্মীয়-প্রতিবেশীদের সঙ্গে সময় কাটানোর একটি জায়গা হিসেবেও এটি ব্যাবহার করা হয়।

সেখানে গেলে জামাল, সালেহার মতো আরও কাউকে কাউকে খুঁজে পাবেন। নিজেদের পাতাল আবাস ঘুরিয়ে দেখাবার পাশাপাশি আপনাকে খুব পছন্দ হয়ে গেলে, তাদের বিখ্যাত খাবার কসকস বানানো কিংবা গালিচা বোনার কৌশলও শেখাতে পারে। যেসব যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করে পাতালারাজ্য বানাতেন তাও দেখার সুযোগ মিলতে পারে। তাদের সঙ্গে চাইলে একটা বেলা খেতেও পারেন।

তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো এখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই পুরানো বাসস্থান ছেড়ে যাচ্ছেন। ১৯৬০ ও ১৯৭০-র দশকেই যার সূচনা হয়।  বিদেশি পর্যটক আসা কমে যাওয়ায় ইদানিং আরও অনেকেই ছেড়ে যাচ্ছেন সাধের গুহা বাড়ি। তবে এরপরও কিছু মানুষ পরিবারসমেত রয়ে গেছেন গুহাবাড়িতে। নিজেদের জলপাই বাগানে কাজ করেন তারা। আর মাঝেমাঝে যেসব পর্যটক এখানে আসেন নিজেদের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখিয়ে কিছু রোজগার হয় তাদের। এমনকী কীভাবে এ ধরনের মাটি খুঁড়ে এ ধরনের বাড়ি তৈরি করতে হয় এবং এগুলোর দেখভাল করতে হয় এমন মানুষের সংখ্যাও খুব বেশি নয়।

এখন অবশ্য মাতমাতার বেশ কিছু খালি বাড়িকে পর্যটকদের জন্য হোটেল ও রেস্তোঁরায় পরিবর্তিত করা হয়েছে। স্টার ওয়ারস ছাড়াও আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে জায়গাটিতে। স্টার ওয়ারস ভক্তরা চাইলে মাতমাতায় লুক স্কাইওয়াকারের বাড়িতে রাতও কাটাতে পারেন। সেটি এখন রূপান্তরিত হয়েছে হোটেল সিদি ড্রিসে, যেটি পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। কাজেই এখানকার গুহাবাসীদের দেখার পাশাপাশি কোনো গুহা হোটেলে রাত কাটাতে চাইলে কিংবা নিদেনপক্ষে রেস্তোঁরায় নাস্তা করতে চাইলে মাতমাতার ঘুরে আসতেই পারেন। সেই সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারবেন এখানকার বিখ্যাত জলপাই বাগানেও।

লেখটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: বিচিত্র

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × four =