একটি পতাকা পেলে…

প্রভাষ আমিন: মার্চ এলেই রক্তে যেন দামামা বেজে ওঠে। মার্চের প্রতিটি দিনই যেন অগ্নিঝরা, রক্তে ভেজা। মার্চের শুরুর দিনটা সম্পর্কে সাংবাদিক মাহবুব কামালের একটি স্ট্যাটাসের কিছুটা উদ্ধৃত করেই শুরু করছি লেখাটি, ‘আজ ১ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনটিকে খুব মনে পড়ছে। সেদিন আমরা ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়েছিলাম ঢাকা স্টেডিয়ামে। এমসিসির বিরুদ্ধে খেলছিলো পাকিস্তান দল। আমরা সবাই ছিলাম পাকিস্তানের পক্ষে। বস্তুত ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি ম্যান্ডেট দিয়েছিলো ৬ দফার পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে নয়। পাকিস্তানিরাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। যাহোক, সেদিন অনেকেই খেলার রানিং কমেন্ট্রি শোনার জন্য ছোট্ট রেডিও নিয়ে গিয়েছিলেন স্টেডিয়ামে। দুপুর ১টা। তখন পাকিস্তানের পক্ষে ব্যাট করছিলেন আসিফ ইকবাল ও সরফরাজ নেওয়াজ। তাদের স্কিলফুল ব্যাটিং আমরা উপভোগ করছিলাম। ঠিক ১টায় রেডিওতে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার বক্তৃতায় ৩ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্টের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন। আর যায় কোথায়! মুহূর্তেই উবে গেলো পাকিস্তানপ্রীতি, জেগে উঠলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। প্রকৃতপক্ষে, সেই মুহূর্তটাই ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্পষ্ট প্রকাশ। খেলা পণ্ড হয়ে গেলো। আমরা সবাই সামিয়ানার কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দলে দলে ছুটলাম নিকটস্থ পূর্বাণী হোটেলের দিকে। সেখানে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভা করছিলেন। ক্রোধান্বিত জনতার সামনে হাজির হলেন তিনি। বললেন, ৩ তারিখ পল্টন ময়দানে তিনি তার বক্তব্য রাখবেন। সেইসব দিনগুলোর কথা ইংরেজিতে বললে ভালো শোনাবে: Those were the days, sweet days. বিকেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে বাসায় এসে রাতে রবীন্দ্রসংগীত শোনা, এই স্মৃতি কি ভোলা যায়?’

স্ট্যাটাসে যে ঢাকা স্টেডিয়ামের কথা বলা হয়েছে, বর্তমানে সেটি বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। এই তো সেদিন মিরপুরে যাওয়ার আগে এই স্টেডিয়ামেই ক্রিকেট খেলা হতো। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টও হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই। তো একাত্তরের পহেলা মার্চ তখনকার ঢাকা স্টেডিয়ামে যে আগুন জ্বলেছিল, তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ঢাকায়, গোটা দেশে। দেশ মানে তখনও পূর্ব পাকিস্তান। একাত্তরের মার্চের ১ তারিখে জ্বলা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানকে। সেই লড়াই থেমেছিল একেবারে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।
মার্চের প্রতিটি দিনই আসলে রক্তের অক্ষরে লেখা। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনের গাড়ি বারান্দা থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল পতাকা। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় পাঠ করা হয়েছিল স্বাধীনতার ইশহেতার। ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তখনকার রেসকোর্স) লাখো মানুষের সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনরতার সংগ্রাম।’ তারপর পাকিস্তানীরা আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে আর ঢাকায় সৈন্য সমাবেশ করে। সৈন্য সমাবেশ শেষে তারা পালিয়ে যায়। আর নিরস্ত্র বাঙালির ওপর লেলিয়ে দেয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে। ২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে শুরু করে গণহত্যা। তারা শুধু মাটি চেয়েছিল, মানুষ চায়নি। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত হয় বিজয়।

মুক্তিযুদ্ধ আসলে ছিল একটি জনযুদ্ধ। অল্প কিছু স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া বাংলাদেশের সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মানুষ কেন জীবনের মায়া না করে যুদ্ধ করেছিল? তারা নিজেদের একটি পতাকা চেয়িছিল, একটি জাতীয় সংগীত চেয়েছিল, একটি দেশ চেয়েছিল। যে দেশ হবে উন্নত, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক। যেখানে বৈষম্য থাকবে না, ন্যায়বিচার পাবে সবাই। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত এই দেশকে আমরা সবাই ভালোবাসি। দেশ আসলে মায়ের মতো। যত সমস্যাই থাকুক, মা যেমন সবার ওপরে, দেশও সবার ওপরে। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গান আমাদের রক্তে আগুন ধরিয়েছে।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় দেশপ্রেম বিষয়টা আসলে কী? যতবার জাতীয় সংগীত শুনি ততবার শিহরিত হই। জাতীয় পতাকা দেখলে শ্রদ্ধায় আমরা দাঁড়িয়ে যাই। এই লেখা যখন লিখছি, তখন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ডের মধ্যকার দ্বিতীয় ওয়ানডে চলছিল। টিভিতে খেলা দেখার সময় দর্শকরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়াচ্ছিল। যতবার পতাকা নাড়তে দেখি, ততবার অন্যরকম এক আবেগে শিহরিত হই।
গণজাগরণ মঞ্চ আমাদের জীবনে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার নাম। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা সে আন্দোলন, বাংলাদেশের সবচেয়ে মহৎ আন্দোলনগুলোর একটি। সেখানে একেকদিন একেকরকম কর্মসূচি ছিল। একদিনের কর্মসূচি ছিল জাতীয় পতাকা উত্তোলন। বারডেমে এবং বিএসএমএমইউ হাসপাতালের মাঝে টানানো হয়েছিল বিশাল আকারের জাতীয় পতাকা। সেই পতাকার দিকে তাকিয়ে বুকে হাত রেখে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়াটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। এখন লেখার সময়ও সেই স্মৃতি আমাকে রোমাঞ্চিত করছে। এই যে সবুজের বুকে লাল বৃত্ত, এরচেয়ে সুন্দর পতাকা আর কোথাও নেই। তবে স্বাধীনতার আগে আমাদের পতাকাটা এমন ছিল না। সবুজ জমিনের মাঝে লাল বৃত্ত, তার মাঝে সোনালি রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা ছিল আমাদের প্রথম পতাকায়। স্বাধীনতার পর মানচিত্রটি সরিয়ে চূড়ান্ত করা হয় জাতীয় পতাকা। প্রতিবার জাতীয় পতাকায় মানচিত্র আঁকা কঠিন। তাতে বিকৃতির আশঙ্কা থাকে, তাই মানচিত্রটি সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে স্বাধীনতার আগের পতাকাটি তখনকার জন্য একদম ঠিক ছিল। জাতীয় পতাকার মাঝে মানচিত্র এঁকে আমরা চিহ্নিত করে দিয়েছিলাম আমাদের ভৌগোলিক সীমানা, আমাদের স্বাতন্ত্র্য।

তবে আমি বুঝি, জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়াটাই দেশেপ্রেমের শেষ কথা নয়। দেশপ্রেম হলো যার যার জায়গা থেকে দেশের জন্য কাজ করা। ‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’ এই গান গেয়ে আবেগাপ্লুত হওয়াই শেষ কথা নয়। দেশটাকে সত্যি সত্যি সবার সেরা করতে হবে, সকল দেশের রানী বানাতে হবে। আর সে জন্য আমাদের সবাইকে নিজ নিজ কাজটা করতে হবে, সবচেয়ে ভালোভাবে, সততার সাথে। দেশপ্রেমিক হতে হলে রাজনীতি করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যিনি চাষ চালাবেন, তিনি চাষটা করবেন সবচেয়ে ভালোভাবে, দেশটাকে বুকে রেখে।

কবি হেলাল হাফিজের একটা কবিতা আছে, একটি পতাকা পেলে-

‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, ‘পেয়েছি, পেয়েছি’।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনু মিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুধে-ভাতে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।’

পতাকা পেয়েছি, সংগীত পেয়েছি, দেশ পেয়েছি। কিন্তু আমাদের সব স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। যৌথ খামার হয়নি, সুখের ভাগ সমান হয়নি। উন্নতি অনেক হয়েছে, কিন্তু উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈষম্য। যেদিন উন্নয়নের সুফল পৌঁছে যাবে সবার ঘরে ঘরে; দেশ হবে সত্যিকারের উন্নত, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক; সেদিন সত্যিকারের স্বাধীনতা পাবো আমরা। দেশ আমার মা। দেশটা হোক সবার।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × 2 =