কপ৩০: আলোচনায় অচলাবস্থা, চাপ বাড়াল নাগরিক সমাজ

আফরোজা আখতার পারভীন, ঢাকা

কপ৩০-এর অষ্টম দিনে এসে আলোচনায় গতি থাকলেও সমাধান নেই। জীবাশ্ম জ্বালানি ধাপে ধাপে কমানো বা বন্ধ, জলবায়ু অর্থায়নের পরিমাণ এবং শর্ত—সবকিছু ঘিরেই রয়ে গেছে গভীর মতবিরোধ। এদিকে নাগরিক সমাজ ও আদিবাসী গোষ্ঠীর আন্দোলন আরও জোরদার হয়েছে। কপ প্রেসিডেন্সিও সন্ধ্যায় জরুরি ব্রিফিংয়ে জানায়, “রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।”

১) আলোচনার অগ্রগতি: অষ্টম দিনে কী হলো

ক) জীবাশ্ম জ্বালানি ধাপবিন্যাস: বিভাজন আরও স্পষ্ট

নতুন সমন্বিত খসড়া টেক্সটে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে—

১. ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্য অনুযায়ী জীবাশ্ম জ্বালানির “ফেজ-আউট”

২. “অ্যানঅ্যাবেটেড” জীবাশ্ম জ্বালানির “ফেজ-ডাউন”

৩. ফসিলের নাম না নিয়ে শুধু “এনার্জি ট্রানজিশন” উল্লেখ

ঝুঁকিপূর্ণ ও উন্নয়নশীল দেশগুলো স্পষ্ট “ফেজ-আউট” ভাষা দাবি করছে।

একটি দ্বীপ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলেন—“টেক্সটে যদি ফেজ-আউট না আসে, আমরা আমাদের নিজেদের বিলুপ্তি নিয়ে আলোচনা করছি।”

বড় উৎপাদক দেশগুলো এখনও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান ও কার্বন ক্যাপচার ব্যবহারের সুযোগ রাখতে চায়।

খ) জলবায়ু অর্থায়ন: নেই কোনো ঐকমত্য

নতুন আর্থিক লক্ষ্য (NCQG) নিয়ে আলোচনা এখনও আটকে আছে। বার্ষিক লক্ষ্য ৬০০ বিলিয়ন থেকে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বিস্তৃত পরিসরে ঘুরছে।

মূল দ্বন্দ্ব—

  • অনুদান বনাম ঋণ
  • সরকারি বনাম বেসরকারি অর্থ
  • ঐতিহাসিক দায়ের ভূমিকা
  • ঋণমুক্তি ও সহজ প্রবেশাধিকার

একজন আফ্রিকান আলোচক বলেন—“শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো ট্রানজিশন করতে পারবে না। দরকার পূর্বানুমানযোগ্য ও ন্যায্য অর্থায়ন।”

গ) আর্টিকেল ৬ (কার্বন বাজার) – আংশিক অগ্রগতি

কিছু বিষয়ে কাছাকাছি এসেছে পক্ষগুলো—

  • স্বচ্ছতার টেমপ্লেট
  • প্রকল্পের বেসলাইন ও সততা মানদণ্ড

তবে সমাধান হয়নি—

  • দ্বৈত-গণনা রোধ
  • দেশগুলোর মধ্যে ক্রেডিট আদানপ্রদানের নিয়ম

রাত পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলবে।

ঘ) লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড: কাঠামো এগোলেও অর্থ নেই

গভর্নেন্স ও কাঠামো নিয়ে সম্মতি বাড়লেও প্রকৃত মূলধনের প্রতিশ্রুতি এখনও নেই।

ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সতর্ক করেছে—“অর্থ না থাকলে ফান্ড হবে খালি বাক্স।”

২) নাগরিক সমাজের আন্দোলন: অষ্টম দিনে চাপ বাড়ল

ক) আদিবাসী ও আমাজনবাসীর মিছিল

৩ হাজারের বেশি আদিবাসী ও বনভূমি–নির্ভর জনগোষ্ঠী বড় জমায়েত করে ঘোষণা দেয়—“আমরাই আমাজনের রক্ষক। আলোচনায় আমাদের জায়গা নেই, কিন্তু দায় আমাদের কাঁধে।”

তাদের দাবি—অধিকার সুরক্ষার স্পষ্ট উল্লেখ এবং আদিবাসী সংরক্ষণ কার্যক্রমের জন্য পৃথক অর্থায়ন।

খ) ফসিল–ফ্রি জোটের বড় আন্দোলন

যুবগোষ্ঠী, বিজ্ঞানী ও জলবায়ু ন্যায়বিচার নেটওয়ার্ক ব্লু জোনে সমন্বিত বসে থাকা কর্মসূচি করে। তাদের দাবি—

  • জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পূর্ণ ফেজ-আউট
  • কার্বন ক্যাপচারকে “ফাঁকির সমাধান” হিসেবে প্রত্যাখ্যান

এক তরুণ কর্মী বলেন—“সময় ফুরিয়ে আসছে। জলবায়ু আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না।”

গ) ঋণমুক্তি ও ন্যায্য অর্থায়নের দাবিতে বিশ্বজুড়ে সংহতি

আফ্রিকা, এশিয়া, ক্যারিবীয় ও লাতিন আমেরিকার সংগঠনগুলো যৌথভাবে ঘোষণা দেয়—“ঋণের বোঝার ওপর জলবায়ু অর্থায়ন দাঁড়াতে পারে না।”

৩) কপ৩০ প্রেসিডেন্সির ব্রিফিং – অষ্টম দিনের বার্তা

সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট আঁদ্রে কোরেয়া দো লাগো জরুরি পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেন।

প্রেসিডেন্সির মূল বক্তব্য:

  • “আমরা অনুসন্ধান নয়, এখন আলোচনার পর্যায়ে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।”
  • “অর্থায়ন ছাড়া কোনো বাস্তবসম্মত ফলাফল সম্ভব নয়।”
  • “সব পক্ষকে নমনীয় হতে হবে। কেউই ১০০% পাবে না।”

তিনি জানান—

  • নতুন, সরলীকৃত খসড়া দিন ৯-এর শুরুর দিকে প্রকাশ করা হবে
  • মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা রাতভর চলবে

নাগরিক সমাজ সম্পর্কে তিনি বলেন—“তাদের কণ্ঠ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কেন আমরা এখানে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করে।”

৪) সামনে কী?—অষ্টম দিনের তাৎপর্য

  • রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো পথ নেই
  • জীবাশ্ম জ্বালানি ও অর্থায়ন—দুই ইস্যুই চূড়ান্ত ফল নির্ধারণ করবে
  • নাগরিক সমাজের চাপ আলোচনার গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে

এক অভিজ্ঞ আলোচক মন্তব্য করেন—“বিজ্ঞান জানি, সমাধান জানি—কষ্টটা রাজনৈতিক সাহসে। দিন ৯-এ বোঝা যাবে আমরা সেই সাহস পেলাম কি না।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 1 =