বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ তার চূড়ান্ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছালে, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা কূটনৈতিক তৎপরতা নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেন। জীবাশ্ম জ্বালানি ট্রানজিশন, জলবায়ু অর্থায়ন এবং বহুল আলোচিত বেলেম প্যাকেজ—এই তিনটি মূল ইস্যুতে এখনও গভীর মতপার্থক্য থাকায় লুলা সরাসরি আলোচনায় হস্তক্ষেপ করেন, যাতে সম্মেলন কোনো সমাধান ছাড়াই শেষ না হয়।
লুলার সরাসরি মধ্যস্থতা: অচলাবস্থা ভাঙার শেষ চেষ্টা
কয়েকদিনের অচলাবস্থার পর লুলা একাধিক গোপন বৈঠকে বসেন—উচ্চ-উদ্যমী দেশগুলোর জোট, BASIC দেশসমূহ, OPEC+ সদস্য, ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র, G77+China—সব পক্ষের সঙ্গেই তিনি আলাদাভাবে আলোচনা করেন।
মূল লক্ষ্য ছিল দুইটি কঠিন বিষয়ে আপস করানো:
- জীবাশ্ম জ্বালানি ফেজ-আউট সংক্রান্ত ভাষা
- ২০৩০-পরবর্তী জলবায়ু অর্থায়ন কাঠামো ও প্রতিশ্রুতি
এক বৈঠকে লুলা স্পষ্টভাবে বলেন:“ব্রাজিল এমন একটি COP আয়োজন করতে পারে না যা দিকনির্দেশনা ছাড়াই শেষ হয়। বিশ্ব নেতৃত্ব চায়, আর নেতৃত্ব মানে আপসের সাহস।”
তিনি দেশগুলোকে “স্বাচ্ছন্দ্যের সীমানা থেকে এক ধাপ এগোতে” আহ্বান জানান।
বেলেম প্যাকেজ: উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মাঝে একটি সমন্বিত প্রস্তাব
লুলা ব্যক্তিগতভাবে বেলেম প্যাকেজ-এর সর্বশেষ সংস্করণ পর্যালোচনা ও সংশোধন করেন। প্যাকেজটিতে অন্তর্ভুক্ত—
- জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বৈশ্বিক উত্তরণের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি
- ১.৫°ডিগ্রী সেলসিয়াস সীমা ধরে জলবায়ু অর্থায়নের রোডম্যাপ
- অ্যামাজন সুরক্ষা ও আদিবাসী অধিকার জোরদার উদ্যোগ
- অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতা-সংক্রান্ত চুক্তি
- আর্টিকেল ৬ (কার্বন বাজার) নির্দেশনা ও সুরক্ষা
- জাস্ট ট্রানজিশন—শ্রম, সামাজিক নিরাপত্তা ও খনিজ সরবরাহ নীতিমালা
এক প্রেস ব্রিফিংয়ে লুলা বলেন:“এই প্যাকেজ নিখুঁত নয়; কিন্তু এটিই সেই সেতু, যা আমরা একসঙ্গে পার হতে পারি। ইতিহাস দেখবে—আমরা সে সাহস দেখিয়েছি কি না।”তবুও টেক্স এর একাধিক অংশ এখনও ব্র্যাকেটে রয়েছে—বিশেষত ফেজ-আউট সময়রেখা ও অর্থায়ন কাঠামো।
কূটনৈতিক কৌশল: লুলার সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা
পর্যবেক্ষকদের মতে লুলা তিনটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করেন—
৩.১ সরাসরি মধ্যস্থতা
বিপরীত মতাদর্শের ব্লকগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক— উচ্চ-উদ্যমী দেশগুলোকে নমনীয় হতে বলা, আর তেল-গ্যাস উৎপাদক দেশগুলোকে ঐকমত্য আটকে না রাখতে অনুরোধ।
৩.২ আঞ্চলিক নেতৃত্বে জোর
লুলা বারবার অ্যামাজন রক্ষার কথা বলেন:“অ্যামাজন শুধু ব্রাজিলের নয়—মানবতার ঐতিহ্য।”
৩.৩ ন্যায়বিচার ও সমতা—কেন্দ্রীয় বার্তা
ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান—অর্থায়ন বাড়ানো এবং ঐতিহাসিক দায় স্বীকার করা।
প্রতিক্রিয়া: আশা, সতর্কতা ও সিভিল সোসাইটির চাপ
৪.১ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সমর্থন
ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র ও জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো লুলার নেতৃত্বকে “প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক তৎপরতা” বলে উল্লেখ করে।
৪.২ তেল-গ্যাস উৎপাদক দেশগুলোর সংশয়
তাদের মতে পাঠ এখনও “অবাস্তব ও কঠিন সময়সীমা” নির্দেশ করে।
৪.৩ সিভিল সোসাইটি ও আদিবাসী নেতৃত্বের চাপ
তারা আরও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দাবি করে। এক আদিবাসী নেতার বক্তব্য—“আমরা লুলার প্রচেষ্টাকে সম্মান করি। কিন্তু সম্মান বন রক্ষা করে না—আমাদের এখনই শক্তিশালী গ্যারান্টি চাই।”
যুব ও এনজিও গোষ্ঠী—“ফুল, ফাস্ট, ফেয়ার” ফেজ-আউট এবং বাস্তব অর্থায়ন বৃদ্ধির দাবি তোলে।
সামনে কী: লুলার উপর কি নির্ভর করছে কপ৩০-এর সফলতা?
যেহেতু সময় ফুরিয়ে আসছে, COP30 সফল হবে কি না তা অনেকটাই নির্ভর করছে লুলার শেষ মুহূর্তের মধ্যস্থতার উপর।
মূল প্রশ্নগুলো—
- লুলার সংশোধিত বেলেম প্যাকেজ কি সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারবে?
- ফেজ-আউট ভাষা কি পর্যাপ্ত শক্তিশালী তবে গ্রহণযোগ্য হবে?
- ধনী দেশগুলো কি নতুন, স্পষ্ট অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি দেবে?
এক অভিজ্ঞ আলোচকের ভাষায়:“এই কপ শেষ করতে যদি কেউ সক্ষম হয়, তবে সে লুলাই। কিন্তু বিভাজন গভীর, আর সময় খুব কম।”
কপ৩০-এ ঐকমত্য গঠনে লুলার শেষ প্রচেষ্টা ব্রাজিলের শক্তিশালী কূটনৈতিক ভূমিকার প্রতীক। তাঁর মধ্যস্থতাই নির্ধারণ করবে—এই সম্মেলন একটি সুসংহত ও কার্যকর বেলেম আউটকাম নিয়ে শেষ হবে, না কি বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতির সীমাবদ্ধতা আবারও স্পষ্ট হবে।