কপ৩০: টেক্সে অগ্রগতি, কিন্তু মূল রাজনৈতিক সমাধান এখনো ধোঁয়াশা

আফরোজা আখতার পারভীন, ঢাকা

জলবায়ু আলোচনা সপ্তম দিনে এসে টেকনিক্যাল আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক পর্যায়ে উত্তাপ বাড়িয়েছে। অনেক খাতে প্রাথমিক খসড়া টেক্স সামনে এসেছে, নতুন প্রস্তাব যুক্ত হয়েছে, এবং বিভিন্ন ট্র্যাকে “ব্র্যাকেট” কমানো শুরু হলেও চূড়ান্ত অবস্থানের ব্যবধান এখনো বড়। অন্যদিকে, বাইরে সিভিল সোসাইটি ও আদিবাসী আন্দোলন আলোচনায় নতুন চাপ তৈরি করেছে।

১) নেগোসিয়েশনে অগ্রগতি

খসড়া টেক্স প্রকাশ

গত ২৪ ঘণ্টায় মিটিগেশন, ফাইন্যান্স, অ্যাডাপটেশন, আর্টিকেল-৬ কার্বন মার্কেটসহ বিভিন্ন ট্র্যাকে ‘জিরো-ড্রাফট’ ও ‘অপশন টেক্স’ প্রকাশিত হয়েছে। এসব খসড়া টেক্সে কোথায় কোথায় বড় মতবিরোধ আছে তা স্পষ্ট হয়েছে।

ফসিল ফুয়েল ভাষা এখনো সবচেয়ে বিতর্কিত

বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত ও উন্নয়নশীল দেশ পরিষ্কার “ফসিল ফুয়েল ফেজ-আউট” শব্দচয়ন চায়। কিন্তু কয়েকটি বড় নিঃসরণকারী ও তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ “ফেজডাউন” বা কার্বন ক্যাপচার ভিত্তিক নমনীয় ভাষা চায়। ফলে এ ট্র্যাকে অগ্রগতি খুব ধীরে।

ফাইন্যান্স পুরো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু

২০২৫–পরবর্তী নতুন জলবায়ু তহবিল লক্ষ্য (NCQG) নিয়ে আলোচনা সবচেয়ে জটিল। আলোচনায় বছরে কয়েকশ বিলিয়ন থেকে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন স্কেল রয়েছে। অনুদান বনাম ঋণ, সরকারি বনাম বেসরকারি জোগান—এসব বিষয়ে অমিল তীব্র।

কার্বন মার্কেট (আর্টিকেল-৬)

নতুন অনানুষ্ঠানিক নথিতে শৃঙ্খলাপূর্ণ ক্রেডিটিং নিয়ম, স্বচ্ছতা এবং ডাবল কাউন্টিং রোধের প্রস্তাব এসেছে। তবে পক্ষগুলোর অবস্থান এখনো দূরে।

অ্যাডাপটেশন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ

লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের পরিচালনা নীতি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো বলছে, বাস্তব অর্থায়ন ছাড়া এই ফান্ড শুধু প্রতীকী হয়ে যাবে।

২) সাইড ইভেন্ট ও আন্দোলনের প্রভাব

সিভিল সোসাইটি: রাস্তায় শক্তিশালী উপস্থিতি

সপ্তম দিনে বেলেমে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে বিশাল জলবায়ু মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী, তরুণ, গ্রামীণ কমিউনিটি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন অংশ নেয়। প্রধান বার্তা ছিল—“জলবায়ু ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো সমাধান নয়।”

দুইটি বড় বিষয় আলোচনায় চাপ বাড়িয়েছে:

  • ফসিল ফুয়েল ফেজ–আউটের দাবি
  • অ্যাডাপটেশন ফাইন্যান্সে বাস্তব অর্থায়ন নিশ্চিত করা

আদিবাসী গোষ্ঠীর ভূমিকা জোরালো করে তুলে ধরা হয়। তারা বলেন, আমাজন বন রক্ষা ছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

পিপলস সামিট

সরকারি আলোচনা থেকে আলাদা “পিপলস সামিট”-এ সামাজিক আন্দোলনগুলো করপোরেট প্রভাব, কার্বন মার্কেটের সীমাবদ্ধতা এবং কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন সমাধান তুলে ধরে।

৩) কপ প্রেসিডেন্সির ব্রিফিং: ‘সময় খুব কম, সিদ্ধান্ত এখনই’

কপ৩০ প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো সপ্তম দিনের ব্রিফিংয়ে বলেন: “আমরা এখন অনুসন্ধান নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে। প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর দেরি করা যাবে না।”

প্রেসিডেন্সির মূল বার্তা:

  • প্রথম সপ্তাহে ৩০টির বেশি ঘোষণা এসেছে—প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা, সংস্কৃতি, ফাইন্যান্স, কার্বন মার্কেট ইত্যাদি বিষয়ে।
  • অ্যাডাপটেশন, আদিবাসী অধিকার, এবং নেচার–বেজড সলিউশনকে উচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
  • রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে মন্ত্রী পর্যায়ের ‘হাই-লেভেল’ আলোচনা শুরু হবে।

প্রেসিডেন্সি পাশাপাশি স্বীকার করেছে:

  • ফাইন্যান্স ও ফসিল ফুয়েলের ভাষায় সমঝোতা না হলে কপ৩০ ঝুঁকিতে পড়বে।

৪) সামনে কী

  • টেকনিক্যাল টেক্স প্রায় প্রস্তুত; এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে ফলাফল।
  • তহবিল-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এবং ফসিল ফুয়েফ ফেজ-আউট রোডম্যাপ—এই দুটো প্যাকেজ চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করবে।
  • আদিবাসী ও সিভিল সোসাইটির আন্দোলন মন্ত্রীদের ওপর চাপ বাড়াবে—বিশেষত অ্যাডাপটেশন ও ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর (Just Transition) বিষয়ে।

কপ৩০-এর সপ্তম দিন দেখাল—অগ্রগতি হচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এখনো বাকী। বেলেম কপ কি কার্যকর বাস্তবায়ন এজেন্ডা দিতে পারবে, নাকি আবারো উচ্চাশা-কম ডেলিভারি-এই চক্রই পুনরাবৃত্তি হবে—তা নির্ধারিত হবে পরবর্তী কয়েক দিনে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

10 + seven =