কপ৩০ ৫ম দিন: আলোচনায় গতি, খসড়া সিদ্ধান্তপত্রে অগ্রগতি

আফরোজা আখতার পারভীন

ঢাকা, ১৫ নভেম্বর ২০২৫ (রঙবেরঙ ডেস্ক)— বেলেমে কপ৩০-এর পঞ্চম দিনে আলোচনায় গতি ফিরলেও মূল রাজনৈতিক বিষয়ে অচলাবস্থা কাটেনি। বিভিন্ন আলোচনার ট্র্যাকে খসড়া টেক্সট প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে কিছু অগ্রগতি দেখা গেলেও অর্থায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহার এবং কার্বন বাজারের মতো বড় ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়েছে। এর পাশাপাশি, দিনের গুরুত্বপূর্ণ সাইড ইভেন্টগুলোতে জলবায়ু ন্যায়বিচার, অভিযোজন এবং অর্থায়ন সংস্কার নিয়ে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

আলোচনায় অগ্রগতি: প্রাথমিক সিদ্ধান্তপত্রে মতপার্থক্য

১. মিত্রিজেশন ট্র্যাক (Mitigation Work Programme – MWP)

আজ প্রকাশিত ২০-পৃষ্ঠার খসড়ায় দেখা যায়:

  • “ফসিল ফুয়েল ফেজ-আউট” শব্দটি এখনো বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়েছে—অর্থাৎ এ নিয়ে ঐকমত্য নেই।
  • কয়েকটি দেশ জোর দিচ্ছে “ফেজ-ডাউন” ভাষায়, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বলছে ১.৫°C লক্ষ্য রক্ষায় ‘ফেজ-আউট’ ছাড়া বিকল্প নেই।
  • নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ত্বরিত বিনিয়োগের আহ্বান থাকলেও অর্থায়নের উৎস স্পষ্ট নয়।

২. অভিযোজন (Global Goal on Adaptation – GGA)

প্রকাশিত আপডেটেড খসড়ায়:

  • দুর্যোগ পূর্বাভাস, পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং অবকাঠামোয় অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানোর পরিমাপক সংযোজন হয়েছে।
  • তবে বিতর্ক চলছে “অভিযোজন অর্থায়ন কীভাবে চিহ্নিত হবে” তা নিয়ে—উন্নত দেশগুলো প্রস্তাব দিচ্ছে নমনীয় ভাষা, আর গ্লোবাল সাউথ চাইছে বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি।

৩. জলবায়ু অর্থায়ন (New Collective Quantified Goal – NCQG)

কপ৩০-এর সবচেয়ে বিতর্কিত আলোচনায়:

  • খসড়ায় প্রথমবার উল্লেখ করা হয়েছে যে কমপক্ষে ৬০০–১০০০ বিলিয়ন ডলার/বছর প্রয়োজন ২০৩০ সাল নাগাদ।
  • কিন্তু উন্নত দেশগুলো এখনো কোনো সংখ্যা সমর্থন করেনি।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে: “নতুন তহবিল না এলে নেট-জিরো ও ১.৫°C কোনোটাই অর্জন সম্ভব নয়।”

৪. আর্টিকেল ৬ (কার্বন মার্কেট)

আজকের আলোচনায়:

  • বাজার-সমর্থক দেশগুলো কার্বন ক্রেডিট বাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করতে চায়।
  • কিন্তু আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো বলছে: “দুর্বল নিয়ম মানেই কার্বন জালিয়াতি। আমরা নতুন কিয়োটো চাই না।”

কপ৩০ প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো জানিয়েছেন: “এখন আমাদের টেক্সট আছে, কিন্তু চুক্তি এখনো নেই। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই সব ঠিক করবে।”

তিনি জানান:

  • ৭টি আলোচনার ট্র্যাক ‘টেকনিক্যাল ডেলিভারি’ পর্যায়ে আছে।
  • আজকের বৃষ্টিপাত ও ভেন্যুর আংশিক সাময়িক বন্ধ “কিছু বিলম্ব ঘটালেও আলোচনায় বড় প্রভাব ফেলেনি”।
  • প্রেসিডেন্সি বলছে তারা বিশেষ রাজনৈতিক পরামর্শ (Ministerial Consultations) শুরু করবে আগামীকাল।

গুরুত্বপূর্ণ সাইড ইভেন্ট: অর্থায়ন, ন্যায়বিচার ও বন সংরক্ষণে নজর

১. Climate Finance Reset Dialogue — Day 2

  • উন্নয়নশীল দেশগুলো জোর দিয়ে বলেছে, “ঋণ নয়, অনুদান—কোনো নতুন ঋণের বোঝা নয়।”
  • গ্লোবাল সাউথ প্রস্তাব দিয়েছে:
  • ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের জন্য নতুন কর ব্যবস্থার
  • জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে গ্রান্ট-ভিত্তিক ফান্ড

২. Tropical Forest Forever Fund (TFFF) — Technical Session

  • আজকের আলোচনায় ব্রাজিল দাবি করেছে, “৫.৬ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত হয়েছে।”
  • ইন্দোনেশিয়া, ডিআর কঙ্গো এবং পেরু যৌথভাবে বলেছে— “আমরা কার্বন শোষণ করি, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত আমরা—ন্যায্য অর্থায়ন চাই।”

৩. Youth-Urgency Forum

  • ৪০টিরও বেশি দেশের তরুণ প্রতিনিধিরা বলেছে, “বক্তব্য নয়, সিদ্ধান্ত চাই—আমরা পরবর্তী প্রজন্ম, প্রপোজাল নয়।”

পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ

  • খসড়া টেক্সট এসেছে—এটি অগ্রগতি।
  • কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া কিছুই চূড়ান্ত হবে না।
  • আলোচনায় এখনো তিনটি বড় ঝুঁকি:
  1. অর্থায়নের সংখ্যা নিয়ে অচলাবস্থা
  2. ফসিল ফুয়েল ফেজ-আউট ভাষা নিয়ে বিরোধ
  3. কার্বন বাজারের নিয়ম নিয়ে মতবিরোধ

সামনে কী দেখতে হবে?

  • আগামীকাল থেকে উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী পর্যায়ের আলাপ শুরু—এখানেই সিদ্ধান্ত হবে।
  • ফসিল ফুয়েল নিয়ে কি একক ভাষা আসবে?
  • এনসিকিউজি তহবিলে কি কোনো সংখ্যা সম্মত হবে?
  • কার্বন বাজারে কি স্বচ্ছতা নিশ্চিত

পঞ্চম দিনের আলোচনার সমাপনী

কপ৩০-এর পাঁচ নম্বর দিনটি শেষ হলো কিছু টেকনিক্যাল অগ্রগতি নিয়ে, তবে এখনো কোনো বড় রাজনৈতিক সমঝোতা সামনে আসেনি। প্রশমন (Mitigation), অভিযোজন (Adaptation), জলবায়ু অর্থায়ন এবং কার্বন বাজার (Article 6)–সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ট্র্যাক হালনাগাদ আলোচনা খসড়া (draft text) প্রকাশ করেছে। এতে কোন কোন জায়গায় সমঝোতার সম্ভাবনা আছে এবং কোথায় মতপার্থক্য সবচেয়ে গভীর—তা আরও স্পষ্ট হয়েছে।

তবুও, মূল রাজনৈতিক মতভেদ রয়ে গেছে অমীমাংসিত। জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ, নতুন বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্য (NCQG), এবং Article 6-এর বাজারবিষয়ক নিয়ম—এই তিনটি ইস্যুতে এখনো বহু ব্র্যাকেট রয়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো পূর্বানুমানযোগ্য অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন ও জীবাশ্ম জ্বালানির দ্রুত পরিহারের স্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করছে; অন্যদিকে উন্নত দেশগুলো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের কারণে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিতে অনীহা প্রকাশ করছে।

সাইড ইভেন্টগুলোতে চাপ বেড়েছে আরও—ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটি ও জলবায়ু ন্যায়বিচার আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, আর ধীরে চলা সমাধান নয়, এখন প্রয়োজন রূপান্তরমূলক একশন। এদিকে, কপ সভাপতিত্বপক্ষ জানিয়েছে—যদিও টেক্সট আলোচনায় গতি এসেছে, এখন জরুরি রাজনৈতিক স্তরের হস্তক্ষেপ ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়।

ষষ্ঠ দিন থেকে মন্ত্রী পর্যায়ের পরামর্শ শুরু হবে, যা নির্ধারণ করবে কপ৩০ বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় কতটা কার্যকর সিদ্ধান্ত ছুঁয়ে যেতে পারবে।

সার্বিকভাবে, পঞ্চম দিন শেষ হলো আশা ও অনিশ্চয়তার মাঝামাঝি অবস্থায়: টেকনিক্যাল কাজ প্রায় শেষ, কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনা এখনো শুরু পর্যায়ে। কপ৩০-এর সাফল্য এখন নির্ভর করছে—মন্ত্রী ও শীর্ষ প্রতিনিধিরা এই খসড়াগুলো কি বাস্তবসম্মত, জরুরি ও ন্যায়সংগত চুক্তিতে রূপ দিতে পারেন কি না তার ওপর।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 + 11 =