কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করি

মো. সাজেদুল ইসলাম: শৈশব ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে দ্রুত ও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সময়কালই কৈশোর হিসেবে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত সময়কে কৈশোরকাল বলে। এ সময়ের ঝুঁকি হলো বন্ধু-বান্ধবদের চাপে পড়ে তারা বিপদজনক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে, কৌতুহলের বসে বা কোনো অসৎ সংগে পড়ে ধূমপান, মাদকাসক্তি, অনিরাপদ যৌন আচরণসহ নানা ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতে পারে, প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে প্রজননতন্ত্রে নানা ধরণের রোগের সংক্রমণ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকির আশংকাও বেড়ে যেতে পারে তাদের ক্ষেত্রে এ সময়।

বয়ঃসন্ধি এমন একটা পর্যায় যখন একটি শিশু একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হয়ে ওঠে। এ সময়ই মানুষের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা তৈরি হয়। এ সময় ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে, যে কারণে তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বয়ঃসন্ধিকালীন সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়ার মতো নীতি গ্রহণ করা গেলে ছেলে-মেয়েরা দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সহিংসতার চক্র ভেঙে ফেলতে পারে। কৈশোরের শিক্ষা, জ্ঞান ও অভ্যাস তার পরবর্তী জীবনের ওপর অনেক খানি প্রভাব ফেলে। কাজেই তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে কিশোর-কিশোরীদের যেমন সচেতন হওয়া প্রয়োজন, তেমনিভাবে মা-বাবা, পরিবার ও সমাজের সবাইকেও তাদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

ইউনিসেফ এর মতে, এই বয়সের ছেলে-মেয়ে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতি থাকে। প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মানসিক ও সামাজিক বিষয়ে কাউন্সেলিং ইত্যাদির মতো বিষয়ে তারা অবগত নন। এ অবস্থার কারণে বাংলাদেশে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হয়। আবার সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশু রোগাক্রান্ত  হন। বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালের তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনই রুগ্ন। আর মেয়েদের ১১ শতাংশই অনেক বেশি রোগা-পাতলা। তাদের অধিকাংশেরই জিংক, আয়োডিন ও আয়রনের ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে কিশোরী মেয়েদের অপুষ্টির পেছনে মূলত দুটো কারণÑপর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার না পাওয়া ও অল্প বয়সে গর্ভধারণ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১৮) সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২ কোটি ৭৭ লক্ষ কিশোর-কিশোরী। কৈশোরকালে মন ও দেহের যে বৃদ্ধি ঘটে, সেই পরিবর্তনের সাথে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানো শিশু-কিশোরদের মনোদৈহিক ও মনো-সামাজিক, আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন ঘটে। একই সাথে এই বয়সটা তাদের জন্য খুব সম্ভাবনার সময়।

বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশে ৩১% কিশোরী (প্রায় প্রতি তিন জন কিশোরীর মধ্যে একজন) ১৯ বছরের মধ্যে মা হচ্ছে বা গর্ভবতী হচ্ছে, যা মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯ বছর বয়স ৫৯% কিশোরী দ্বিতীয় বারের জন্য মা হচ্ছে বা গর্ভবতী হচ্ছে (বিডিএইচএস-২০১৪)।

কিশোরী (১৫-১৯) এবং তরুণী মায়েদের (২০-২৪) মাঝে মাতৃমৃত্যু হার এখনও বেশি। ৬৪.৩ শতাংশ বাংলাদেশি বিবাহিত কিশোরী কৈশোরে গর্ভধারণ করে। ৫৩.৬ শতাংশ কৈশোরে মা হয় এবং ১০.৭ শতাংশ প্রথমবার মা হওয়ার জন্য গর্ভধারণ করে।  বাংলাদেশে ১৫-১৯ বছর বয়সে প্রতি হাজারে ১১৩ জন কিশোরী গর্ভধারণ করে (বিডিএইচএস-২০১৪)। নিন্ম ও মধ্যমআয়ের দেশসমূহে ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরী গর্ভধারণ করে। শিশু জন্মদানের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা এই কিশোরী গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে কিশোরী ও সমবয়সী নারীরা দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক জটিলতায় মৃত্যুঝুঁকি ও মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। ২০-২৯ বছর বয়সে  সন্তান জন্মদানকারী মায়েদের তুলনায় ২০ বছরের কম বয়সী সন্তান জন্মদানকারী মায়েরা ৫০% মৃত শিশুর জন্ম দেন।

প্ল্যান বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কৈশোরে বিয়ে হওয়া ৬১% কিশোরীর এবং গর্ভধারণের ক্ষেত্রে ৬৫% কিশোরীর কোনো মতামত নেওয়া হয় না। এই দৃষ্টিভংগি পরিবর্তন করার লক্ষ্যে এবং সেসাথে শিশু অধিকার রক্ষায় তাদের জন্য সকল ধরনের সেবা ও সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির প্রয়াস থাকা অত্যন্ত জরুরি।

এ বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানীতে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তৃতাকালে শিক্ষা মন্ত্রী  ডা. দীপু মনি বলেন, কিশোর-কিশোরীদের সচেতনতা সৃষ্টি করার দায়িত্ব অভিভাবক, শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। বয়ঃসন্ধিকালের শিশুরা বাবা-মা অথবা তাদের শিক্ষকদের সাথে নিরাপদ যৌন জীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কোনো কথা বলেনা। অন্যদিকে অভিভাবকরাও বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করেন না। তাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। স্কুল পর্যায়ে কাউন্সিলিং সেবা দেয়ার জন্য খুব শীঘ্রই ২ লাখ শিক্ষক কাজ শুরু করবেন বলে তিনি জানান।

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কিশোর-কিশোরী বক্তারা এই অনুষ্ঠানে বলেছেন, তারা অর্থাৎ এই ঝুঁকিপূর্ণ বয়সে থাকা শিশুরা এমন একটা কমিউনিটি বা গোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করে, যারা সনাতনী ধ্যানধারণা বিশ^াস করে ও চর্চা করে। পরিবার ও সমাজ যৌনজীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো আলোচনাকে গ্রহণ করে না। বরং এই বিষয়ক আলোচনাকে ঘরে-বাইরে, এলাকায়, স্কুলে এখনো ঠেকানোর চেষ্টা করে থাকে। এ সময়টাতে তাদের অনেক পরিবর্তন হয় শরীরে, বুদ্ধিতে ও মনে। অথচ কারো সাথে শেয়ার করা যায় না।

তাই এই সময় থেকেই প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষার প্রয়োজন। তারা প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিকভাবে জানলে সুষ্ঠভাবে তারা নিজেদের যত্ন নিতে পারবে এবং এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে।

কিশোর-কিশোরীদের পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, নিরাপদ যৌন আচরণ সম্পর্কে জানা ও তা মেনে চলা, প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ, যৌন রোগ সম্পর্কে জানা ও তা প্রতিরোধ করা, প্রয়োজন অনুযায়ী প্রজনন সেবা গ্রহণ করা, অল্প বয়সে বিয়ে করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং অন্যদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা তাদের করণীয় বিষয়ের মধ্যে পড়ে। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন এবং শারীরিক ক্ষতির কথা বিবেচনা করে কিশোর-কিশোরীদের এ বয়সে যৌন আচরণের ক্ষেত্রে সংযত থাকা উচিৎ। যৌন চিন্তা যাতে মনে কম আসে সে, জন্য পড়াশোনা, খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক চর্চাসহ অন্যান্য সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন। অশ্লীল বইপত্র এবং ভিডিও বা সিনেমা দেখা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। যৌন নির্যাতনের শিকার হলে অবশ্যই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মা-বাবা বা বিশ্বস্ত কোনো মানুষকে বিষয়টি জানানো দরকার।

কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কিশোরীদের মানবাধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রায় কৌশলগত ও দ্রুত যথাযথ বিনিয়োগের প্রয়োজন। কিশোরীদের জন্য সমষ্টিগত যৌনশিক্ষা, যৌনপ্রজনন স্বাস্থ্য ও এইচআইভি সেবাসমূহের কোর প্যাকেজ আকারে নির্ধারণ করা দরকার। বিয়ের জন্য ন্যূনতম বয়স ১৮ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে বাল্যবিবাহ রোধ করা, মেয়েদের স্কুল গমন নিশ্চিত করা, যাতে তারা প্রাথমিক শিক্ষার পরও শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে এ দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এসকল ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাদি দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং মেয়েদের ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করে তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি ও এসকল কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সেবা, সকল সেবা কেন্দ্রে চালু করাসহ এবং কিশোর-কিশোরীদের জন্য তা সহজলভ্য করা জরুরি। কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে তাদের গেটকিপারদের (পিতামাতা/অভিবাবক, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ প্রভৃতি) আচরণ ও দৃষ্টিভংগীর ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধকরণ সভার আয়োজন করা প্রয়োজন।

বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়টি মাথায় রেখেই কিশোরীদের কল্যাণে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।  বাংলাদেশের ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১’  প্রথম প্রণীত হয় পরে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০২০ যুগোপযুগী করে প্রণয়ন করা হয়, যেখানে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।  বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে-মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রচারণা, সরকারি নীতিতে এ বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা, উন্নততর সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করাসহ কমিউনিটির ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের জন্য কাজ চলমান  রয়েছে। যৌবনে যারা পদার্পণ করবে, তাদের জন্য সহায়ক স্বাস্থ্যসেবা এবং বিশেষ কিছু জেলায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্যও কাজ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যনীতিতে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, তাদের প্রতি সহিংসতা রোধ এবং কিশোরী মায়েদের স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা এ সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রমের একটি অংশে পুষ্টি, এইচআইভি, পয়ঃনিষ্কাশন, ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা, জীবনদক্ষতার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা এবং গণমাধ্যমে অংশগ্রহণের মতো বিষয়ও অন্তর্ভূক্ত করেছে। প্রতিবন্ধী কিশোর কিশোরীরাও যাতে এসব সেবা পায়, সে বিষয়টিও এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সরকার জাতীয় কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য কৌশলপত্র ২০১৭-২০৩০ প্রণয়ন করেছে। সারা বাংলাদেশের ৬০৩টি কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্রে এই নীতিমালা অনুযায়ী কিশোর-কিশোরীদের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সারাদেশের এইসব সেবাকেন্দ্রের সেবার মান উন্নয়নকল্পে সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নার্সদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

২০৩০ সালের মধ্যে কিশোর-কিশোরীদের সার্বিক কল্যাণ ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য কৌশলপত্র বাস্তবায়নে কাজ করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সরকারের পাশাপাশি প্রয়োজন এখন আমাদের সকলের ব্যক্তি পর্যায় থেকে সহযোগিতা করা – সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। গণমাধ্যম এবং শিক্ষকদেরও এ ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রয়েছে, যা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।

পিআইডি ফিচার

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × 5 =