কেমন আছেন কিডনি ডোনার’রা

শরীফ তুহিন

কুমিল্লার রোকেয়া বেগম (৫৫) ২৫ মার্চ ২০২৪ সৌদি আরব গেছেন, স্বামী আর পুত্র রাশেলের সাথে ওমরা হজ্ব পালন করতে। তিনি গত বছর ২১ আগস্ট তার একটি কিডনি দান করেন বড় ছেলে মাহমুদুল হাসান রাশেল (৩০) কে। কিডনিদাতা মা ও কিডনিগ্রহীতা পুত্র রাশেল দুজনই এখন শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন।

সিলেটের নাজিম উদ্দিন পেশায় একজন রড মিস্ত্রি। ২০২৩’র ২২ আগস্ট তিনি একটি কিডনি দান করেন স্ত্রী শাহানা আক্তার রীমাকে। সম্প্রতি নাজিম উদ্দিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ছয় মাস বিশ্রাম শেষে আবার নিজের সেই কঠোর শারীরিক শ্রমের কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেছেন। স্বামী নাজিম উদ্দিন ও স্ত্রী রীমা দুজনই শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। গৃহিনী রীমার নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হলেও স্বামী নাজিম উদ্দিনকে কোনো ঔষধ সেবন করতে হয় না। ঢাকার ডেমরার ৬৫ বছর বয়সী নজরুল ইসলাম পুত্র মাসুমকে (৩০) কিডনি দান করেন ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। দুর্ভাগ্যবশত কিডনিগ্রহীতা পুত্র মাসুম অপারেশনের ৯ মাস পর লিভার জটিলতায় হাসপাতালে মারা যান। কিন্তু কিডনিদাতা বৃদ্ধ পিতা নজরুল ইসলাম এখন শারীরিকভাবে সুস্থ আছে।

একজন মানুষের শরীরে দুইটি কিডনি থাকে, তবে প্রাকৃতিক নিয়মে কিডনি কাজ করে একটি আর অন্য কিডনিটি রির্জাভ থাকে। কর্মরত কিডনির জটিলতা সৃষ্টি হলে অন্য কিডনি সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে। কিডনি বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেহে থাকা দুইটি কিডনির মধ্যে একটি কিডনি  দান করলে অবশিষ্ট কিডনিটি নিয়ে একজন মানুষ আজীবন সুস্থ সবলভাবে জীবনযাপন করতে পারেন।

দুই কোটি কিডনি রোগী, তিনশ চিকিৎসক

কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্স ইন্্সটিটিউট এর তথ্যানুসারে দেশে বর্তমানে দুই কোটির অধিক মানুষ কোনো না কোনো কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যক রোগীর জন্য নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক। দেশে মাত্র ৩০০ জন কিডনি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি বিকল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর ফলে মারা যাচ্ছেন প্রায় ৪ হাজার কিডনি রোগী। দুইটি কিডনি বিকল হয়ে গেলেই কিডনি রোগের নানা জটিলতা ও লক্ষণসমূহ ধরা পড়ে। তখন ডায়ালাইসিস কিংবা কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এ জন্য কিডনি রোগকে নিরব ঘাতক বলা হয়। কিডনি রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। চিকিৎসা ব্যয় বহনে অপারগ রোগীরাই বেশি মারা যাচ্ছেন।

কিডনি সংযোজন

৬৫ বছর পূর্বে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হলেও মানুষের ভয় ও সচেতনতার অভাবে এই কার্যক্রম ছিল হাতেগোনা। রক্তের গ্রুপ ম্যাচিং, টিস্যু টাইপ, কিডনি ম্যাচিংসহ নানা বিষয় পরীক্ষা ও বিবেচনা করার পর একজন মানুষ একটি কিডনি দান করার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচ্য হন। এই প্রক্রিয়া সর্বোনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছরও সময় লাগে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে ও রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগে এক পর্যায়ে তৃতীয় পক্ষ সৃষ্টি হয়। যারা রোগীদের সাথে ডোনারের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এই সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী রোগীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ডোনার সংগ্রহ করে। এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডোনাররা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয় বলে ইতিপূর্বে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এ অমানবিক বেচা-কেনা বন্ধ করতে ১৯৯৯ সালে জাতীয় সংসদে মানবদেহে অঙ্গ সংযোজন আইন পাস হয়। এ আইনের একটি ধারায় উল্লেখ করা হয় কিডনি রোগীর রক্তসম্পর্কিত নিকট আত্মীয়রাই শুধুমাত্র কিডনি ডোনেট বা দান করতে পারবেন। এরপর এই অবৈধ কিডনি বেচা-কেনা কমে আসলেও দেখা দেয় কিডনি ডোনার বা দাতার সংকট। ২০১৭ সালে এই আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা হয়। দেশের কিডনি রোগীদের জীবন বাঁচানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মহামান্য হাইকোর্ট আদেশ দেন, রক্তসম্পর্কিত ব্যক্তি ছাড়াও ইমোশনাল ডোনাররা কোনো রকমের আর্থিক লেনদেন ছাড়া কিডনি দান করতে পারবেন। এর ফলে স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে কিডনি দানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় কিডনি সংকট এখনও প্রকট। যে হারে কিডনি বিকল হচ্ছে সে মাত্রায় সংযোজন করা যাচ্ছে না বলে জানান কিডনি বিশেষজ্ঞরা।

মরণোত্তর কিডনি দান

১৯৯৯ সালের মানবদেহে অঙ্গ সংযোজন আইনের একটি ধারায় যেকোনো সুস্থ ব্যক্তি মৃত্যুর পর মরণোত্তর কিডনি দানের বিধান রাখা হয়। এর ফলশ্রুতিতে ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ বছর বয়সী সারাহ ইসলাম নামের চারুকলার ছাত্রী দেশে প্রথম মরণোত্তর কিডনি দান করেন। ব্রেন ড্যামেজে মৃত সারাহ’র দুইটি কিডনি দুইজন নারী কিডনি রোগীর দেহে সংযোজন করেন প্রফেসর হাবিবুর রহমান। এই কার্যক্রম সারাদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। কিডনি বিশেষজ্ঞদের মতে ব্রেন ড্যামেজ হয়ে যারা আইসিউতে মৃত্যুবরণ করেন তাদের কাছ থেকে কিডনি নিয়ে কিডনি রোগীর দেহে সংযোজন করা যায়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আইসিউতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে কিডনি নেওয়া গেলে কিডনি সংকট অনেকাংশে কমে আসতো বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট কিডনি সার্জন প্রফেসর কামরুল ইসলাম। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে ২০২৩ সালে দেশে ৬ হাজার ৫শ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে মারা গেছেন। এ সকল ব্যক্তিদের কাছ থেকে কিডনি নেওয়া গেলে কিডনি সংযোজনের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি করা যেত এবং অনেক মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হতো।

কিডনি ডোনার কার্ড

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় ও কিডনি ফাউন্ডেশনে মরণোত্তর কিডনি দাতাদের জন্য কিডনি ডোনার কার্ড চালু করা হয়েছে বলে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, এ হাসপাতালে ডেডিকেডেট টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে মরণোত্তর কিডনি সংযোজন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। যেকোনো ব্যক্তি নিজের পরিচয় ও বিস্তারিত ঠিকানাসহ সজ্ঞানে কিডনি ডোনার কার্ডে কিডনি দানের সম্মতি দিয়ে স্বাক্ষর করবেন এবং বিষয়টি পরিবারের সদস্যদেরকে জানিয়ে রাখবেন। কিডনি ডোনার কার্ডটি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে সংরক্ষিত থাকবে। ডোনারের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালের কিডনি বিভাগে ডোনারের সংবাদটি জানানোর সাথে সাথে হাসপাতালের কাউন্সিলিং টিম ডোনারের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলবেন এবং কিডনি সংযোজন টিম মৃত্যুর ৬ ঘণ্টার মধ্যে কিডনিগ্রহীতা রোগীর দেহে সংযোজনের ব্যবস্থা করবেন। কিডনি বিশেষজ্ঞদের মতে কেবলমাত্র আইসিউতে ব্রেন ড্যামেজে মৃত ব্যক্তির শরীরে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কিডনি সচল থাকে। কিডনি ডোনার কার্ডের উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ডোনার পরিবারের সদস্যরা আজীবন বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা পাবেন চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালে। কিডনি ডোনার কার্ডের বিষয়টি ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। মানবিক বিবেচনা ও সচেতনতাই হাজার হাজার মৃত্যু পথযাত্রী মানুষকে বাঁচাতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 + nineteen =