গ্যাস বিদ্যুৎ সঙ্কটের দায়দায়িত্ব নীতি নির্ধারকদের

সালেক সুফী

বাংলাদেশে বিরাজমান তীব্র গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটের জন্য দায়ী সরকারের ভুল  জ্বালানি বিদ্যুৎ নীতি, ভ্রান্ত ব্যাবস্থাপনা। প্রশ্ন করলেও বিশ্বাসযোগ্য উত্তর মিলবে না ২৯,০০০ মেগাওয়াটের অধিক বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও কেন ১৬০০০ মেগাওয়াট চাহিদা মেটাতে পারছে না সরকার? ঢাকা মহানগরীতে বসে কিছু মানুষ হয়তো স্বস্তিতে আছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে শহরাঞ্চল, গ্রাম-গঞ্জে ৫-৬ ঘন্টা লোড শেড্ডিং, শিল্পগুলো ভুগছে মারাত্মক বিদু্যত্‌ জ্বালানি সংকটে, দেশের অধিকাংশ সার কারখানা বন্ধ, অনেক ক্ষুদ্র, মাঝারী শিল্প কারখানা বন্ধ হবার উপক্রম। জ্বালানী বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম।

সরকারি পলিসিমেকারসরা অজুহাত দিবে করোনা মহামারীর, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ আরো কত কি। এই গ্রীষ্ম কালে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করে ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ চাহিদা ১৬০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। দুই একদিন পিক চাহিদার সময় দুই একঘন্টা বাংলাদেশ ১৬৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হলেও দৈনিক উৎপাদন ১৪৫০০-১৫০০০ মেগাওয়াট সীমিত রয়েছে। মূল কারণ প্রাথমিক জ্বালানি সংকট, গ্যাস সরবরাহ সংকট, কয়লা, এলএনজি, তরল জ্বালানি আমদানি সক্ষমতার অভাব। সবাই জানে সরকারের ভুল পরিকল্পনার কারণে মূল্যবান কয়লা সম্পদ মাটির নীচে পড়ে আছে, জলে স্থলে গ্যাস অনুসদ্ধান উন্নয়নে ধীরগতি। নির্ভরযোগ্য ঝুঁকি ব্যাবস্থাপনা না করেই দেশীয় জ্বালানী সম্পদ উপেক্ষা করে আমদানিকৃত জ্বালানীর দিকে হাত বাড়িয়েছে। ১৫ বছরের অধিক চতুর্থ টার্মে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকার উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য একান্তভাবে দায়ী, সেই ২০১০ থেকে জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ এক্ট নামের আড়ালে একটি জবাবদিহী বিহীন আইন চালু আছে। এর আড়ালে প্রতিযোগিতা বিহীনভাবে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলে সরকার ঘনিষ্ট কিছু মহলকে হাজার কোটি টাকা আয়ের সুযোগ দেয়া হয়েছে।  অনুসদ্ধান করা হয়নি গ্যাস সম্পদ, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি কয়লা উত্তোলন করে কাজে লাগানোর। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু ১০ বছরের অধিক সময় ধরে সরকারকে বর্তমান পরিস্থিতি ঘটার সম্ভাবনা নিয়ে সতর্ক করে আসছে।  কিছু উপদেষ্টা, পরামর্শকদের প্রভাবে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত সময়মত নিতে ব্যার্থ হয়ে বর্তমান সংকট সৃষ্টি করেছে। বৈষয়িক সংকট সকল দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করেছে। অধিকাংশ দেশ সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠেছে।  বাংলাদেশ পারেনি, কখন কাটিয়ে উঠবে এখনো অনুমান করা যাচ্ছে না।

এখন যে সরকার ১০০ গ্যাস কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে, সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র আহবান করেছে ৫-৭ বছর আগে কেন করেনি? মনে আছে ২০১৯ ঢাকায় কনফারেন্স অফ নন রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (কোন ) আয়োজনে জ্বালানি উপদেষ্টাকে কয়লা উত্তোলন এবং সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলাম। তখন কিন্তু কভিড শুরু হয়নি। বর্তমান সরকার ২০০৯ থেকে একাধারে চতুর্থ টার্ম রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছে। ২০১০ থেকে কয়লা উত্তোলন, গ্যাস অনুসদ্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বর্তমান সংকট সৃষ্টি হত না। আজ আমদানী নির্ভর বিদ্যুৎ খাতে বিপর্যয় সৃষ্টি হতো  না।

এই সরকারের জ্বালানি ব্যাবস্থাপনায় জ্বালানী উপদেষ্টা দীর্ঘ সময় সংযুক্ত আছেন। অথচ কয়লা মাটির নিচে পরে রয়েছে, গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি ভয়াবহ।  সবাই জানে বাংলাদেশকে এলএনজি আমদানী বাড়াতে হবে। কিন্তু মাতারবাড়িতে ল্যান্ড বেসড এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, ভোলায় আবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদ জাতীয় গ্যাস গ্রীডে সংযুক্ত হচ্ছে না। সাগরের গ্যাস সম্পদ আহরণ করে কাজে লাগাতে ৮-১০ বছর সময় লাগবে। ভাবতে অবাক লাগে ২০০০ বাংলাদেশ থেকে গ্যাস আমদানীর জন্য ভারত সরকার প্রস্তুত ছিল, সেই ভারতের কিছু প্রতিষ্ঠান এলএনজি আমদানী করে বাংলাদেশে রপ্তানী করার উদ্যোগ নিয়েছে, ভারতের আদানী গ্রুপ কয়লা আমদানী করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানী করছে, ভারতের একটি তেল শোধনাগার বাংলাদেশে পাইপ লাইনে তরল জ্বালানী রপ্তানী করছে।

প্রশ্ন তুললেই সরকার ঘনিষ্ট মানুষগুলো ২০০১-২০০৬ বিএনপি জামাত সরকারের আমলের জ্বালানী বিদ্যুৎ সংকটের কথা বলে ১৫-১৬ বছর পরে সার্বিক জ্বালানি বিদ্যুৎ বাবস্থাপনা কি ২০০৯ -২০১০ থেকে খুব উন্নত হয়েছে ? অনেকে বলবেন প্রাচুর্যের অভিশাপ। সম্পূর্ণভাবে দায়ী সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সচিবরা। সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে সঠিক সময়ে ঠিক কাজটি না করা। ফলে কাটচ্ছে না বিদু্যত সংকট, প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে গ্যাস সরবরাহ সংকট। সর্বপরি পুরো খাতের আর্থিক দায় এখন দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সংকট।

 

সালেক সূফি, জ্বালানি খাত বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − 13 =