চিয়া বীজের আরেক নাম পাওয়ার হাউস

হাসান নীল

আজকাল মানুষজন মুখরোচকের চেয়ে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারে আগ্রহী। কেননা আগের চেয়ে স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন এখন সবাই। করোনা মহামারির পর তা যেন আরও বেড়েছে। ফলে খাবার টেবিলে দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী খাবার। এগুলোর একটি চিয়া সিড বা বীজ একটি। যাকে পুষ্টির ভান্ডারও বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম সালভিয়া হিস্পানিকা। এটি সপুষ্পক উদ্ভিদ।

খ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে তিন হাজার বছর আগে চিয়া বীজের প্রতি মানুষের নজর বাড়লেও এর প্রচলন কিন্তু অনেক আগে থেকে। সে গল্প বলতে গেলে যেতে হবে যীশু খ্রিষ্টের জন্মেরও সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। মেক্সিকোর অ্যাজটেক এবং মায়ান সভ্যতা চলাকালীন সময় মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকায় চিয়া সিডের ব্যবহার চলত। মূলত সেসময় থেকেই এর প্রচলন। বেশ গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করা হতো চিয়া বীজকে। ডাকা হতো ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে। অ্যাজটকরা সাধারণত চিয়া বীজের আটা দিয়ে রুটি বানিয়ে খেত। তবে অ্যাজটক যোদ্ধাদের কাছে এর গুরুত্ব ছিল আরও বেশি। পুষ্টির ভান্ডার বলে মনে করত তারা। সরাসরি খেতো বীজগুলো। মেক্সিকোতে তারাহুমারা বলে এক উপজাতি আছে। এরা দৌড়বিদ হিসেবে বিখ্যাত। এই বীজের সঙ্গে লেবু মেশানো শরবত খেলে শত মাইল দৌড়ানো যায় বলে বিশ্বাস তাদের। স্প্যানিশরা তো অ্যাজটকদের থামাতে চিয়া সিড নিষিদ্ধ করেছিল। শয়তানের উৎস ধ্বংসের অজুহাতে এর চাষবাস বন্ধ করিয়েছিল তারা।

বাণিজ্যিকীকরণ

একবিংশ শতাব্দী থেকে বেশ কয়েকটি দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে চিয়া বীজ। এরমধ্যে মেক্সিকো ও গোয়াতেমালার কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসার উদ্দেশ্যে চাষ করা এবং খাওয়া হচ্ছে এই বীজ।

ইউরোপে চিয়া বীজ

খ্রিষ্টের জন্মের আগে থেকে চিয়া বীজ সমাদৃত হলেও ইউরোপে এর আগমন অনেক পরে। সেইসঙ্গে সেখানে এর খাবার পদ্ধতিও ছিল অভিনব। ১৯৯৭ সালের আগে ইউরোপে চিয়া বীজ খাওয়ার কথা তেমন শোনা যায় না। দেশটিতে চিয়া বীজ খাওয়ার ওপর নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সে নিয়ম অনুযায়ী রুটিতে চিয়া বীজ থাকতে পারবে না। একইসঙ্গে নির্দেশনা দেওয়া ছিল প্রতিদিন ২ গ্রামের বেশি চিয়ার তেল খাওয়া যাবে না। এমন অভিনবভাবে চিয়া সেবনের ইতিহাস কোথাও নেই। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলো থেকে ইউরোপে আমদানি করা হতো চিয়া বীজ।

চিয়া বীজ

চিয়া বীজ একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এটি উচ্চতায় ৩ ফিট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর পাতাগুলো চুন সবুজ রঙের। আর ফুলগুলো নীল বেগুনি ও সাদা রঙের হয়ে থাকে। এটি মধ্য ও দক্ষিণ মেক্সিকোতে চাষ হয়। এটি মরুভূমির উদ্ভিদ। বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে। অল্প বিস্তর সেচ দিলে আশাতীত ফল পাওয়া যায়। পোকামাকড় রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী অবদান রাখে। এই বীজের আকার ডিমের মতো। এর গায়ে কালো সাদা ও ধূসর দাগ থাকে। চিয়া বীজ সাধারণত দুই ধরনের হয়। এর একটি কালো চিয়া বীজ। অন্যটি সাদা। কালো চিয়া বীজ আসে মূলত বেগুনি ফুল উৎপাদনকারী চিয়া গাছ থেকে। বীজগুলোর রঙ বেগুনি হলেও একে ডাকা হয় কালো চিয়া বীজ বলে।

বাংলাদেশে চিয়া চাষ

বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চিয়া চাষের সময় শীতকাল। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে। তবে নভেম্বরের মধ্যে চাষ করাই শ্রেয়। এর ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে ৯০-১০০ দিন।

যে মাটিতে চিয়া হয়

সব রকম মাটিতেই চিয়া বীজ চাষ করা যায়। তবে কাদা মাটি বা বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো ফলন হয়। এছাড়া উর্বর ভালোভাবে নিষ্কাশিত মাটিতে ফলে থাকে। তেমনইভাবে এসিডযুক্ত বা ক্ষার মাটিতেও এর উৎপাদন ব্যাহত হয় না।

উপকারিতা

চিয়া সিডের উপকারিতা ও অপকারিতা দুইই আছে। পুষ্টিবিদদের মতে চিয়া সিডে আছে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর উপাদান ওমেগা ৩। যার ফলে চিয়া সিড সেবনকারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি কম থাকে। ক্ষতিকর কোলেস্টরেল দূর করতেও বেশ ভূমিকা রাখে এটি। এতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এ কারণে সেবনকারীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। এটি মেটাবলিক সিস্টেম উন্নত করে ফলে ওজন কমিয়ে মেদমুক্ত হতেও সহায়তা করে। আজকাল কোলন ক্যান্সার খুব পরিচিত নাম। এই রোগের ঝুঁকি কমানোর মতো ক্ষমতাও রাখে চিয়া সিড। এটি নিয়মিত কোলন পরিষ্কার রাখে। এছাড়া ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এবং অ্যাসিডিটির সমস্যা সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চিয়া বীজ। এই বীজ দুধ বা পানিতে ভিজিয়ে খেলেও উপকারে আসে। পাশাপাশি পুডিংয়ের সঙ্গেও খাওয়া যায়।

অপকারিতা

উপকারিতা আছে বলেই অতিরিক্ত চিয়া বীজ খাওয়া মোটেই উচিত নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রোস্টেট ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার বাড়িয়ে তুলতে পারে চিয়া বীজ। আর তাই জেনে বুঝে সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া মাত্রাতিরিক্তভাবে সেবন করলে পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিয়া বীজ ওজন কমানোয় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে ডায়েটে এটি বেশ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তবে মোটেই অতিরিক্ত গ্রহণ করা উচিত নয়। মাত্রাতিরিক্ত চিয়া বিজ খাওয়ায় ওজন মাত্রাতিরিক্ত কমে যেতে পারে যা স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এতে করে নানা সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

সেবনের নিয়ম

অনেকেই জানেন না কিভাবে খেতে হয় চিয়া বীজ। বিভিন্নভাবে এই সিড খাওয়া যায়। তবে খুব সহজ উপায় হলো পানিতে ভিজিয়ে খাওয়া। এক্ষেত্রে কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে খাওয়া ভালো। প্রথমে হালকা কুসুম গরম পানিতে চিয়া সিড ২০ থেকে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর খালি পেটে খেতে হয়। রোজ সকালে কিংবা ঘুমানোর আগে এভাবে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া চাইলে ওটস, পুডিং, জুস ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি রান্না করা সবজি বা সালাদের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে খাওয়া যায়।

পুষ্টিগুণ

পুষ্টিকর খাবার বলতে আমরা দুধ ডিম মাছ মাংস সবজি বুঝে থাকি। তবে এসবের চেয়েও বেশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই চিয়া সিড। দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম থাকে এতে। কমলার চেয়ে সাত গুণ বেশি ভিটামিন সি আছে এই বীজে। অন্যদিকে পালং শাকের চেয়ে তিন গুণ আয়রন এবং কলার চেয়ে দ্বিগুণ থাকে পটাশিয়াম। ডিমের চেয়ে ৩ গুণ প্রোটিন থাকে চিয়া সিডে। স্যামন মাছের চেয়ে ৮ গুণ বেশি ওমেগা ৩ পাওয়া যায় এতে। সেকারণেই আপনার খাদ্য তালিকায় সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন চিয়া সিড রাখতে পারেন।

পাওয়ার হাউস

চিয়া বীজকে পাওয়ার হাউস বলা হয়। কেননা এতে রয়েছে পুষ্টির সমাহার। ফাইবার, প্রোটিন, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও খনিজ পুষ্টিতে ভরপুর। আমরা দৈনিক যে পুষ্টি গ্রহণ করি দুই টেবিল চামচ চিয়া বীজ থেকে সমপরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায়।

হাড়ের বন্ধু

হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায়ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে চিয়া বীজ। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজ; যা হাড় শক্তিশালী করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া অস্টিওপরোসিস এবং ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি কমায় এই চিয়া বীজ। আমাদের দেহে প্রয়োজনীয় খনিজের চাহিদা পূরণে এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এটি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve + 7 =