ভারতীর চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর। তিনি ঠাকুর বাড়ির মেয়ে, পাতৌদির নবাব পরিবারের বধূ। তার অভিনয়গুণ ও ব্যক্তিত্ব তাকে বসিয়েছে সিনেমা জগতের রানীর সিংহাসনে। জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। চিরসবুজ নায়িকাকে রঙবেরঙের শ্রদ্ধা।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম
শর্মিলা ঠাকুরের জন্ম ১৯৪৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ভারতের হায়দ্রাবাদে। বাবা গীতিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সন্তান, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধর এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়। মা ইরা বড়ুয়া ছিলেন আসামের বিখ্যাত লেখক জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়ার কন্যা। শর্মিলা ঠাকুরের প্রসঙ্গ এলে রবীন্দ্রনাথের নামটি চলে আসে। কবির ‘ঠাকুর’ পদবিটা নিয়ে তার নিজেরও গর্ব ছিল। শর্মিলার ভাষায়, ‘এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করাটাও আমার জন্য অনেক সম্মানের। আমার জন্মের বছর তিনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান। তাই তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ না হলেও, মায়ের মুখে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি।’ এক সাক্ষাৎকারে শর্মিলা ঠাকুর এমনটাও বলেছেন, কবিগুরুর প্রভাব আছে তার ওপর। ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া বাংলা ছবি ‘দেবী’ তার প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘দেবী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় তৈরি। মূল বিষয় একই। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘দেবী’ মূলত রবীন্দ্রনাথের লেখনি ও তার সাহিত্যের নারী চরিত্রের সঙ্গে বেশ মিলে গেছে।
সত্যজিতের সিনেমা দিয়ে শুরু
শর্মিলা ঠাকুর লেখাপড়া করেন ইংরেজি মাধ্যমে। ডায়োসেসান এবং লরেটোর ছাত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন তিনি। ছবিতে তার অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল অপর্ণা। নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সুন্দরী ও সুঅভিনেত্রী শর্মিলা এক ছবিতেই দর্শকদের মন জয় করে নেন, প্রশংসা পান সমালোচকদেরও।
১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ‘দেবী’। সত্যজিৎ রায়ের এ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। দয়াময়ী চরিত্রের মানসিক টানাপোড়েন, অতিপ্রাকৃত প্রভাবের সংকট সার্থকভাবে পর্দায় তুলে ধরে সমালোচকদের বিপুল প্রশংসা পান।
যত সিনেমা
১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় শর্মিলা ঠাকুরের তিনটি ছবি। ‘শেষ অঙ্ক’ ছবিতে উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। তপন সিংহ পরিচালিত ‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতেও তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। দুটি ছবিই বাণিজ্যিক সফলতা পায়। ‘ছায়া সূর্য’ ছবিতে ঘেঁটু নামে এক ভাগ্যবিড়ম্বিত তরুণীর চরিত্রে তার অভিনয় ছিল অনবদ্য। যদিও শিল্পধারার ছবি বলে সেটি বাণিজ্যিক সফলতা পায়নি। ১৯৬৪ সালে পরিচালক শক্তি সামন্তর ‘কাশ্মির কি কলি’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি প্রবেশ করেন হিন্দি ছবির জগতে। বুদ্ধিদীপ্ত সৌন্দর্যের সুবাদে তিনি রাতারাতি তারকা হয়ে যান। একের পর এক মুক্তি পায় ‘ওয়াক্ত’, ‘অনুপমা’, ‘দেবর’ ‘শাওয়ান কি ঘাটা’। সবগুলোই বাণিজ্যিকভাবে সফল। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’। উত্তম কুমারের বিপরীতে অদিতি নামে এক সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেন শর্মিলা ঠাকুর। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’। শক্তি সামন্ত পরিচালিত এ ছবিতে বিকিনি পরে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দেন তিনি। সে সময় শর্মিলা ঠাকুর মানেই ছবির বাণিজ্যিক সফলতা ছিল নিশ্চিত। ‘আমনে সামনে’, ‘মেরে হামদাম মেরে দোস্ত’, ‘হামসায়া’, ‘সত্যকাম’, ‘তালাশ’ – সব কটি ছবিই সফল।
তবে সব সাফল্য ছাড়িয়ে যায় ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সুপার-ডুপার হিট ‘আরাধনা’। বাংলা-হিন্দি দুই ভাষাতে মুক্তি পাওয়া ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হয়। আর এ ছবির সুবাদে ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার ঘরে তোলেন তিনি। এ ছবিতে নায়ক ছিলেন রাজেশ খান্না। এ ছবির মাধ্যমে রাজেশ-শর্মিলা জুটির জয়যাত্রা শুরু হয়। বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দিতে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছবিতে ছিলেন দারুণ সফল। রাজেশ খান্নার বিপরীতে ‘সফর’, ‘অমর প্রেম’, ‘রাজারানি’, ‘দাগ’; শশী কাপুরের বিপরীতে ‘আ গালে লাগ যা’, দিলিপ কুমারের বিপরীতে ‘দাস্তান’ দারুণ ব্যবসাসফল হয়। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় গুলজার পরিচালিত ‘মওসাম’। এ ছবিতে মা ও মেয়ের দ্বৈত ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করেন শর্মিলা। এ ছবিতে তার বিপরীতে নায়ক ছিলেন সঞ্জীব কুমার। এ ছবির সুবাদে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শর্মিলা ঠাকুর। বাংলা ছবি ‘ছদ্মবেশী’র হিন্দি রিমেইক ‘চুপকে চুপকে’তে ধর্মেন্দ্রর বিপরীতে দারুণ কমেডি উপহার দেন তিনি। অন্যদিকে অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে রোমান্টিক থ্রিলার ‘ফারার’ ছবিতেও তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। ১৯৭৭ সালে শক্তি সামন্ত নির্মাণ করেন ‘অমানুষ’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ নামে দুটি দ্বিভাষিক ছবি। দুটি ছবিতেই প্রধান চরিত্রে ছিলেন উত্তম কুমার ও শর্মিলা ঠাকুর। দুটি ছবিই বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘গেহরি চোট’ (‘দূরদেশ’) মুক্তি পায় ১৯৮৩ সালে। এ ছবিতে শর্মিলা-শশী কাপুর জুটি অভিনয় করেছিলেন। বাংলাদেশেও ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। শর্মিলা ঠাকুর পরবর্তীতে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে চলচ্চিত্রে তার স্থান ধরে রাখেন। ‘মন’, ‘ধাড়কান’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে তিনি অভিনয় করেন। ২০০৩ সালে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘আবার অরণ্যে’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। ছবিটি ছিল সত্যজিতের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিটির সিকুয়াল।
পরিবার
১৯৬৯ সালে ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক মনসুর আলি খান পাতৌদি ও শর্মিলা ঠাকুর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। সে সময় অনেকেই মন্তব্য করেন যে, এ বিয়ে টিকবে না। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বলিউডের সুখী দম্পতির তকমা গায়ে জড়ান তারা। পাতৌদির নবাব পরিবারের বধূ হিসেবে শর্মিলা ছিলেন আদর্শ। বিয়ের জন্য ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হতে হয় তাকে। নাম গ্রহণ করেন বেগম আয়শা সুলতানা। এই দম্পতির তিন সন্তান। ছেলে সাইফ আলি খান বলিউডের প্রতিষ্ঠিত নায়ক। মেয়ে সোহা আলি খানও অভিনেত্রী। আরেক মেয়ে সাবাহ আলি খান জুয়েলারি ডিজাইনার। শর্মিলার পুত্রবধূ কারিনা কাপুর ও জামাতা কুনাল খেমু। বিয়ের পরও শর্মিলার ক্যারিয়ারে ভাটা পড়েনি। ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিতে অপর্ণা চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭১ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতেও কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে ছিলেন তিনি। শর্মিলা ঠাকুরের আরও দুজন বোন ছিলেন – ঐন্দ্রিলা ও রমিলা। শর্মিলার আগে বোন ঐন্দ্রিলা ঠাকুর টিংকু প্রথম শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়জগতে আসেন। ১৯৫৬ সালে তপন সিনহার ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমার মুখ্য চরিত্র ‘মিনি’ হিসেবে দেখা যায় তাকে।
প্রথা ভেঙে বিকিনি পরা
নিজেকে ভাঙতে ভালোবাসতেন শর্মিলা। তাই তো শাড়ি ছেড়ে প্রথা ভেঙে বিকিনি পরেও সাবলীল ছিলেন ক্যামেরার সামনে। যা কেউ ভাবতেও পারেননি, তিনি তা করেছিলেন অবলীলায়। ১৯৬৭ সালে শক্তি সামন্তের ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’ সিনেমায় বিকিনি পরে তার পর্দায় আবির্ভাব রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেয় সারা দেশে। রক্ষণশীল মানুষ নিন্দা করলেও, লাস্য ভঙ্গিমায় তার অভিনয় বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। সেই বছরই ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও এই বেশে দেখা যায় তাকে। সে সময় আলোচিত এক ফটোশুটে দেখা যায়, বিকিনি পরে নীল সমুদ্রের ওপর দিয়ে স্কি করছেন নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
শর্মিলা ঠাকুর দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন; প্রথমবার মৌসম (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে এবং দ্বিতীয়বার আবার অরণ্যে (২০০৩) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেত্রী বিভাগে। এছাড়া তিনি আরাধনা (১৯৬৯) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। শর্মিলা ঠাকুর ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মভূষণ লাভ করেন। ভারতের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। বর্তমানে ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সালে স্বামী মনসুর আলি খান পাতৌদির মৃত্যুর পর তার স্মৃতি রক্ষার্থে সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজ করছেন তিনি।
শেষ কথা
চিরসবুজ এই নায়িকাকে কখনো ভোলা সম্ভব নয়। তার কাজই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আরও দীর্ঘজীবী হন শর্মিলা ঠাকুর। ভারতীয় চলচ্চিত্রে তিনি যেন এক বটবৃক্ষ। বাংলার মানুষের কাছে এক আবেগের নাম। এ আবেগ বেঁচে থাক বহুকাল।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি