জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি ও টেকসই পুষ্টি

. ইখতিয়ার উদ্দিন

জলবায়ু সদা পরিবর্তনশীল।আমাদের জলবায়ু প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। ২০–৩০ বছরে পরিবর্তন হয়।  এই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো মোকাবিলা করে কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানোর পদ্ধতিকে বলে  জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি। জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করা হয়। বিশেষ করে আমাদের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি খুব জরুরি। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা ও খাদ্যনিরাপত্তার উন্নয়ন নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি অনুকূল পরিবেশ, অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সাম্যতা অর্জনেও সহায়তা করে থাকে।

আমরা এমন ভৌগোলিক অবস্থানে জন্মেছি বা বসবাস করছি, যেটি বিভিন্ন দিক থেকে আশীর্বাদপুষ্ট হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে আমরা অভিশপ্ত। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের আশীর্বাদই বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খাপ খাওয়ানোর জন্য অনেক কাজ করেছে এবং করছে । বিশেষ করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নানা ধরনের কাজ হচ্ছে। এশিয়া মহাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে এক নম্বর বিবেচনা করা হয়। এটা কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের অবদান। অবশ্য সরকার নীতিমালা করছে, অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে এবং বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা বা কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে। এটা প্রমাণ করে  যে এ ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আমাদের সরকার কতখানি সক্রিয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে এবং প্রতিটি কর্মসূচিতে সেটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা কৃষি হোক সব জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুকে ফোকাস করতে সকলকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন  আমাদের মতো ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিশাল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী, গ্রামীণ ও দরিদ্র মানুষের জীবনব্যবস্থা ও সাম্যতাকে বেশ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং ভঙ্গুর জনগণের আর্থিক উপার্জন বাড়াতেও সাহায্য করে। এরই পাশাপাশি জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি জলবায়ুজনিত ভঙ্গুরতা দূর করতে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর টেকসই জীবনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষির চর্চা বৃদ্ধি করা হচ্ছে । এটি পুষ্টিকে কীভাবে সহায়তা করে, পুষ্টিনিরাপত্তায় কীভাবে অংশ নেয়, সেটি জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে ।  এই জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত সার, বীজ, কীটনাশক দরকার । এগুলোর মূল সরবরাহকারী হচ্ছে বেসরকারি খাত। তবে আশার কথা হলো সরকারি-বেসরকারি সকলের সমন্বিত উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তন  ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলো জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি আয়ত্ত করেছে। তারা নিজেরাই এখন এর চাষাবাদ করছে। তাদের দেখাদেখি ধীরে ধীরে আশপাশের মানুষও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন  ঝুঁকিতে থাকা কৃষির সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোর কাছে  এ সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পুষ্টির চাহিদা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি তথ্যও। নতুন বীজ কখন আসছে, বাজারজাতকরণ কীভাবে হবে সে তথ্য পৌঁছে দিতে হবে কৃষকদের কাছে। তাঁরা যেন সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য পান সেটা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকল কতৃপক্ষই এখন সচেষ্ট।

কৃষকদের কাছে প্রয়োজনীয় কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ কৃষকদের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করছে, যার ফলে কৃষক কোন সময়ে কোন ধরনের ফসল উৎপাদন করতে হয়, ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য কী ধরনের উপকরণের প্রয়োজন হয়, সেসব বিষয়ে জানতে পারছে। এর পাশাপাশি ফসল উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানগুলোও মাঠপর্যায়ের সহযোগিতা পাচ্ছে।

পুষ্টি একক কোনো কাঠামো নয়। এটি একটি বহুমুখী বিষয়। আসলে খাদ্য ছাড়া পুষ্টি সম্ভব নয়। খাদ্য আর কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পুষ্টির পাশাপাশি নিরাপদ কৃষির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা দরকার। আবার খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্য সরবরাহ সম্ভব নয়। খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে দুর্যোগ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন  সরাসরি সম্পৃক্ত। খাদ্যের উৎপাদন যদি সহনশীল না হয়, তাহলে সামঞ্জস্য থাকবে না। আবার শুধু খাদ্য পেলে হবে না, এর দামও আয়ত্তের মধ্যে থাকতে হবে। বাংলাদেশে  খাদ্যের প্রায় শতভাগই আসে কৃষি থেকে। কৃষি যদি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারে, তাহলে খাদ্য উৎপাদনের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। পুষ্টিকে মাথায় রেখে কৃষিকে জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য বিশেষ কর্মসূচি রয়েছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে  বিদ্যালয় পর্যায় থেকে কাজ শুরু হয়েছে । সেখান থেকে তা গ্রাম পর্যায়ে এবং শেষে পারিবারিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি কমিউনিটি আন্দোলন তৈরি করা হচ্ছে । কোন সবজি কেন দরকার, তা বোঝানো দরকার স্কুল পর্যায় থেকে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে সে কাজগুলোই করা হচ্ছে। গ্রামপর্যায়ে নারী-পুরুষেরা বাগানগুলো তৈরি করছে । এগুলো কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে, তা চেষ্টা করছে । আমরা জানি উত্তরবঙ্গে আবহাওয়া খুবই দুর্যোগপ্রবণ।  শীতের কুয়াশা হঠাৎ বন্যা, এমন কোনো দুর্যোগ নেই যে উত্তরবঙ্গে নেই। কিন্তু সে আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে  সুন্দর সুন্দর শাক-সবজি,ফলমুলের বাগান তৈরি করেছে মা-বাবারা। সেটি আমাদের পুষ্টি ঠিক করবে। এই শিক্ষা, এই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান, এই অর্জন কীভাবে জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সে বিষয়ে কাজ করছে সরকার। পুষ্টি তো একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। পুষ্টির ফলাফল এক দিনে পাওয়া যায় না। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার সংকট নেই। তবে পুষ্টিনিরাপত্তায় ঘাটতি আছে । সরকার পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।  ধান উৎপাদনে আমরা স্বনির্ভর,কিন্তু  ভাতের ওপর আমাদের নির্ভরতা দিন দিন কমছে। তাই পুষ্টিকর খাবারের বিষয় বিবেচনা করে দরিদ্র জনগণের জন্য পুষ্টি নিশ্চিতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। দরিদ্র জনগণের  পুষ্টি নিশ্চিত করা না গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে না। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এগিয়ে আছে।

সরকারি-বেসরকারি কিছু প্রকল্প আছে যেগুলো সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত। পতিত জমিতে পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্প এমন একটি প্রকল্প। এটি কৃষকবান্ধব টেকসই  প্রকল্প ।  এখানে কৃষক  খুব সহজে প্রযুক্তি পাচ্ছে। তাঁরা চাইলে উঠানে আবাদ করতে পারছে, যা আগে পতিত পড়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে কোনো পতিত জমি যেন না থাকে ,সব জমি যাতে চাষাবাদের আওতায় আনা হয় সে বিষয়ে সকলকে আহ্বান জানিয়েছেন। যেকোনো ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্র বীজ একটি বড়ো ফ্যাক্টর। সে জাতগুলোর কোনোটা লবণাক্ত সহিষ্ণু হতে পারে, কোনোটা খরা সহিষ্ণু হতে পারে, কোনোটা বন্যা সহিষ্ণু হতে পারে। এই জাতগুলো নিয়ে আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা কাজ করছেন। এটা যদি পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে, তাহলে কৃষিকে উন্নত ও সমৃদ্ধ  করা সম্ভব হবে এবং পাশাপাশি পুষ্টির  নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশে বীজের বড়ো প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিএডিসি। বিএডিসি চাহিদার  ২৫ শতাংশ বীজ সরবারহ করতে পারে। তবে বিএডিসির কৃষককে প্রতিটি ফসলের ক্ষেত্রে বীজ সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বীজ বিতরণ নিয়ে কয়েকটি প্রকল্প আছে। এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে কৃষক কীভাবে বীজ উৎপাদন , সংরক্ষণ,  বিতরণ করবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ।

জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি , টেকসই পুষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে  বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম একটি সহনশীল ও উন্নত দেশে রূপান্তর করা সম্ভব । এ জন্য চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগ হিসেবে দেখে সুবিধায় পরিণত করতে সংশ্লিষ্ঠ সকলকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে।এর মাধ্যমে নিশ্চিত হবে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত আমাদের মাতৃভূমি।

লেখক :গবেষক ও শিক্ষাবিদ

পিআইডি ফিচার

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen + 4 =