জাতীয় জাদুঘরে এক বিকেল

মাসুম আওয়াল

সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রূপালি নরম আলো নিয়ে সূর্যটা খেলা করছে জাদুঘরের চার পাশের বড় গাছগুলোর পাতার সঙ্গে। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্য উপভোগ করে নিলাম আমরা। সামনেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ছবির হাট। ঢাকা শহরের এ এলাকায় সবুজের আধিক্য। সময় পেলে বন্ধুরা মিলে ঘুরে বেড়াই এখানে। পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে বসে জমিয়ে আড্ডাবাজি চলে। অনেক সময় আমরা দেখি লাইন দিয়ে শত শত মানুষ জাতীয় জাদুঘরে প্রবেশ করছে। আমাদের মধ্যে এক বন্ধু বলে ওঠে, ‘আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতে আসি এখানে, কিন্তু জাদুঘরে ঢুকলাম না কোনোদিন। ঠিক যেন সমুদ্রের দেশে থেকে সমুদ্র না দেখার মতো।’ আমি বললাম, ‘চল না ঢুকে পড়ি আজই! দেখে আসি কী আছে আমাদের জাতীয় জাদুঘরে।’ এক কথায় রাজি হয়ে গেলো সবাই। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটলাম। তারপর নতুন এক অভিজ্ঞতা হলো আমাদের।

সকলেই অভিভূত

টিকিট নিয়ে প্রবেশ দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। নিরাপত্তা চেকিং শেষে জাদুঘরের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকে যাওয়ার পালা। জাদুঘরের মূল ভবনের সামনে মনোরম ফুলের বাগান ও ঝরনা। নানা রকম ফুল ফুটে আছে সেখানে।

এক টুকরো বাংলাদেশ

জাদুঘরের মূল ভবনে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে প্রথম যে কক্ষটি আছে সেখানে আছে বাংলাদেশের বিরাট এক মানচিত্র। মানচিত্রের সামনে দেওয়া আছে অনেকগুলো সুইচ। এ এক মজার খেলা। একেকটি সুইচে চাপ দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলকে চিহ্নিত করা যায়। একটি সুইচে চাপ দিতেই মানচিত্রের মাঝামাঝি একটি জায়গায় হলুদ বাতি জ্বলে উঠল। এটিই ঢাকা জেলা। এরপর মানচিত্র রুমের ডান পাশ থেকে শুরু করলাম গ্যালারি পরিদর্শন। একের পর এক গ্যালারিতে সাজানো বাংলাদেশের বিভিন্ন ফুল, ফল, পাখি, পশু, নৌকা, মাছ, গাছ, খাদ্যশস্য প্রভৃতির নমুনা। দেখে পুরো বাংলাদেশের প্রকৃতির একটি চিত্র ফুটে উঠল। একটি গ্যালারির পুরোটা জুড়ে সাজানো সুন্দরবনের প্রাকৃতিক দৃশ্যের নমুনা। দেখে মনে হলো আমরা যেন সত্যিই সেখানে পৌঁছে গেছি।

বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির পরিচয়

একের পর এক গ্যালারি দেখতে থাকলাম আমরা। অন্যান্য গ্যালারিতে সাজানো সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, মনিপুরি, গারোদের তৈরি পোশাক, অলংকার ও গৃহস্থালী সামগ্রীর সংগ্রহ। দেখে মনে পড়ে গেল পাঠ্যবইয়ে পড়া নৃগোষ্ঠীদের পরিশ্রমী জীবনের কথা। আরও দেখলাম মাটি, সিরামিক ও কাঁচের তৈরি জিনিস। জামদানি, নকশি কাঁথা, হাত পাখা ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ। প্রাচীনকালের মানুষদের ব্যবহৃত পালঙ্ক, পালকি, সিন্দুক, দরজা ও সিঁড়ি, হাতির দাঁতের তৈরি অলংকার, পাটি, শো-পিস ইত্যাদি দেখতে দেখতে হারিয়ে গেলাম সেই সময়ের বাংলায়। এসব জিনিসে খোদাই করা নিখুঁত কারুকাজ দেখে বুঝতে পারলাম, সেকালের মানুষের রুচি ও শিল্পবোধ ছিল অনন্য। এ ছাড়া রয়েছে জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমেদসহ বিভিন্ন বরেণ্য চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম। রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত প্রাচীন টেরাকোটার নমুনা। বিভিন্ন অঞ্চলের নৌকা, মসলিন, পাথরে তৈরি প্রাচীন ভাস্কর্য। মাটির পুতুল, লোকশিল্পের এক বিশাল সংগ্রহশালাও আছে।

ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে একটা বিশাল কক্ষ। এখানে রয়েছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। রক্তে ভেজা পোশাক, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের ভাঙা টুকরা, বোমা, তৎকালীন দৈনিক পত্রিকা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় ব্যবহৃত টেবিল। এতকিছু দেখে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে ধারণা পেলাম তা বইয়ের পাতার বর্ণনার চেয়েও অনেক বেশি নির্মম ও সাহসিকতার। সব গ্যালারি ঘোরা শেষে সন্ধ্যাবেলা যখন জাদুঘর থেকে বের হলাম তখন আমরা ছিলাম ইতিহাসের ঘোরে আচ্ছন্ন।

জাদুঘর নিয়ে আরও কিছু কথা

অবিভক্ত বাংলার প্রাচীনতম জাদুঘরগুলোর মধ্যে জাতীয় জাদুঘর অন্যতম। দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে বর্তমান ভবনে জাদুঘর স্থানান্তরের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর। এর আগে ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় তৎকালীন ঢাকা জাদুঘর। এরপর থেকেই শুরু হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অমূল্য প্রত্নসম্পদ সংগ্রহ। বর্তমানে এটি প্রাচীন নিদর্শনাদির এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। বর্তমান জাদুঘর ভবনের নকশা করেন স্থপতি মোস্তফা কামাল। ভবনের নিচতলায় রয়েছে অফিস ও হলরুম। জাদুঘরে রয়েছে মোট ৪৩টি গ্যালারি। সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার। শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা এবং শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাতীয় জাদুঘর। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টিকিটের দাম ৪০ টাকা, ৩ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য টিকিটের দাম ২০ টাকা। সার্কভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য জাদুঘর পরিদর্শন ফি ৩০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জন্য ৫০০ টাকা।

অনলাইনে জাতীয় জাদুঘরের টিকিট

অনলাইনেই সংগ্রহ করা যাবে জাতীয় জাদুঘরের প্রবেশ টিকিট। জাতীয় জাদুঘরের ওয়েবসাইটের ঠিকানায় গিয়ে আপনার যাবতীয় তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন একবারই করতে হবে। পরবর্তী সময়ে ই-মেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে বার বার লগইন করে টিকেট কেনা যাবে।

পারচেজ ই-টিকিট অপশনে ক্লিক করতে হবে। জাদুঘর ভ্রমণের তারিখ, টিকিট সংখ্যা লিখে ‘অ্যাড’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। একের বেশি টিকেট কিনতে ‘অ্যাড মোর’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। এরপর ‘মেক পেমেন্ট’ বাটনে ক্লিক করে পেমেন্ট গেটওয়ে দিয়ে পেমেন্ট সম্পন্ন করতে হবে। পরে ‘প্রিন্ট টিকিট’ অপশনে ক্লিক করে টিকিট প্রিন্ট করা যাবে। জাদুঘরে প্রবেশের সময় অনলাইন টিকিটের প্রিন্ট কপি, মোবাইলে ডাউনলোড কপি বা টিকিট নম্বর দেখালেই হবে।

ঘরে বসেই দেখা যাবে জাতীয় জাদুঘর

দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জানতে জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শনের আগ্রহ প্রায় সবারই আছে। কিন্তু সময় স্বল্পতা, ঢাকার যানজট, কিংবা পথের ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে যাওয়াটা অনেকেই কঠিন মনে করেন। তাদের জন্যই ঘরে বসে ইন্টারনেটে জাদুঘর দেখার সুযোগ করে দিতে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এসেছে জাতীয় জাদুঘর। ৩৬টি গ্যালারির তিন হাজার নিদর্শন নিয়ে জাতীয় জাদুঘরের ‘ভার্চুয়াল গ্যালারি’ যাত্রা শুরু করেছে সম্প্রতি। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ব্যক্তি অনলাইনে এখন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত সব প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস ঐতিহ্যের ছবি দেখতে পাবেন। জাতীয় জাদুঘরের ওয়েবসাইটে প্রবেশের পরই দেখা মিলবে মূল ফটক, সরাসরি জাদুঘরের লবি, ওপরে ওঠার সিঁড়ি। ভেতরে প্রবেশ করে ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে অবলোকন করা যাবে জাদুঘরের অন্তর্গত প্রত্নসম্পদ ও আনুষঙ্গিক নিদর্শনসমূহ। ডানে-বাঁয়ে, চারিদিকে ঘুরিয়ে দেখা যাবে এই গ্যালারি। আর যদি নির্দিষ্ট কক্ষের কোনো নিদর্শন দেখতে চান, তবে মানচিত্র দেখে সরাসরি সে কক্ষেও যাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে এই গ্যালারি তৈরি করা হয়েছে। কারিগরি সহায়তা করেছে ইউএনডিপি ও ইউএসএআইডি। জাতীয় জাদুঘর এখন দেশের জনগণ ও বিশ্ববাসীর হাতের মুঠোয়।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বড় প্রাপ্তি

শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পেয়েছে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পুরস্কার একুশে পদক। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের পক্ষে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন।

জাতীয় জাদুঘরের অধীন ৭ জাদুঘর

জাতীয় জাদুঘরের অধীনে রয়েছে বাংলাদেশের আরও সাতটি জাদুঘর। আপনি কী জানেন কোন কোন জাদুঘর এগুলো! জেনে নেওয়া যাক তবে। স্বাধীনতা জাদুঘর, আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, ওসমানী জাদুঘর, জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা, পল্লী কবি জসীমউদদীন জাদুঘর, কাঙাল হরিনাথ জাদুঘর; এই সাতটি জাদুঘর জাতীয় জাদুঘরের অধীন।

শেষ কথা

জাতীয় জাদুঘরে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বিশ্রাম কক্ষ, নামাজের কক্ষ, বিনামূল্যে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট, শিশুদের জন্য খাবার ও টয়লেটের বিশেষ ব্যবস্থা। তবে কোনো কিছু পড়ে জানা আর দেখে জানার মধ্যে বেশ দূরত্ব থেকেই যায়; তাই পাঠক বন্ধুদের পরামর্শ দেব কোনো এক বিকেলে আমাদের মতো হঠাৎ করেই এখনও যারা জাতীয় জাদুঘরে যাননি তারা ঘুরে আসতে পারেন জাতীয় জাদুঘর থেকে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − eight =