জ্বালানি নিরাপত্তায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের করণীয়

বাংলাদেশের দীর্ঘ স্থায়ী  জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিবেশ তৈরীর লক্ষ্য নিয়ে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের আদলে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা সমূহের মধ্যে সুসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সৃষ্টি করা হয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।  কিন্তু ২০০৩ – ২০২৪ সকল সরকার কর্তৃত্ব পরায়ণ থেকে যথেচ্ছার করায় বিইআরসি সত্যিকার অর্থে কার্যকরী প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিকশিত হয়নি। ফলশ্রুতিতে এককভাবে আমলা নিয়ন্ত্রিত জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে সৃষ্টি হয়েছে মহাসংকট। অস্বচ্ছতা, দুর্নীতির কারণে জ্বালানি নিরাপত্তায় সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। সরকারি সংস্থাগুলো হয়ে পড়েছে দেউলিয়া প্রায়। জ্বালানি  সরবরাহ সঙ্কটে বিপুল  পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা  থাকা সত্ত্বেও গ্রাহক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। জ্বালানি বিদ্যুৎ সঙ্কটে শিল্প কারখানার উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে, অনেকগুলোর আবার ধুরে ধুরে চালু আছে। অথচ সরকার বিইআরসিকে সত্যিকার অর্থে সঠিক পেশাদার নিয়োজিত করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে স্বেচ্ছাচার আর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা  সম্ভব ছিল। দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে নিরপেক্ষ সংস্থা হিসাবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্বে কারিগরি এবং প্রশাসনিক ভাবে শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি।

বার্ক এক্ট ২০০৩ অনুযায়ী সরকারি এবং বেসরকারি জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ কোম্পানি এবং সংস্থাগুলো বার্ক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে ব্যবসা পরিচালনা করার কথা। সেই অনুযায়ী সংস্থাগুলোর কারিগরি, আর্থিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম দেশে অনুমোদিত এক্ট, রেগুলেশন, পলিসি অনুযায়ী হচ্ছে কিনা সেটি দেখার অধিকার বার্ক সংরক্ষণ করে।  কিন্তু প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এযাবৎ জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের কোনো উন্নয়ন মূলক কার্যক্রম এবং বিনিয়োগ বার্কের প্রাক অনুমোদন নিয়ে করা হয়নি। যদি করা হতো তাহলে গ্যাস এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করেই বিপুল অর্থ বিনিয়োগে অনেক বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে একদিকে সরকারি অর্থের অপচয় অন্যদিকে দেনার দায়ে সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোকে দেউলিয়া হওয়ার পথে যেতে হতো না। এই ধারাবাহিকতায় পূর্ববর্তী সরকার এতো বেপরোয়া ছিল যে একপর্যায়ে বিদ্যুতের ট্যারিফ এবং জ্বালানি মূল্য  নির্ধারণ দায়িত্ব বার্ক থেকে সংকুচিত করে বিদু্ত জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে নেওয়া হয়।  অর্ন্তবর্তিকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বার্ক এক্টের পরিবর্তন বাতিল করে নিরংকুশ অধিকার আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চেয়ারম্যান এবং সদস্য হিসাবে অভিজ্ঞ দক্ষ পেশাদারদের দায়িত্ব দেওয়ায় ঘুরে দাঁড়াতনার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বার্ক।

বিগত সরকারের কিছু কার্যক্রম নিরপেক্ষ ভাবে অনুসদ্ধান করলেই দায়ী ব্যাক্তিদের আইনের আওতায় আনা  যাবে

এ কেন দেশে বাপেক্সের মত সক্ষম জাতীয় অনুসন্ধান কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও অধিক খরচে অস্বচ্ছ ভাবে উন্নয়ন কূপ খননের জন্য রাশিয়ান গাজপ্রমকে নিয়োজিত করা হয়েছিল? চুক্তিটি গাজপ্রমের সঙ্গে হলেও কিভাবে এরিয়েল নামের দুর্বল কোম্পানি খননের দায়িত্ব পেলো? গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়নের জন্য বিশেষ ভাবে সৃষ্ট গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ কোথায় কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেটি অনুসদ্ধান করা জরুরি।

কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে ১০৮ গ্যাস কূপ খননের অবাস্তব প্রকল্প চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল বাপেক্সের উপর? আবার বাপেক্স যখন উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করলো তখন কেন মাঝপথে প্রকল্প বাতিল করে বেশ কয়েক বছর মূল্যবান সময় অপচয় করা হলো?

কেন গ্যাস মজুদ কমে আসার পরেও জিটিসিএলকে একের পর এক ব্যয়বহুল গ্যাস সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ চাপিয়ে দিয়ে আর্থিকভাবে রুগ্ন করা হলো? জিটিসিএলের নিম্ন বর্ণিত প্রকল্পগুলো অবশ্যই তদন্তের আওতায় আসতে পারে

  • এডিবির অনুদানে মুচাই, আশুগঞ্জ, এলেঙ্গায় পাইপ লাইন কম্প্রেসসর স্টেশন অগ্রবর্তী থাকা অবস্থায় কেন কোন চুক্তির আওতায় শেভরোনকে মুচাইতে অপেক্ষাকৃত অধিক মূল্যে কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপনের দায়িত্ব দেয়া হলো? আবার তিনটি কম্প্রেসর প্রকল্প চালু থাকা অবস্থায় কেন সমান্তরালে জরুরি ভিত্তিতে অপেক্ষাকৃত অধিক খরচে বিবিয়ানা – ধানুয়া পাইপলাইন নির্মাণ করা হলো। ফলশ্রুতি পাইপ লাইন টি নির্ধারিত ক্ষমতার অনেক কম গ্যাস পরিবহন করছে। আশুগঞ্জ এবং এলেঙ্গা কম্প্রেসর চালু রাখার মত গ্যাস নেই। এলেঙ্গা কম্প্রেসার কোনো দিন চালু হয়নি।
  • কেন কাদের স্বার্থে আশুগঞ্জ -বাখরাবাদ প্যারালাল পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে? পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন প্রতিবেদন দেখলেই প্রতিয়োমান হবে আশুগঞ্জ – বাখরাবাদ ১ এবং ২ পাইপ লাইনে গ্যাস ব্যবহার শুন্য
  • যেখানে গ্যাসের স্বল্পতার কারণে কুষ্টিয়া -যশোর -খুলনায় গ্যাস সরবরাহ করা হয়নি সেই অবস্থায় কেন বগুড়া থেকে রংপুর হয়ে সৈয়দপুরে গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ করা হলো ?
  • কেন তীব্র গ্যাস সঙ্কটের সময়েও ভোলায় আবিষ্কৃত গ্যাস নানা অজুহাতে গ্যাস গ্রীডে সংযুক্ত করা হলো না? স্মরণে থাকতে পারে ইউনোকল নামের আন্তর্জাতিক অয়েল কোম্পানি ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে ওয়েস্টার্ন রিজিওন ইন্টেগ্রেটেড প্রজেট প্রস্তাব করে ভোলার গ্যাস বরিশাল হয়ে খুলনায় সঞ্চালনের প্রস্তাব দিয়েছিলো। প্রকল্পের অধীনে ভোলা, বরিশাল এবং খুলনায় তিনটি গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা ছিল।
  • গ্যাস সরবরাহ সংকট থাকা সত্ত্বেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টাকে প্রধান করে কমিটির মাধ্যমে কেন শিল্পগুলোকে অস্বচ্ছ উপায়ে গ্যাস সংযগ দেয়া হয়েছিলো? অনেক দুর্নীতির অভিযোগ আছে গ্যাস সংযোগ প্রদানের প্রদানের ক্ষেত্রে?
  • গ্যাস না থাকা সত্ত্বেও কেন মেঘনাঘাটে তিনটি অত্যাধুনিক গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল? বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখন প্রস্তুত। এর মধ্যে দুটির বাণিজ্যিক পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হলেও জাপানের জেরার পাওয়ার প্লঅন্টকে সিওডি করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে আসবে গ্যাস?
  • কেন মাতারবাড়িতে ভূমি ভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প ৫ বছরের অধিক সময় ঝুলে আছে? কেন দুটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন করতে ৮ বছর সময় লাগলো?
  • মহেশখালী থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত দুইধাপে দুবার অপেক্ষাকৃত অধিক মূল্যে গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এই দুই পাইপ লাইন নির্মাণ কালে অকারণে অত্যাধিক ক্ষমতার মিটারিং স্টেশন নির্মাণ করে আর্থিক দায় জিটিসিলের উপর বর্তানো হয়েছে।
  • বিগত সরকারের সময়ে পেট্রোবাংলা এবং গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত মনোভাবের কর্মকর্তাদের যোগসাযোগে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস চুরি হয়েছে। গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ককে রীতিমত বিযস্ত ও অনিরাপদ করা হয়েছে।

উপরোক্ত ব্যার্থতার দায় দায়িত্ব অবশ্যই পূর্বরবর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, জ্বালানী বিদ্যুৎ সচিব বৃন্দ এবং অবশ্যই পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, পরিচালকদের উপর বর্তায়।

বার্ককে প্রয়োজনীয় জনবল দিয়ে শক্তিশালী করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করিয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিলে ৩-৫ বছরের মধ্যে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর ঘুরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তা সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। আর বার্ক আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে আগামী দিনে বিদু্যত ও জ্বালানি খাতে সকল প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে বাকে‍র্র অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে বিনিয়োগে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি দূর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six + eleven =