জ্যোতি ছড়ানো জ্যোতিকা জ্যোতি

দেশের এ সময়ের একজন নন্দিত অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি। প্রচলিত ঘরানার বাইরের গল্পে এবং ব্যতিক্রমী, চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করে নিজের একটি অবস্থান তৈরি করেছেন তিনি। দেড় দশকেরও অধিক সময় ধরে মিডিয়া অঙ্গনে পথচলা তার। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। তার অভিনীত নাটক, টেলিছবির সংখ্যাও কম নয়। শুধু অভিনয়ই নয় রাজনীতি ও সামাজিক নানা কাজে নিয়োজিত রাখেন নিজেকে। বর্তমানে এই অভিনেত্রী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১১ সেপ্টেম্বর জ্যোতিকা জ্যোতির জন্মদিন। তার জন্মদিনে রঙবেরঙের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। মৌ সন্ধার প্রতিবেদনে চলুন এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক জ্যোতির পথচলার গল্পে।

ময়মনসিংহের সেই মেয়েটি

জ্যোতির পৈত্রিক নিবাস ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরে। ১৯৮৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিতাই চন্দ্র পাল ও মা পূর্ণিমা পালের ঘর আলোকিত করে এসেছিলেন তিনি। শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন ময়মনসিংহে। আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করার পর তার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেবার কথা ছিল। সেসময়েই অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়। মাস্টার্সে অধ্যয়নকালীন তিনি ময়মনসিংহের বহুরূপী থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন। তবে এ নাট্যদলের হয়ে মঞ্চে ওঠার সুযোগ হয়নি তার। তাতে কী! অভিনেত্রী হবেন বলে চলে আসলেন ঢাকায়। শুরু হলো অন্যরকম এক পথচলা। সেই থেকে সামনে এগিয়ে চলেছেন। ক্যারিয়ারের নানা চরাই উৎরাই পার করেছেন। তবে থেমে যাননি জ্যোতি।

মিষ্টি মেয়ে কবরীর কাছ থেকে সাড়া

মিডিয়াতে আসতে চাইলেই আসা যায় না। তবে জ্যোতিকা জ্যোতির রাস্তা কিছুটা মসৃণ করে দেয় একটা প্রতিযোগিতা। ময়মনসিংহের মেয়ে জ্যোতি ২০০৪ সালে লাক্স-আনন্দধারা ফটোজেনিক প্রতিযোগিতায় সেরা দশে স্থান করে নিয়েছিলেন। আর এর পরপরই মিষ্টি মেয়ে খ্যাত নায়িকা সারাহ বেগম কবরীর ‘আয়না’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। ২০০৫ সালে জ্যোতি অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’ মুক্তি পায়। এই ব্রেক জ্যোতির ক্যারিয়ারে লাগায় বসন্তের হাওয়া। এরপর বেশকিছু উল্লেখ করার মতো সিনেমায় অভিনয় করেন এই অভিনেত্রী।

জ্যোতির যতো সিনেমা

জ্যোতিকা জ্যোতির জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া নয়, কিন্তু একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় অনেক নায়িকার চেয়েও তার অর্জন বেশ ভারী। এমন কিছু সিনেমায় তার অভিনয় করার সুযোগ হয়েছে, যে সিনেমাগুলো তরুণ নির্মাতারা পাঠ্য বইয়ের মতো অনুশীলন করেন। দেশের নন্দিত সব নির্মাতাদের চলচ্চিত্রের নায়িকা হয়েছেন জ্যোতি। কবরীর ‘আয়না’ সিনেমার পরে ২০০৬ সালে বেলাল আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ সিনেমায় অভিনয় করেন জ্যোতি। ২০১৪ সালে নন্দিত নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবন ঢুলী’ সিনেমায় অভিনয় করেন। ২০১৫ সালে মুক্তি পায় জ্যোতি অভিনীত ‘অনীল বাগচীর একদিন’ সিনেমাটি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে এই সিনেমাটি নির্মাণ করেন ‘দিপু নাম্বার টু’ খ্যাত পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম।

এরপর অভিনয় করেছেন মাসুদ পথিকের ‘মায়া’ চলচ্চিত্রে। ২০২১ সালে অভিনয় করেছেন নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সিনেমায়। জোতিকা জ্যোতি অভিনীত সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া সিনেমাটির নাম ‘বঙ্গমাতা’। শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে নিয়ে নির্মাতা গৌতম কৈরী নির্মাণ করছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বঙ্গমাতা’। ২০২৩ সালে ৭ আগস্ট রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার হয়। সিনেমাটির ‘বঙ্গমাতা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন জ্যোতি। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে খোরশেদ বাহারের উপন্যাস ‘বঙ্গমাতা ইতিহাসের নিভৃত সৈনিক’ অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন পরিচালক গৌতম কৈরী। এই প্রথম বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গমাতাকে নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হলো। মুক্তির অপেক্ষায় আছে জ্যোতি অভিনীত নূরুল আলম আতিকের ‘মানুষের বাগান’ সিনেমাটি।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে

কলকাতার সিনেমায় অভিনয়ের সুখবরটি জ্যোতিকা জ্যোতি দিয়েছিলেন ২০১৭ সালের শুরুর দিকে। ‘রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত’ নামের সেই ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। এই সিনেমায় দেখা যায় আধুনিক রাজলক্ষ্মী জ্যোতিকা জ্যোতিকে। তার বিপরীতে ছিলেন নায়ক ঋত্বিক। এর মাধ্যমে প্রথমবার ভারতের ছবিতে কাজ করেন বাংলাদেশের জ্যোতিকা জ্যোতি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত’ ছবিটি নির্মাণ করেছেন ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’খ্যাত কলকাতার পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। ছবিটিতে দেখা যায়, রাজলক্ষ্মী বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় চলে যাওয়া ছিন্নমূল পরিবারের একটি মেয়ে। পরে নারী পাচার চক্রের ফাঁদে পড়ে যাকে নামতে হয় দেহ ব্যবসায়ও। তারপর কী হয়? বাকিটা দেখতে হবে সিনেমায়।

নতুন পরিচয় নতুন সিনেমা

অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি অভিনয়ের পাশাপাশি এবার সিনেমা প্রযোজনায় আসছেন। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রে হাউজ’ থেকে ‘লারা’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তিনি। সরকারি অনুদানের পাশাপাশি সিনেমাটি প্রযোজনা করবে তার প্রতিষ্ঠান। সরকারি অনুদান ৬০ লাখ টাকা পেলেও ‘লারা’ সিনেমা নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে আনুমানিক ৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট, প্রশিক্ষক, বৈমানিক ফারিয়া হোসেন লারা। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আগুন লেগে এয়ার পারাবতের বিমানটি ঢাকার পোস্তগোলায় বিধ্বস্ত হলে লারাসহ দুজন নিহত হন। সেই লারাকে নিয়ে সিনেমাটি পরিচালনা করবেন শেখর দাশ। ফারিয়া লারা’র মা খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, বাবা মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন। মেয়েকে নিয়ে ২০০৬ সালে ‘লারা’ নামের একটি উপন্যাস লিখেছেন। এই সিনেমাটির জন্য এরইমধ্যে লেখকের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নেওয়া হয়েছে। জ্যোতিকা জ্যোতি বলেন, সেলিনা হোসেন ফারিয়া লারাকে নিয়ে ‘লারা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। সেই উপন্যাস এবং লারার বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্প থেকে উৎসাহিত হয়ে আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রে হাউজ’ থেকে ‘লারা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছি। তথ্য মন্ত্রণালয় এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান দিয়েছে। জুরিবোর্ড কর্তৃক দারুণভাবে গল্পটি প্রশংসিত হওয়ায় আমরা আনন্দিত ও উৎসাহিত। লারার অদম্য কাহিনি দেশের তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের সঙ্গে বেড়ে উঠতে চিরদিন উজ্জীবিত করবে বলেই আমাদের ঐকান্তিক প্রয়াস, যোগ করেন তিনি।

নাটক ও বিজ্ঞাপনে জ্যোতি

জ্যোতি অভিনীত প্রথম নাটক অনন্ত হীরার নির্দেশনায় ‘স্বপ্নের পাঠশালা’। এরপর অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। অনিমেষ আইচের ‘একটি ঝড়াক্রান্ত শেফালী গাছ’ নাটকে অভিনয় করে আলোচিত হয়েছিলেন। তার অভিনীত এক পর্বের নাটকের মধ্যে শতাব্দি জাহিদের ‘স্বপ্নবুনন’, রনির ‘জাগরণের রংটা ধূসর ছিলো’, রাসেল আজমের ‘মুক্তাহীন ঝিনুক’, নজরুল কোরেশীর ‘ভালোবাসার লাল পিঁপড়া’, দিমা নেফার তিতির ‘স্বপ্ন দেখার সাহস’, ইশতিয়াক মাহমুদের ‘মুক্তি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শুধু এক ঘণ্টার নাটক নয়, এর ফাঁকে বেশকিছু ধারাবাহিক নাটকেরও কাজ করেছেন জ্যোতি। অনন্ত হীরার ‘স্বপ্নের পাঠশালা’ জ্যোতির প্রথম টিভি নাটক। তবে আলোচনায় আসেন ‘মোহনা’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে। ফজলুর রহমানের ‘সময়ের হাতঘড়ি’, হাবিব মাসুদের ‘বেলা অবেলা’, অরণ্য আনোয়ারের ‘কর্তাকাহিনী’, সাঈদ তারেকের ‘স্বপ্নবিলাস’, ইমরান ইমুর ‘কুটুম পাখি’ ইত্যাদি তার অভিনীত ধারাবাহিক নাটক।

বিজ্ঞাপনের মডেলও হয়েছেন তিনি। শামীম মাজহারের নির্দেশনায় তিনি প্রথম হুইল পাউডারের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও উপস্থাপনায় নাম লিখিয়েছেন জ্যোতি।

শিল্পকলার পরিচালক জ্যোতি

অভিনয়শিল্পী জ্যোতিকা পাল জ্যোতি শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন বর্তমানে। দুই বছরের জন্য এ পদে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। দক্ষতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন এই অভিনেত্রী।

শেষ কথা

অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতির চিন্তা-ভাবনার সবটুকু যে নাটক-সিনেমাকেন্দ্রিক, তা কিন্তু নয়। তিনি সমাজসচেতন একজন নারী। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারিত হয়েছে তার কণ্ঠে। দেশ, মানুষ এবং রাজনীতি নিয়ে তিনি সচেতন। আবারও শুভেচ্ছা রইলো জ্যোতিকা জ্যোতির জন্য। অনেক মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে এগিয়ে যাক বাংলা সিনেমার রাজলক্ষ্মী।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 4 =