ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ: ঝড়ের পূর্বাভাসে উপকূলে আতঙ্ক

আওয়াল শেখ: আবহাওয়া অধিদপ্তর আভাস দিয়েছে, বাংলাদেশ উপকূলে ১৩ থেকে ১৫ মের মধ্যে যেকোনো সময়ে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় মোখা। গত কয়েক বছরের একাধিক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারা উপকূলের মানুষ আবারও ঝড়ের আভাসে আতঙ্কিত।

উপকূলে নদী রক্ষা বাঁধগুলো অরক্ষিত থাকায় ঝড়ে আবারও লোকালয় প্লাবনের অশঙ্কা করছেন তারা। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা সবচেয়ে বেশি ঝূঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই বেল্টের গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, আটুলিয়া, কাশিমাড়ী এলাকার কয়েকটি বেড়িবাঁধ অতিঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে; যা কোনো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট প্লাবন মোকাবিলার সক্ষমতা রাখে না।

এর মধ্যে সব থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে বুড়িগোয়ালিনী এলাকার বেড়িবাঁধ। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ভবতোষ মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের বুড়িগোয়ালিনীর দুর্গাবাটিতে দুই জায়গায় ও দাতিনাখালীসহ মোট তিনটি স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।’

এ ছাড়া গাবুরা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আবদুর রহিম বলেন, ‘হরিষখালী, পার্শেমারী টেকেরহাট, গাবুরা, চকবারা, লেবুবুনিয়াসহ ৫টি স্থানে বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে আছে।’

আটুলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান আবু সালেহ বাবু বলেন, ‘আটুলিয়া ইউনিয়নে তিনটি পয়েন্টে পাউবোর বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে বিড়ালক্ষ্মীতে দুটি ও বড়কুপটের একটি জায়গা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানলে এসব জায়গায় বাঁধ টিকবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।’

সাতক্ষীরা সদর, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কিয়দংশের বেড়িবাঁধ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের (পওর) দায়িত্বে রয়েছে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১। ওই অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের আওতাধীন মোট ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ২০ কিলোমিটার, আর অতিঝুঁকিপূর্ণ ৩ কিলোমিটার। ঝড়ের আভাস পেয়ে অতিঝুঁকিপূর্ণ ৩ কিলোমিটার সংস্কার করা হচ্ছে।’

অন্যদিকে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া ও আশাশুনি উপজেলার কিয়দংশের বেড়িবাঁধ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২। ওই অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহানেওয়াজ তালুকদার বলেন, ‘আমাদের আওতাধীন মোট ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৩ কিলোমিটার, আর অতিঝুঁকিপূর্ণ সব এলাকায় সংস্কার করা হয়েছে।’

সাতক্ষীরার মতো একই অবস্থা খুলনার কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলায়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা রিং বাঁধ, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাটসংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়িয়া, ২ নম্বর কয়রা, হোগলা, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং ও মহেশপুর এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বাড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে পারে।

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গাজীপাড়া ও গাতিরঘেরী এলাকায় গত বছর বাঁধ দেয়া হয়েছিল। তবে এখন তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।’

মহেশ্বরীপুর ইউপির চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বলেন, বর্তমানে কয়েক জায়গায় বাঁধ ধসে গেছে। নদীতে পানি বাড়লে বড় ক্ষতি হতে পারে। বাঁধ ভাঙলে গোটা ইউনিয়ন নদীর পানিতে তলিয়ে যাবে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের স্থায়ী সমাধান করতে হলে নদীশাসনকাজ করতে হবে। এ জন্য পাকা ব্লক ফেলা ছাড়া বিকল্প নেই।

উপকূলীয় কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার বেড়িবাঁধ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২। ওই অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের আওতাধীন মোট ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ১০ কিলোমিটার, আর অতিঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৩ কিলোমিটার।’

তিনি বলেন, ‘পাইকগাছার তুলনায় কয়রা উপজেলায় আমাদের বেশি নজর রাখতে হচ্ছে। কারণ ওই এলাকাটি সুন্দরবনসংলগ্ন ও তার তিন দিকে কপোতাক্ষ এবং শাকবাড়িয়া নদী রয়েছে। বড় আকারের জলোচ্ছ্বাস হলে ভালো বাঁধও মুহূর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে।’

খুলনার দাকোপ উপজেলার জালিয়াখালী, মধ্যপানখালী, কালাবগী, সুতারখালী, চুনকুড়ি, ঢাংমারি, জাবেরের খেয়াঘাট, খোনা, গড়খালী, মোজামনগর, ঝালবুনিয়া, দক্ষিণ কামিনিবাসিয়া, উত্তর কামিনিবাসিয়া, বটবুনিয়া, শিবসার পাড়, ভিটেভাঙ্গা, শ্রীনগর, কালীবাড়ি, গুনারী, খলিশা এলাকায় বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পঞ্চন কুমার মণ্ডল বলেন, ‘ঝড়ের নাম শুনলেই আমাদের এলাকার মানুষের প্রাণ কেঁপে ওঠে। প্রায় প্রতিবছরই জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে জান ও মালের ক্ষতি হয়। তবে পাউবো যে বাঁধ নির্মাণ করে, তা কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে যায়। সাধারণ জোয়ারে সেই বাঁধ প্লাবন ঠেকাতে পারে না, আর জলোচ্ছ্বাসে কী করে ঠেকাবে।’ তিনি জানান, তার ইউনিয়নে অন্তত ১০টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে।

খুলনা অঞ্চলে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় ৬৮৩ কিলোমিটার এবং ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সময় ৪৭৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিবছরই উপকূলে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। এর থেকে ক্ষতি কমাতে সরকারের বড় পরিল্পনা দরকার।’

দৈনিক বাংলা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 + two =