ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এড়াতে আমাদের করণীয়

জাকিয়া আহমেদ

২০০০ সালের আগেও দেশে কিছু রোগী ডেঙ্গুর লক্ষণ উপসর্গ নিয়ে শনাক্ত হয়, তখন এর নাম ছিল ঢাকা ফিভার। কিন্তু ২০০০ সালে সরকারের নজরে আসে, তখন এর নাম হয় ডেঙ্গু জ্বর। বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়, কারণ বর্ষাকাল, চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে মৌসুম শুরুর আগেই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল।কিন্তু বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ে গা ছাড়া ভাব এবং সব সতর্কবার্তাকে আমলে না নেবার কারণে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রোগী ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে দেশ। সে বছরে হাসপাতালের বেড ছাপিয়ে রোগীদের জায়গা নিতে হয় মেঝেতেও। একসময় রোগী রাখার জন্য মেঝেতেও জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

গেল বছরে রোগী বাড়তে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে, জুন নাগাদ ডেঙ্গুর বিস্তার শুরু হয়, ভেঙ্গে দেয় আগের সব হিসেব। বছর শেষে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড করে সরকারি হিসেবেই রোগী সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন আর মৃত্যু হয় এক হাজার ৭০৫ জনের।সরকারি তথ্য বলছে, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৮৪৯ জনের, আর কেবল গত বছরেই মৃত্যু হয়েছে আগের ২২ বছরের দ্বিগুণ মানুষ। বিশ্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বাংলাদেশেই বেশি।তবে সর্বোচ্চ রোগী আর সর্বোচ্চ মৃত্যুর বছরকেও চলতি বছরে ছাড়িয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। এখনই চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের হিসেব গত বছরের প্রথম তিন মাসের রোগী সংখ্যা আর মৃত্যুকে ছাড়িয়ে গেছে। আর এজন্য দেশের আবহাওয়া বৈরি ভূমিকা পালন করছে। সঙ্গে রয়েছে ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা ও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি গতবারের চাইতেও খারাপ হবার সম্ভবনা রয়েছে। বছরের শুরুতেই সেই আভাস মিলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর ধরন, এইডিস মশার চরিত্র বদল, এতদিন কেবল শহরকেন্দ্রিক হলেও এখন সারাদেশে ছড়িয়ে যাওয়া, মশা নিধন এবং রোগী ব্যবস্থাপনায় ঢাকার বাইরের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও অসময়ে বৃষ্টি।মশা মারতে কার্যকর উদ্যোগের অভাব, অকার্যকর ওষুধের ব্যবহার, যথেষ্ট বরাদ্দ না থাকা, সমন্বয়হীনতা, চিকিৎসার সংকট—নানা দিক তখন সামনে এসেছিল গত বছরে, আর এভাবেই যদি চলতে থাকে, সমন্বিত কার্যকর ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয় তাহলে গতবারের রেকর্ড ভেঙ্গে যাবে এবারে।সরকারি পরিসংখ্যান বলছে,চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে  ২৩ মার্চ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে রোগী শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ৬২০ জন যেখানে গত বছরের এই সময়ে রোগী ছিল ৮৪৩ জন; শতাংশের হিসেবে প্রায় দ্বিগুণ।  চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ( ২৩ মার্চ) মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের, গত বছরের এই সময়ে মৃত্যু হয়েছিল নয়জনের; শতাংশের হিসেবে মৃত্যু দ্বিগুণেরও বেশি।

অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে জানুয়ারিতে রোগী ছিল ৫৬৬ জন, মৃত্যু ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে রোগী ১৬৬ জন, মৃত্যু তিনজন আর মার্চে মৃত্যু ছিল না, রোগী ছিল ১১১ জন। যেখানে চলতি বছরের জানুয়ারিতে রোগী এক হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯ জন আর ২৩ মার্চ পর্যন্ত রোগী ছিল ২২৬ জন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে ১৪ জন, তিনজন আর ২৩ মার্চ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের।এদিকে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ডেঙ্গুমুক্ত করেত সরকার জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল (২০২৪-২০৩০)হাতে নিয়েছে।১৯মার্চেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের চার অক্টোবরস্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩০টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৫টি ওয়ার্ডে এইডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ব্রুটো ইনডেক্সে ২০ এর ওপরে পাওয়া গিয়েছে।কোনও এলাকায় এইডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব হিসেব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। ব্রুটো ইনডেক্স যদি ২০-এর বেশি হয় তবে তা উচ্চমাত্রার ঝুঁকি। আর হাউস ইনডেক্স যদি ১০-এর বেশি হয় তবে তা ঝুঁকিপূর্ণ ।আর প্রাক মৌসুম জরিপে গত বছরের চার জুলাই অধিদপ্তর জানিয়েছিল, পুরো ঢাকা শহর ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। জরিপের তথ্য জানিয়েছিল, ঢাকা উত্তর সিটির ৪০টি ওয়ার্ডে এবং দক্ষিণ সিটির ৫৮টি ওয়ার্ডে সর্বমোট ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়িতে সার্ভে করা হয়েছে। এরমধ্যে ৫৪৯টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। অধিদপ্তরের পরিচালক  বলেন, ‘এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি ‘ব্রুটো ইনডেক্স’র মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সার্ভেতে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৮টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে।

গত ১৯ মার্চে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, দেশে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাবের পর থেকে যত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, তার চাইতেও বেশি রোগী আক্রান্ত হয়ে গত বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে।শনাক্ত হওয়ার পর থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ আর ২০২৩ সালেই আক্রান্ত হয়েছে প্রায় তিন লাখ জানিয়ে তিনি বলেন, এই সংখ্যা শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর। এর বাইরেও আরো রোগী ছিল।এতেই বোঝা যায়, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে আমাদের এবার আগে থেকেই সতর্ক না হয়ে কোনো উপায় নেই মন্তব্য করে তিনি একদিকে মশা মারা এবং অন্যদিকে রোগের প্রার্দুভাব কমানোর জন্য আগে থেকেই সতর্ক ও সচেতন থাকার আহ্বান জানান। চলতি বছরের শুরুর তিন মাসের ডেঙ্গু রোগী তথ্য গত বছরের চাইতেও প্রায় দ্বিগুণ। আর এখনই আমাদের সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন, নয়তো রক্ষা হবে না, বলেন অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।মশা নিয়ে দেশে গবেষণা করেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডা. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য পাচ্ছি, সেটা গত বছরের এই সময়ের চাইতে প্রায় দেড়গুণ বেশি।চলতি বছরে তাদের এক গবেষণার ফল সর্ম্পকে তিনি বলেন, এবারে মশার ঘণত্বও বেশি পাওয়া গেছে। বিশেষ করে, চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুণা ও চাঁদপুরে এইডিস মশার ঘণত্ব অনেক বেশি। এটা অনেক বেশি উদ্বেগের বিষয়।দেশজুড়ে বিশেষ করে যে জেলাগুলোতে মশার ঘণত্ব বেশি রয়েছে, সেখানে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে, বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।ডেঙ্গু এখন সারাবছরের রোগ হলেও গত বছরে জুলাই থেকে রোগী বাড়তে থাকে, আর সেটা পিক টাইম গিয়ে ঠেকেছে অগাস্ট সেপ্টেম্বরে…এবারেও তাই হবে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দুটো উপায়। প্রথমটি মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রন, পরেরটি রোগী ব্যবস্থা। মশা নিধনের কাজ সিটি কর্পোরেশনের হলেও রোগী ব্যবস্থাপনা বর্তায় স্বাস্থ্যের ঘাড়ে।আর সে নিয়ে স্বাস্থ্যের বক্তব্য, ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে এ নিয়ে হাসপাতালগুলোকে ‘অ্যালার্ট’ করা হয়েছে, আরও কার্যকর পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই এ নিয়ে সবকিছু জানানো হবে।হাসপাতালের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের তিনটি ধাপ।মশা নিধন, জনগণের সচেতনতা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা।তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এ নিয়ে, স্যালাইন পর্যাপ্ত মজুদ করা হয়েছে।তবে মশা নিধনের কাজ স্বাস্থ্যের নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, যতক্ষণ মশা নিধন না করা যাবে, ততক্ষণ চিকিৎসা ব্যবস্থা দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।আর সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, জ্বরসহ ডেঙ্গুর অন্য কোনও লক্ষণ উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্র হাসপাতালে যেতে হবে। দেরি করা হলেই বিপদ, সেটা গতবার আমরা দেখেছি।যত দ্রুত রোগ শনাক্ত হয়, তত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগীর জন্য মঙ্গলজনক, বলেন তিনি।অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কর্মকৌশল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাতে নিয়েছে, সেটা অতি শীঘ্রই সবাইকে জানানো হবে। সেইসঙ্গে জনসচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রমও হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ডেঙ্গুমুক্ত করতে জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল (২০২৪-২০৩০) হাতে নেওয়া হযেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ পরিকল্পনাটি গত ১৯ মার্চ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ কৌশলের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ও এ রোগে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা।সাত বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ কমিয়ে আনতে হবে, প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ একজন আক্রান্ত আর একজনের মৃত্যু।জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ডেঙ্গু স্থায়ী সমস্যা হতে যাচ্ছে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এর নিয়ন্ত্রণে এই কৌশলপত্র নেওয়া হয়েছে।ডেঙ্গু চিকিৎসায় নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই কৌশলপত্রে আরও বলা হয়েছে দ্রুত রোগ শনাক্ত করা, গুরুতর ডেঙ্গু সংক্রমণের সতর্কতা চিহ্ন চিহ্নিত করা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা হলো মৃত্যু হার এক শতাংশের কম করার মূল উপাদান।

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

পিআইডি ফিচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

ten − 6 =