‘তুফান’ ব্যবসাসফল ছবি

এবারের ঈদে মুক্তি পেয়েছে রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তুফান’ সিনেমা। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান। এবারই প্রথম রায়হান রাফী-শাকিব খান জুটির কাজ দেখতে পান দর্শক। সিনেমাটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও মুক্তি পেয়েছে। সাকিব মোর্শেদ খান এর প্রতিবেদন।

গল্প

রায়হান রাফী নিজের ক্যারিয়ারে এখন অব্দি যেসব সিনেমা নির্মাণ করেছেন প্রতিটি বেইজড অন ট্রু স্টোরি। এবার তিনি হাঁটলেন ভিন্ন পথে। নিজের চিরচেনা পথ থেকে বের হয়ে একটা গল্প ডেভেলপ করে সিনেমা করলেন। শাকিব খান মুখ্য চরিত্রে অভিনয় না করলে রায়হান রাফী নিজের চিরচেনা গল্প বলার ধরন থেকে বের হতেন কি না এটা প্রশ্ন থেকে যায়। সিনেমার গল্প চিরচেনা। বাংলা সিনেমায় এমন গল্প দেখাটা স্বাভাবিক। ‘তুফান’ সিনেমার গল্প আলাদা করা যায় এটার ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন দিয়ে। এমনভাবে আগে কেউ তুলে ধরার চেষ্টা করেননি। সিনেমার গল্প শান্ত নামের এক ছেলেকে কেন্দ্র করে। যার ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে শুধু অভিনয়। পর্দায় উপস্থিতি বা একটিমাত্র দৃশ্যে অভিনয় করার জন্য তার আপ্রাণ চেষ্টা। শান্তকে অভিনয় করতে সাহায্য করেন একজন কস্টিউম ডিজাইনার। শান্তর চেহারার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় এমন একজনের আবির্ভাব ঘটে। যিনি গ্যাংস্টার হতে চান। দুই মেরুর দুজন মানুষের জার্নি দেখা যায় সিনেমায়। চিত্রনাট্য করেছেন আদনান আদিব খান, যিনি ‘আয়নাবাজি’ সিনেমা যুক্ত ছিলেন। সিনেমার চিত্রনাট্য বেশ দুর্বল। সিনেমার গল্পে কোনো নতুনত্ব নেই।

অভিনয়

একঝাঁক তারকা ছিল সিনেমায়। সিনেমার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান। সিনেমায় ডাবল ক্যারেক্টার প্লে করেন তিনি। ‘গালিব বিন গনি’ একজন মাফিয়া কিংপিন এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী, তাকে সবাই মাফিয়া নামে চিনে। ‘শান্ত’ একজন উচ্চাকাক্সক্ষী অভিনেতা এবং তুফানের মতো দেখতে। নায়িকা হিসেবে দেখা যায় দুই বাংলার দুই নায়িকাকে। ‘সূচনা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন কলকাতার মিমি চক্রবর্তী আর ‘জুলি’ চরিত্রে মাসুমা রহমান নাবিলা। সিআইডি অফিসার হিসেবে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু। এছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিশা সওদাগর, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত, এ কে আজাদ সেতু, হাসনাত রিপন, গাউসুল আলম শাওন।

শুরুতেই বলতে হয় শাকিব খানের কথা। তিনি সুযোগ পেলে নিখুঁত অভিনয় করতে জানেন। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শাকিব খান নিজের চরিত্রটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ডায়ালাগ ডেলিভারি থেকে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কিংবা ইমোশন সবকিছুতে তিনি পরিপক্ব হয়ে উঠেছেন। ‘আয়নাবাজি’র পর নাবিলাকে বড় পর্দায় দেখা গেলো ‘তুফান’ সিনেমায়। তিনি সিনেমায় একজন কস্টিউম ডিজাইনার। ন্যাচারাল অভিনয় করেছেন তিনি। মিমি চক্রবর্তীর জায়গায় অন্য কেউ অভিনয় করলে বিরাট পার্থক্য হতো না। দেশের যেকোনো নায়িকাকে দিয়ে অভিনয় করানো যেতো। কিন্তু মিমি চক্রবর্তী গানগুলোতে নাচে যে দক্ষতা দেখিয়েছেন সেটা এদেশের কোনো অভিনেত্রী দেখাতে পারতেন কি না এটা নিয়ে সন্দেহ আছে। চঞ্চল চৌধুরীর আবির্ভাব ঘটে সিনেমার একাংশ শেষ হওয়ার পর। এসি আকরাম চরিত্রে তিনি স্ক্রিনে আসার পর থেকে সিনেমা নতুন মাত্রা পায়। চঞ্চল চৌধুরীকে অনেক পরে ব্যবহার করা হয়েছে, এটা আফসোসের। মিশা সওদাগর, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত, এ কে আজাদ সেতু, হাসনাত রিপনের মতো অভিনেতাদের অভিনয়ের স্পেস খুবই কম ছিল। তবুও যতটুকু সময় স্ক্রিনে ছিলেন অনবদ্য পারফরম্যান্স করেছেন। গাজী রাকায়েত এক কথায় অসাধারণ পারফর্ম করেছেন। সিনেমায় গাউসুল আলম শাওনের অভিনয় মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। স্ক্রিনে আসলে মনে হয়েছে কখন যাবেন তিনি।

টেকনিক্যাল দিক

সিনেমায় ক্যামেরা হাতে মুগ্ধ করেছেন তাহসিন রহমান। টেকনিক্যাল পার্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে ক্যামেরার কাজ। রায়হান রাফীর সঙ্গে বড় পর্দায় এবারই প্রথম কাজ করলেন তিনি। প্রথমবারের মতো দুজন জুটি বেঁধে কাজ করে দারুণ ভিজ্যুয়াল দেখিয়েছেন। সিনেমার আর্ট ডিরেকশন নিয়ে বলার সুযোগ রয়েছে। শিল্পনির্দেশক হিসেবে যুক্ত ছিলেন শিহাব নূরুন নবী। ‘তুফান’ বড় ক্যানভাসের সিনেমা। গল্পে আর্টের বিশাল বড় একটা ভূমিকা ছিল যা শিহাব নূরুন নবী দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। সিনেমায় শাকিব খানের যে লুক, তার কারিগর ফারজানা সান। কস্টিউম ডিপার্টমেন্ট সামলেছেন ফারজানা সান। শাকিব খানকে ভিন্ন রূপে হাজির করেছেন তিনি। সিনেমার কস্টিউমে ত্রুটি নেই। সম্পাদনায় বাংলাদেশ ও কলকাতার তিনজন কাজ করেছেন। কালার গ্রেডিং থেকে এডিটিংয়ে ছিল পরিপক্বতার ছাপ।

সংগীত

‘তুফান’ পুরোদমে কমার্শিয়াল সিনেমা। বাংলা সিনেমায় বহুদিন পর বাণিজ্যিক ছবির গান এতো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সিনেমার ‘লাগে উড়া ধুরা’ ও ‘দুষ্টু কোকিল’ শিরোনামের গান সকলের মুখে মুখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল। আরাফাত মহসীন নিধি সামলেছেন সংগীত। দুটি গানের সুর ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তার করা। সিনেমার সম্পূর্ণ বিজিএমও তার তৈরি। সিনেমাটি দর্শকদের যে কয়েকটা কারণে টেনেছে তার মধ্যে একটি সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। সিনেমায় হাবিব ওয়াহিদ ও রেহান রাসুলের কণ্ঠে দুটি গান রয়েছে। হাবিব ওয়াহিদের কণ্ঠে ‘ফেঁসে যাই’ শিরোনামের গানটি বেশ শ্রুতিমধুর ছিল।

নির্মাণ

রায়হান রাফীর নির্মাণে একটা নিজস্বতা আছে। একটা স্টাইল সেট করে ফেলেছিলেন তিনি। বলার একটা প্যাটার্ন আছে। নির্মাণের জায়গা থেকে ‘তুফান’ সিনেমায় এটার অভাব আছে। একজন দর্শক হিসেবে এটা রায়হান রাফীর সিনেমা মনে হয়নি। শাকিব খানের সিনেমার দর্শক শ্রেণির কথা মাথায় রেখে হয়তো তিনি এমনভাবে পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু একজন নির্মাতা হিসেবে অবশ্যই তার সিগনেচার স্টাইল ধরে রাখা উচিত ছিল।

নেগেটিভ দিক

সিনেমার সবচেয়ে দুর্বল দিক গল্প। শুরু থেকে শেষপর্যন্ত গল্প বোঝা বেশ কষ্টসাধ্য। সিনেমার প্রথম ভাগ খুবই ধীরগতিতে এগিয়েছে। যা কিছুটা একঘেয়েমিতে ভুগিয়েছে। আরও বড় দুর্বলতার জায়গা ডায়ালগ। সংলাপ নিয়ে আরেকটু ভাবার সুযোগ ছিল। নির্মাতার কাজে একটা তাড়াহুড়ার ব্যাপার ছিল। সিনেমায় বাংলাদেশের অনেক বড় অভিনয়শিল্পী অভিনয় করেছেন যাদের যথার্থ ব্যবহার করতে পারেননি নির্মাতা। মাত্রাতিরিক্ত অ্যাকশন দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সিনেমার প্রোমোশন দেখে যতটা মনে হয়েছিল তা দেখা যায়নি।

পজিটিভ দিক

পজিটিভ দিক হচ্ছে বাজেট পেলে দেশেই বিশাল ক্যানভাসে সিনেমা নির্মাণ করা যায় এমন বার্তা পাওয়া গেছে। রায়হান রাফী প্রমাণ করে দিয়েছেন অ্যাকশন সিনেমা নির্মাণ করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি শাকিব খানের দক্ষ অভিনয় এবং অ্যাকশন হিরো হিসেবে আত্মপ্রকাশ। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি অভিনয় জানেন। রায়হান রাফী সিনেমার শেষাংশে সিনেমার দ্বিতীয় কিস্তি আনার ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ‘তুফান’ এর মতো সিনেমা ব্যবসাসফল হওয়া প্রয়োজন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালজি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 + 16 =