বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রায়হান রাফীর নতুন সিনেমা ‘তুফান’ পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। দেশের বাইরেও সিনেমাটি দর্শকদের মাঝে সাড়া ফেলেছে। ভিন্ন রূপে শাকিব খানের উপস্থিতি এই সিনেমাকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গিয়েছে। রায়হান রাফীর সিনেমা মুক্তির পর বলা হচ্ছিল, সিনেমার সঙ্গে কাজ করা গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সকলেই ভারতের। কিন্তু নির্মাতা, প্রধান অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি সিনেমার পিছনে কাজ করেছেন বাংলাদেশের একঝাঁক গুণী কলাকুশলী। ‘তুফান’ সিনেমায় অন্তরালে কাজ করা মানুষদের কথা জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।
ক্যামেরায় তাহসিন রহমান
‘তুফান’ সিনেমার টেকনিক্যাল পার্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ক্যামেরার কাজ। সিনেমাটোগ্রাফি মুগ্ধ করেছে সব শ্রেণির দর্শকদের। তাহসিন রহমান পরীক্ষিত চিত্রগ্রাহক। বিজ্ঞাপন পাড়ায় নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন অনেকবার। নিজেকে মেলে ধরেছেন ওটিটি প্লাটফর্মেও। শঙ্খ দাসগুপ্তের ‘বলি’ ওয়েব সিরিজ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘সামথিং লাইক এন অটোবায়োগ্রাফি’ ওয়েব ফিল্মের চিত্রগ্রাহক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন তিনি। নুহাশ হুমায়ূনের হরর অ্যান্থোলজি সিরিজ ‘পেট কাটা ষ’ তে কাজ করে সকলের কাছ থেকে পেয়েছিলেন প্রশংসা। রায়হান রাফীর সঙ্গে বড় পর্দায় এবারই প্রথম কাজ করলেন তাহসিন। বড় পর্দায় এবারই চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। প্রথমবারেই নিজের জাত চিনিয়েছেন। কিছু দৃশ্যে নিজের আগের করা সব কাজ ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তাহসিন রহমান নিজের কাজটা করেছেন দক্ষতার সাথে।
মিউজিকে আরাফাত মহসীন নিধি
রায়হান রাফীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আরাফাত মহসীন নিধি। ‘সুড়ঙ্গ’ আর ‘দামাল’ সিনেমায় মিউজিকের দায়িত্ব ছিলেন। সংগীত অঙ্গনে আরাফাত মহসীন নিধি পরিচিত নাম। এক যুগ ধরে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। নিজেকে প্রমাণ করেছেন বারবার। বড় পর্দায় কাজ করার পর সেখানেও নিজেকে মেলে ধরেছেন আলাদা ভাবে। তুফান সিনেমার ‘লাগে উড়া ধুরা’ ও ‘দুষ্ট কোকিল’ শিরোনামের গানে উত্তাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। দুটি গানের সুর ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছেন আরাফাত মহসীন নিধি। সিনেমার সম্পূর্ণ বিজিএম তার করা। তুফানের গল্পটা আলাদা করে দর্শকদের যে কয়েকটা কারণে টেনেছে তার মধ্যে একটি সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। তুফান সিনেমা যে ঘরানার সেখানে মিউজিক নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। সেখানে আরাফাত মহসীন নিধি নিজেকে আবারও প্রমাণ করলেন। রায়হান রাফী ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমার টেকনিক্যাল টিম থেকে শুধুমাত্র মিউজিক টিমের একজনের ওপর ভরসা রেখেছিলেন, তিনি হচ্ছেন আরাফাত মহসীন নিধি। হতাশ করেননি তিনি। সব শ্রেণির দর্শকদের মাঝে গান জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সিনেমায় হাবিব ওয়াহিদ ও রেহান রাসুলের কণ্ঠে গাওয়া গান দুটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সম্পূর্ণ সিনেমার সংগীত আয়োজন এককথায় মুগ্ধ হওয়ার মতো।
সম্পাদনায় জোবায়ের আবীর পিয়াল
দারুণ গল্পের একটা সিনেমা শুধুমাত্র খেই হারিয়ে ফেলে সঠিক সম্পাদনার অভাবে। ‘তুফান’ সিনেমার সম্পাদনার জন্য রায়হান রাফী আস্থা রেখেছিলেন জোবায়ের আবীর পিয়ালের ওপর। তিনি আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন। ‘তুফান’ সিনেমায় চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন আবীর। ইতিপূর্বে ওটিটিতে ‘আগস্ট ১৪’, ‘মহানগর’, ‘সাবরিনা’, ‘সিন্ডিকেট’, ‘আরারাত’ এর মতো ওয়েব সিরিজ সম্পাদনা করেছেন। ওটিটি প্লাটফর্মের দর্শকপ্রিয়তা পাওয়া বেশকিছু কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। নিজের কাজের প্রমাণ দিয়েছেন বহুবার। বড় পর্দায় নিজেকে আবার প্রমাণ করলেন আগের মতোই। রায়হান রাফীর সঙ্গে বড় পর্দায় এবারই প্রথম কাজ করলেন তিনি। রায়হান রাফী নিজের প্রতিটি কাজে এডিটিংয়ে আলাদা যত্ন নিয়ে থাকেন। সেখানে এবার যুক্ত হয়েছেন আবীরের মতো দক্ষ মানুষ। দুজনে মিলে এডিটিং ডিপার্টমেন্টে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। দর্শকদের স্ক্রিনে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে যেসব বিষয় তার মধ্যে অন্যতম সিনেমার এডিটিং। নিখুঁত কাজের ছাপ দেখা গিয়েছে সিনেমার শেষ সিকুয়েন্স পর্যন্ত।
আর্ট ডিরেকশনে শিহাব নূরুন নবী
সিনেমার কঠিন কাজগুলোর একটি শিল্পনির্দেশনা। ‘তুফান’ সিনেমার গল্পে আর্টের বিশাল বড় একটা ভূমিকা ছিল। সম্পূর্ণ সেট দারুণ শিল্পনির্দেশনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন শিহাব নূরুন নবী। তিনি বর্তমানে দেশের প্রথম সারির শিল্পনির্দেশকদের মধ্যে একজন। নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বর্তমান সময়ে ওটিটি প্লাটফর্মে নিজের প্রতিভার জানান দিচ্ছেন তিনি। রায়হান রাফী আর্ট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব দিয়েছেন যোগ্য মানুষের হাতে। ‘তুফান’ সিনেমা যে ক্যানভাসে তৈরি হয়েছে সেখানে খানিকটা বেগ পেতে পারতেন শিহাব নূরুন নবী। কিন্তু না, তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। সিনেমার প্রতিটি সিকুয়েন্সে আর্টের কাজে ছিল পরিপক্বতার ছাপ। বড় পর্দায় এবারই প্রথম রায়হান রাফীর সঙ্গে কাজ করলেন তিনি। প্রথমবারেই নিজের দক্ষতার ছাপ রেখে গিয়েছেন। তিনি নিজেকে বড় পর্দায় প্রমাণ করেছেন কাজের মাধ্যমেই। রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত পরিচালিত ‘নোনা জলের কাব্য’ সিনেমায় কাজ করে শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্দেশক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন শিহাব নূরুন নবী।
কস্টিউম ডিপার্টমেন্টে ফারজানা সান
ফারজানা সান বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতে পরিচিত মুখ। ২০০৫ সালে প্রথমে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করলেও ২০০৮ সাল থেকে কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে যাচ্ছেন। বিগত কয়েক বছর যাবত বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বড় পর্দায় কাজ করছেন তিনি। ‘তুফান’ সিনেমায় শাকিব খানকে ভিন্ন রূপে হাজির করার সম্পূর্ণ ক্রেডিট দিতে হয় ফারজানা সানকে। শাকিব খানের লুক দেখে মুগ্ধ না হওয়ার সুযোগ নেই। সিনেমায় শাকিব খানের লুক এবং চঞ্চল চৌধুরীর কস্টিউম নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। ফারজানা সান নিজেকে প্রমাণ করেছেন বহু আগেই। বড় ময়দান পেলে নিজেকে তিনি আরো বড় পরিসরে মেলে ধরতে জানেন তা প্রমাণ পেয়েছে ‘তুফান’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। এর আগে ‘আয়নাবাজি’ সিনেমায় কাজ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও ‘বিউটি সার্কাস’ সিনেমায় জয়া আহসানের সার্কাস কর্মীর লুক করেছিলেন তিনি। ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজে অঙ্গসজ্জার দায়িত্ব পালন করেছিলেন কস্টিউম ডিজাইনার ফারজানা সান। বর্তমানে তিনি বিজ্ঞাপনে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।
দেশে অসংখ্য গুণী মানুষ রয়েছেন যারা পর্দার আড়াল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। সকলেই একেকজন তারকা তাদের অঙ্গনে। তাদের কাজের প্রতি ভালোবাসা আর চেষ্টা আপনাকে বিস্মিত করবে। যার প্রমাণ ‘তুফান’ সিনেমার টেকনিক্যাল টিম। সকলের অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে একটি সম্পূর্ণ সিনেমা। অনেকেই বলছেন, এত কোটি টাকায় ওই দেশে এটা হয়েছে আর আমাদের দেশে মাত্র এত কোটি টাকায় ‘তুফান’ নির্মাণ হয়েছে। আমাদের দেশে পর্দার পিছনে কাজ করা প্রতিটি ব্যক্তি অত্যন্ত মেধাবী। শুধুমাত্র সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন তারা। তাদের বড় পরিসরে কাজে লাগানোর সময় এসে গেছে। আমরা অদূর ভবিষ্যতে তাদের হাত ধরেই বিশ্বমানের কাজ দেখার স্বপ্ন দেখতেই পারি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে