তোরা সব জয়ধ্বনি কর

সালেক সুফী: দক্ষিণ আফ্রিকার মতো তুখোড় দলকে তিন ম্যাচের  ওডিআই  সিরিজ ২-১  জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে  বাংলাদেশ। ওদের আঙিনায় এই জয় নানা কারণেই বিশ্ব ক্রিকেটের বিস্ময় সৃষ্টি করলো। আমি উল্লসিত, আমি গর্বিত।  স্বাধীনতা সংগ্রামের মাসে বাংলার বাঘেরা গর্জে উঠেই আফ্রিকা জয় করেছে। ২০ বছর যে দেশের মাটিতে জয় ছিল অধরা সেখানেই দৌর্দণ্ড প্রতাপে প্রথম আর শেষ ম্যাচটি জিতে বাংলাদেশ ২-১ সিরিজ জিতে নিয়েছে। দুরন্ত তাসকিনের (৫/৩৫)  তোপে  এবং সাকিবের (২/২৪) স্বভাব সুলভ নিয়ন্ত্রিত কিপ্টে বোলিং দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস সীমিত রেখেছিলো ১৫৪ রানে। তখন থেকেই স্বপ্নের জাল বোনা।  ৯ উইকেটে ম্যাচ জয় করে ক্রিকেটে বাংলাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকা ফ্রন্ট জয় করা হলো। তামিম ছিল স্বমূর্তিতে সক্রিয়, লিটন এখন বিকশিত হচ্ছে ফুটন্ত টিউলিপের মতোই। ১২৭  রানের দর্শনীয় মাইল ফলক স্থাপন করা প্রথম উইকেট পার্টনারশিপ বাংলাদেশকে হেসে খেলে জয় এনে দেয়। তামিমের ইনিংসটি ছিল অনুপম ব্যাটিং শৈলীর প্রদর্শনী। লিটন সাহচর্য দিয়েছে বিশস্ত সহচরের মতো। আরো একটি অর্ধশত রানের দুয়ার থেকে ৪৮ রানে ফিরেছে। বাংলাদেশের ৯ উইকেটের দাপুটে জয়ে ছিল ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’ ধ্বনির প্রতিধ্বনি। সিরিজ জুড়েই ছিল আমারও পারি মনোভাব। প্রথম ম্যাচে ৩৮ রানে জয়ে ইতিহাস সৃষ্টি, দ্বিতীয় ম্যাচে ৭ উইকেটে হেরেও শেষ ম্যাচে ৯ উইকেটে জয় ক্রিকেট বিশ্বকে জানিয়ে দিলো বাংলাদেশ এখন যে কোনো দেশে জিততে শিখেছে। তামিমের অপরাজিত ৮৭ রান ছিল আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। এই সিরিজে দলের প্রতি সদস্যের কোনো না কোনো অবদান ছিল।

অভ্র মেলবোর্ন থেকে ফক্স টেলিভিশনের লিংক পাঠানোয় জয়ের উল্লাসে সাথী হয়েছি। যেদিন থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটে সংযুক্ত হয়েছি স্বপ্নের জাল বুনেছি কখন আমাদের সোনার ছেলেরা বিশ্ব জয় করবে। এই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই বাংলাদেশের যুবারা বিশ্ব জয় করেছিল। আজ আবার সেখানেই উড়লো বিজয় কেতন। আমাদের বন্ধু ইকবালের ছেলে তামিমের নেতৃত্বে ১১ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন হাজার হাজার মাইল দূরে কুইন্সল্যান্ডের লোগান সিটিতে বসে যেন শুনতে পারছি।   সকালের সূর্য ওঠার আর বেশি বাকি নেই।  রাত জাগা চোখ ঘুমে কাতর।  বাংলাদেশিরা যেখানেই আছো  ‘তোরা যে যেখানে আছিস জয়ধ্বনি কর’। এই তো সেদিন ভারতের দুর্ধর্ষ দল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ধবল ধোলাই হয়ে ফিরেছে। পূর্ণ শক্তির প্রোটিয়া দলের বিরুদ্ধে এই সিরিজ জয় নানা কারণেই নতুন মাইল ফলক হয়ে থাকবে। শতকরা শতভাগ বিজলি আলোজ্বলা বাংলাদেশ এখন উৎসব মুখর।

আজ লিখেছিলাম খেলার আগে একটি জয় বাংলাদেশকে পাল্টে দিবে। সুপারস্পোর্টস পার্কে প্রথম ম্যাচটি যখন দাপটে জিতে নতুন মাইলে ফলক রচেছিলো বাংলাদেশ তখন থেকেই স্বপ্নের জাল বোনা শুরু। দ্বিতীয় ম্যাচে রাবাদা ঝড়ে উড়ে যাবার পর লিখেছিলাম দু দিনেই চাঁদের দুপিঠ দেখলো বাংলাদেশ। আজ কিন্তু শুরু থেকেই কৃতকল্প ছিল গোটা দল জয়ের নেশায়। ঠিক যেমন ১৯৭১ মার্চে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশ জয়ের নেশায়। ৫১ বছর পর দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে বাতাসে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি।

বাংলাদেশের ২০২১ ভালো সময় যায় নি। সব ফরম্যাটে বাংলাদেশের জন্য দুর্যোগ ছিল। টি২০ বিশ্ব কাপে তলানিতে, দেশের মাটিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভরাডুবি। ২০২২ শুরু হতেই পাল্টে যেতে শুরু করলো। সাকিব, তামিম, মাহমুদুল্লাহ ছাড়াই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়ন নিউ জিল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে টেস্ট জয় করে নতুন ফ্রন্ট জয় করলো বাংলাদেশ। দেশে ফিরে জিতে নিলো ওডিআই সিরিজ আফগানিস্তানের সঙ্গে। দক্ষিণ আফ্রিকা দক্ষিণ এশিয়ার দলগুলোর জন্য চিরদিনের  দুর্গম দুর্গ।  বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা দলের দুইজন আইকন খেলোয়াড় অ্যালেন ডোনাল্ড এবং এলবি মর্কেলকে দলে পেলো। যেন জিওন কাঠির পরশে বদলে গেলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যখন থেকে পেসি বাউন্সি উইকেটে খেলার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে তখন থেকেই তাসকিন, শরিফুল, মুস্তাফিজ দলের জয়ে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এই দলটিকে পরিচর্যা করা হলে বিশ্ব কাপে ডার্ক হর্স বিবেচিত হবে।

কিছুটা শঙ্কা ছিল হয়তো আজ উইকেটটি পেসি বাউন্সি হবে।  উইকেটে প্রাণ ছিল। টস জয় করলে কি করতো বাংলাদেশ জানিনা।  মনে করি টস হারাতেই সৌভাগ্য লুকিয়ে ছিল। টস জয়ী বাভুমা ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলো। ঝড়ের গতিতেই শুরু করেছিল ডি কক আর মালান, সাজানো কৌশলেই ডি কককে ফেরানোর পর দুরন্ত গতির সঙ্গে সুইঙের বিষ মিশিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলো তাসকিন। সাথে সাকিবের মুন্সিয়ানা। ১৮.১ ওভারেই ৫ উইকেট হারিয়ে ধুকতে শুরু করলো প্রোটিয়া বাহিনী। দুধর্ষ মিলার, প্রেটোরিয়াস, রাবাদার উইকেট তুলে নিয়ে একাই ধসিয়ে দিলো তাসকিন। ওর ওডিআই ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বারের মতো ৫ উইকেট। একজন মানুষ যুদ্ধ করে কিভাবে ফিরে আসে তার জ্বলন্ত উদাহরণ তাসকিন। ছেলেটা আইপিএলে আমন্ত্রণ পেয়েছিলো। দেশের খেলার কথা ভেবে বিসিবি ওকে টেস্ট সিরিজের জন্য ধরে রেখেছে। যেভাবে বোলিং করছে কত সুযোগ ওর পায়ে লুটাবে। ১৫৪ রানে গুটিয়ে গেলো দক্ষিণ আফ্রিকা।  এই উইকেটে এমন কিছু দৈত্যদানব ছিল না। অতিমানবীয় বোলিংকরেই তাসকিন ওদের মুদ্রায় দক্ষিন আফ্রিকাকে পরাস্ত করলো।

বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। যে উইকেটে তাসকিন ঝড় তুলেছে সেখানে তুখোড় রাবাদা স্বস্তি দিবে না অনুমিত ছিল। প্রথম দুই একটি ওভার কিছু বল আতঙ্কের ছিল। প্রাথমিক নার্ভ কেটে যাবার পর আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগলো। তামিম লিটন দৃঢ়তার সঙ্গে জয়ের ভিত্তি গড়ে দিলো। তামিম, লিটনের কিছু শট ছিল চেয়ে দেখার মতো। তামিমকে তামিমের মতো দেখলাম। এই তামিমকেই সব সময় চায় বাংলাদেশ।

সাবাশ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।  বাংলাদেশকে আবারো বিশ্ব সভায় গর্বিত করার জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two + seven =