দক্ষিণের দামি সুপার স্টার: থালাপতি বিজয়

দক্ষিণী সিনেমার সুপারস্টার থালাপতি বিজয়ের সিনেমা বেশ উপভোগ করেন দর্শক। তার সিনেমা মানেই ভক্তদের মনে নতুন উন্মাদনা। এই সুপারস্টারকে নিয়ে মৌ সন্ধ্যার প্রতিবেদন।

থালাপতি অর্থ

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের সিনেমাগুলো গত এক দশকে বেশ শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। তামিল, তেলেগু ও মালায়লাম ভাষার সেসব সিনেমার গল্প আর নির্মাণশৈলি বাজিমাত করছে একের পর এক। এমন নয় যে, অতীতে এসব ইন্ডাস্ট্রি সফল ছিল না। তবে আগে এখানকার সিনেমার জনপ্রিয়তা ও বাজার ছিল দক্ষিণ ভারতেই। এখন সেটা পুরো ভারত, দক্ষিণ এশিয়া এমনকি অন্যান্য দেশেও উল্লেখযোগ্য পরিচিতি লাভ করেছে। সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমার এই উত্থান যাদের হাত ধরে হয়েছে, যেসব তারকা নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, তাদের মধ্যে একজন বিজয়। সিনে দুনিয়ায় তাকে বলা হয় থালাপতি বিজয়। ‘থালাপতি’ অর্থ নেতা। অর্থাৎ বিজয়কে বলা যেতে পারে এ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক।

কে বিজয় থালাপতি?

বিজয়ের আসল নাম জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখর। ১৯৭৪ সালের ২২ জুন তিনি তামিলনাড়ুর মাদ্রাজে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এস এ চন্দ্রশেখর, যিনি তামিল সিনেমার একজন সফল নির্মাতা ও প্রযোজক। বিজয়ের মা শোবা একজন কণ্ঠশিল্পী। ছোটবেলায় বিজয় বেশ চঞ্চল ও বাকপটু ছিলেন। সারাক্ষণ নানা রকম কথা বলতেন আর দুষ্টামি করতেন। কিন্তু ছোটবেলায় বোন বিদ্যার মৃত্যুর ঘটনায় বড় আঘাত পান বিজয়। এরপর থেকেই তিনি চুপচাপ হয়ে যান। ফাতিমা ম্যাট্রিকুলেশন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল দিয়ে বিজয়ের পড়াশোনা শুরু। এরপর বালালোক ম্যাট্রিকুলেশন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ও লয়োলা কলেজে পড়েছেন তিনি। কিন্তু পাঠ্যজীবনে তার ব্যর্থতাই ছিল বেশি। পড়ার প্রতি তার কোনো মনোযোগ ছিল না। বিজয়ের ধ্যান-জ্ঞান সবজুড়ে ছিল শুধু অভিনয়।

দশ বছর বয়সে অভিনয়ে

সিনে পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিজয় থালাপতির। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিজয়ের মনে অভিনয়ের ইচ্ছে জন্মায়। ১০ বছর বয়সে বিজয় প্রথমবার অভিনয় করেন। ১৯৮৪ সালে বাবার নির্মিত ‘ভেত্রি’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেন তিনি। তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ আর দক্ষতার সুবাদে আরও বেশ কিছু সিনেমায় শিশুশিল্পীর চরিত্রে কাজের সুযোগ পান। ‘কুদুমবাম’, ‘ভাসান্তা রাগাম’, ‘সাত্তাম অরু ভিলাইয়াট্টু’ ও ‘ইথু ইংগাল নীতি’ সিনেমাগুলোতে শিশু বিজয়কে দেখা গেছে। সুপারস্টার রজনীকান্তের ‘নান সিগাপ্পু মানিথান’ সিনেমাতেও শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

ক্যারিয়ারে নতুন মোড়

১৯৯২ সালে বিজয় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ‘নালাইয়া থিরপু’ নামের সেই সিনেমাও নির্মাণ করেছিলেন তার বাবা এস এ চন্দ্রশেখর। এরপর আরও দুটি সিনেমায় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন বিজয়। সিনেমাগুলো উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি। ১৯৯৪ সালে আসে সেই সাফল্য। সিনেমার নাম ‘রাসিগান’। অবশ্য এটি বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করলেও সমালোচকদের কাছে প্রশংসা পায়নি। তবে এই সিনেমার মাধ্যমেই বিজয়ের নামের পাশে ‘ইলায়া থালাপতি’ শব্দটা যুক্ত হয়। যার অর্থ তরুণ নেতা। পরবর্তীতে এই উপাধি ‘থালাপতি’ বা নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালের ‘পুভে উনাক্কাগা’ সিনেমায় অভিনয় করে বিজয় প্রশংসা এবং বক্স অফিস সাফল্য দুটোই লাভ করেন। এর মাধ্যমে তিনি তারকা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হন। ২০০০ সালের পর বিজয় সিদ্ধান্ত নেন, কমেডি ধাঁচের সিনেমা বেশি করবেন। তার পথ ধরে অনেকেই সেই দিকে ঝুঁকে পড়েন। কমেডি সিনেমা তখন সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমায় ট্রেন্ডে পরিণত হয়ে যায়। তার অভিনীত ‘ফ্রেন্ডস’, ‘বাদ্রি’, ‘শাহজাহান’, ‘থামিজান’ ইত্যাদি সিনেমার কথা দর্শকরা মনে রাখবে অনেক দিন।

যতো সিনেমা

বিজয় তার সাফল্যময় ক্যারিয়ারে ৬৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে সফল সিনেমার সংখ্যাই বেশি। ‘থুপ্পাক্কি’, ‘বিগিল’, ‘মেরসাল’, ‘মাস্টার’, ‘থেরি’, ‘নানবান’, ‘সরকার’, ‘জিল্লা’, ‘ভেলায়ুধাম’, ‘ঘিল্লি’, ‘পক্কিরি’, ‘পুলি’, ‘কাভালান’, ‘থুল্লাধা মানামুম থুল্লাম’, ‘ভেট্টাইকারান’, ‘বৈরাভা’, ‘থালাইভা’, ‘সাঁচে’, ‘শিবাকাশি’, ‘কুশি’, ‘সুরা’, ‘নেররাক্কু নের’, ‘বিল্লু’, ‘ভগবতী’, ‘কুরুভি’ সিনেমাগুলো বিজয়ের নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে। বর্তমানে তামিল সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মানী পাওয়া অভিনেতা বিজয়।

গানের শিল্পী

শুধু অভিনয়ই নয়, বিজয় গানেও দারুণ দক্ষ। তামিল অভিনেতাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ভালো কণ্ঠশিল্পী। তিনি বহু সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন। গান করেছেন এ আর রাহমান, দেবা, ইলাইয়ারাজা, যুবা শঙ্কর রাজা, বিদ্যাসাগর, রামানা গগুলা ও সান্তোষের মতো সঙ্গীত পরিচালকের মিউজিকে। ১৯৯৪ সালে ‘রাসিগান’ সিনেমার মাধ্যমে বিজয় প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর দুই ডজনের বেশি গান করেছেন তিনি।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

অভিনয়ের জন্য বিজয় বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে তামিলনাডু সরকারের কাছ থেকে ‘কালাইমনী’ পুরস্কার পান। এরপর ২০০৭ সালে তিনি ড. এম জি আর এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া তিনি দুইবার তামিলনাড়ু স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস, ৯ বার বিজয় অ্যাওয়ার্ডস এবং ৪ বার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস সাউথ অর্জন করেছেন।

সংসার জীবন

ব্যক্তিগত জীবনে বিজয় বিয়ে করেছেন সঙ্গীতা স্বর্নালীগামকে। ১৯৯৯ সালে লন্ডনে সঙ্গীতার সঙ্গে দেখা হয় বিজয়ের। এরপর তারা বিয়ে করেন। বর্তমানে তাদের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

টাকার মেশিন

গত ৫ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়েছে বিজয়ের বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’। ভেঙ্কেট প্রভু পরিচালিত সিনেমাটি মুক্তির পর থেকে সমালোচকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেলেও বক্স অফিস থেকে আয় তুলে নিতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। চরিত্রগুলোর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এবং টুইস্টের জন্য সিনেমাটি প্রশংসিত হলেও এর দৈর্ঘ্য এবং সাদামাটা প্রথমার্ধের জন্য সিনেমাটির কপালে জুটেছে সমালোচনাও। এরপরও সিনেমাটি বক্স অফিস থেকে ভালো আয় করেছে। সিনেমাটি গত ১০ অক্টোবর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পঞ্চম সপ্তাহ পূর্ণ করেছে। ১১ অক্টোবর পর্যন্ত এটি ভারতের বাজার থেকে মোট ৩০৩ দশমিক ৪১ কোটি রুপি আয় করেছে। ভারতের বাইরের হলগুলো থেকে এর মোট আয় হয়েছে ১৬১ কোটি রুপি। অর্থাৎ মুক্তির পর প্রথম ৩৬ দিনে সিনেমাটি মোট আয় দাঁড়িয়েছে ৪৬৪ দশমিক ৪১ কোটি রুপি। ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ সিনেমার ৩৬ দিনে  ৪৬৫ কোটি রুপি আয়, এক বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে।

রাজনীতিতে

কয়েক বছর ধরেই ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও সিনেমা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন এই তারকা। বিজয় তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। একজন রাজনীতিবিদ হয়েই মানুষের সেবা করার পণ করেছেন তিনি। চলতি বছর লোকসভা ভোটের শুরুর দিকে বিজয় ঘোষণা দিয়েছেন তার রাজনৈতিক দলের নাম। অভিনেতা দলের নাম রেখেছেন ‘তামিলাগা ভেটরি কাজাগম’। অভিনেতার লক্ষ্য ২০২৬-এর তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচন।  ফলে রাজনীতিতে ব্যস্ততা বাড়বে তার।

শেষ সিনেমাতে চমক

ঘোষণা অনুযায়ী বিজয় অভিনীত ক্যারিয়ারের শেষ সিনেমা ‘থালাপতি ৬৯’। জানা গেছে, দক্ষিণী সুপারস্টার থালাপতি বিজয় ক্যারিয়ারের শেষ সিনেমা ‘থালাপতি ৬৯’ এর জন্য ২৭৫ কোটি টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছেন। যার ফলে শাহরুখ খান, সালমান খান, প্রভাস কিংবা রজনীকান্তকে পিছনে ফেলে এইমুহূর্তে ভারতীয় সিনেমার সবচেয়ে ‘দামি’ তারকা তিনি। বহু বছর ধরেই দক্ষিণী তারকাদের মধ্যে রাজ করছেন বিজয়। ভারতজুড়েও তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে এই অভিনেতার সবশেষ ছবি ‘লিও’ ও ‘দ্য গোট-গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ চোখের পলকেই ১০০ কোটির বক্স কালেকশন পার করেছে।

রেকর্ড ভেঙেছিল ‘লিও’

২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর মুক্তি পায়  থালাপতি বিজয়ের সিনেমা ‘লিও’। আর মুক্তির প্রথম দিনেই বিভিন্ন রেকর্ড ভেঙে বক্স অফিসে গর্জন তুলে সিনেমাটি। অগ্রিম টিকিট বিক্রিতে ‘জওয়ান’কে পেছনে ফেলে দেয় লিও। সে সময় বাণিজ্য ওয়েবসাইট স্যাকনিল্কের বরাতে জানা যায়, ‘লিও’ মুক্তি পেতে না পেতেই ১৬ লাখ টিকিট বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমে বিজয়ের ‘লিও’ টপকে গেছে শাহরুখ খানের ‘জওয়ান’কে। অগ্রিম বুকিংয়ে সিনেমাটির টিকিট বিক্রি হয়েছিল  ১৫.৭৫ লাখ। অগ্রিম টিকিটের পর ইউএসএ প্রিমিয়ারের ক্ষেত্রেও দাপট দেখায় ‘লিও’। সেখানে সিনেমাটির বক্স অফিস আয় ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

২০২৩ সালের ব্লকবাস্টার জেলার, জওয়ান, পাঠান ও আরআরআরকেও টপকে যায় লিও সিনেমাটি। ‘লিও’র মার্কিন পরিবেশক সংস্থা জানিয়েছে,  সেখানকার এক হাজারের বেশি স্ক্রিনে মুক্তি পায় লিও। ৩১ কোটি আয় করে অগ্রিম বুকিং থেকে, যেখানে ‘জওয়ান’ অগ্রিম বুকিং থেকে ৪১ কোটি আয় করেছে। মূলত সিনেমা দুটির টিকিটের দামের পার্থক্যের কারণেই পিছিয়ে থাকে বিজয়। উদ্বোধনী দিনে ‘জওয়ান’-এর গড় টিকিটের মূল্য ছিল ২৫১ রুপি, যেখানে ‘লিও’র টিকিটের মূল্য ২০২ রুপি।

শেষ কথা

সব মিলিয়ে বলা যেতেই পারে দক্ষিণের সিনেমায় সবচেয়ে ধনী অভিনেতা বিজয়। তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ আনুমানিক ৪১০ কোটি রুপি। প্রতিবছর তিনি ১০০ থেকে ১২০ কোটি রুপি আয় করেন। শুধু সিনেমাই নয়, ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট থেকেও মোটা অঙ্ক আয় করেন এই অভিনেতা। বিজ্ঞাপন থেকেও বছরে আয় তার প্রায় ১০ কোটি রুপি। এ হিসাবে নায়ক যদি বছরে ২০০ কোটি রুপি পারিশ্রমিকের একটি ছবিও করেন তাহলে সব মিলিয়ে আর মাসিক আয় দাঁড়ায় ২০ কোটির ওপরে। তাই নেটিজেনরা বলছেন, আগের কিংবা বর্তমান পারিশ্রমিকে থালাপাতি বিজয়ের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪১০ কোটি নয় বরং আরও বেশি। সবই ঠিক আছে তবে এই নায়কের সিনেমা থেকে বিদায় নেওয়ার ব্যাপারটির মানতে পারছেন না ভক্তরা। সবার চাওয়া সিনেমাতে থাকুক বিজয়।

লেখটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − 10 =