দখল দূষণে ভাগাড়ে পরিণত ঢাকার চারপাশের নদী

সালেক সুফী

শিশুকাল থেকেই শুনেছি বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা শহর। শুধু ঢাকা কেন দুনিয়ার অধিকাংশ নগর মহানগরী কোনো না কোনো নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। কৈশোরে ঢাকা এসে দেখেছি তিলোত্তমা ঢাকা নগরের চারপাশে নয়নাভিরাম বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ, বুড়ি চার চারটি নদী।  যৌবন পেরিয়ে পৌঢ়ত্বে পৌঁছে দেখেছি পরিকল্পিত নগরায়ন না হওয়ায় দখল এবং দূষণে মহানগরীর প্রাণ নদীগুলো বিষাক্ত, পূতিগন্ধ ময় ভাগাড়ে পড়ন্ত হয়েছে।

অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্প কারখানা এবং মিউনিসিপাল বর্জ্য নদীর জলে মিশে নদীগুলো এখন জলজ প্রাণীর জীবনধারনের অনুপযুক্ত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া প্রবাস জীবনে মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, সিডনি, এডিলেডে দেখেছি পাশে থাকা নদীগুলো কি যত্নে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। কিভাবে নদীগুলো নদীভিত্তিক নগরায়ন করেছে।

দেশে ফিরে জীর্ণ, শীর্ণ, দূষিত ঢাকার নদীগুলো দেখে কষ্ট পাই। ইদানিং ১২০০ কোটি টাকা ব্যায়ে নদীর তীর রক্ষার একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। নদীগুলোর পাড় বরাবর ওয়াক ওয়ে পাশে সবুজ বৃক্ষ স্থাপন করে হয়তো শোভা বর্ধন করা যাবে। কিন্তু সমন্বিত ভাবে নদীগুলোতে শিল্প এবং মিউনিসিপাল বর্জ্য নিষ্কাশন অবিলম্বে বন্ধ করা না গেলে মৃতপ্রায়  নদীগুলো  একসময় স্মৃতি হয়ে যাবে।

আমি জানি নদীগুলো রক্ষায় সরকার প্রধান আন্তরিক, পরিবেশবিদ, বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার। আছে বেশ কিছু সংস্থা, এনজিও। বাংলাদেশের উন্নয়নসহযোগীরা নানা সময় নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। এমন না সমস্যা চিহ্নিত হয়নি। কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং সাধারণ ভাবে জনসচেতনতার অভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

মহানগরীতে নানা স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে শিল্প কারখানা। বাংলাদেশের পরিবেশ আইনে শিল্পবর্জ্য ইটিপিতে পরিশোধন ছাড়া নিষ্কাশন নিষিদ্ধ থাকলেও সেই বিধি মানছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে।  মিউনিসিপাল বর্জ্য নিষ্কাশন বিষয়েও কারো কোনো দায়বদ্ধতা নাই।

এমনিতেই ধারণ ক্ষমতার তিন গুণ জনগোষ্ঠীর চাপে পিষ্ট ঢাকা মহানগরী সেখানে নদীদূষণ, জলাশয় দূষণ মানুষ দূরের জলজ প্রাণীগুলোর বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। ঢাকার মাঝে বয়ে চলা খালগুলোর অধিকাংশ মরে গাছে। অন্যগুলো দূষণের কবলে মৃতপ্রায়। অথচ নদী, খালগুলো হতে পারতো ঢাকার যোগাযোগের সবচেয়ে সেরা মাধ্যম। নদীর জল বিশুদ্ধ করে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করা যেত। সেই সম্ভাবনাগুলো এখন সুদূর পরাহত।

দেখলাম ইদানিং চৌকষ পরিবেশ মন্ত্রী বেশ কিছু উদ্যোগের কথা বলছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি কাউন্সিল জেগে উঠছে। বায়ু দূষণ, যান জট, জল জট মুক্ত করার প্রক্রিয়ায় নদী জলাশয় গুলো রক্ষা, দূষণ মুক্ত করার জন্য এখন প্রয়োজন সুসমন্বিত কার্যক্রম, জনগণ সম্পৃক্ত কার্যকরী বাস্তবায়ন ব্যবস্থা।

আপনারা যারা টেমস নদী, রাইন, ভলগা,  ব্রিসবেন নদী, ইয়ারা নদী, মিসিসিপি দেখেছেন তাদের কাছে নদী নগরানয়নে কি ভূমিকা রাখে বুঝিয়ে বলতে হবে না। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রয়াসে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ, বালু যৌবন ফিরে পাবে। নদীগুলো দখল মুক্ত হবে, দূষণের সব উৎস নিয়ন্ত্রণে আসবে। আবারো ঢাকার নদীগুলো মহানগরীকে বসবাসের জন্য ইতিমধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট শহরের কলঙ্ক তিলক থেকে মুক্তিতে অবদান রাখবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × 4 =