দাম কমাতে হলে আসল জায়গায় হাত দিতে হবে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

অস্থির চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযানে নেমেছে সরকার। সম্প্রতি দেশের অন্যতম বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে অভিযান চালিয়েছেন জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে বেঁধে দেওয়া দামে চাল বিক্রি হচ্ছে কি না, অতিরিক্ত মজুত রয়েছে কি না, ওজন ঠিক দিচ্ছে কি না, বেঁধে দেওয়া দাম ঠিক আছে কি না; এসব খতিয়ে দেখা হয়। খোদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সম্প্রতি দেশের বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে অভিযান চালিয়েছেন। হঠাৎ চালের দাম বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে তিনি ওই মোকামে যান। এ সময় একটি মিলের গুদামে প্রায় ৪০০ টন ধানের মজুদ খুঁজে পান মন্ত্রী। এরকম অভিযান আগেও হয়েছে, সামনে হয়তো আরও অনেক দেখতে পাব। দেখতে পাব বাজারে ভোক্তা অধিদপ্তরের দৌড় ঝাঁপ। প্রশ্ন হলো এগুলো করে কি দাম কমে? এরকম প্রতিক্রিয়াধর্মী একশন খুব একটা কাজে আসে না।

টানা দশ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। সাধারণ নাগরিকদের সব আলোচনায় এখন সবার উপরে স্থান পাচ্ছে দ্রব্যমূল্যের আস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এ অবস্থা চলছে সেই করোনাকাল থেকে। মূল্যস্ফীতির হার গত ডিসেম্বরে ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার একটা লক্ষ্য ছিল। তবে তা অর্জিত হয়নি। সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচকই ভাবনার কারণ হলেও মূল্যস্ফীতিকেই ধরা হচ্ছে সরকারের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হিসেবে। সরকার নিজেও সেটা অস্বীকার করছে না। নতুন মন্ত্রীরাও সেকথাই জোর দিয়ে বলছেন। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, স্মার্ট ব্যবস্থাপনায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। যদিও অর্থমন্ত্রী বলছেন রাতারাতি সবকিছু হয়ে যাবে না। তবে সবাই মনে করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার একটা প্রচেষ্টা হয়তো সরকার দৃশ্যমান করবে।

ভরা মওসুমে চালের দাম বাড়ছে। মোকামগুলোতে চালের দাম বাড়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই এখন চালের দাম বাড়তির দিকে। চাল বিক্রেতারা বলছেন, মিল মালিকরা নতুন বছরে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে ধানের সরবরাহ কমায় বেড়েছে চালের দাম। এই যুক্তি, পাল্টা যুক্তি সবসময় আমরা দেখি শুনি, তবে সাধারণ মানুষ কোনো কূলকিনারা পায় না। বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। নির্বাচনের পরে রাজধানীর বাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়ে গেছে। নির্বাচনের মাসখানেক আগে মাংস ব্যবসায়ী ও খামারিরা মিলে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৫০ টাকায় বিক্রি শুরু করেন। ফলে বাজারে অন্যান্য মাংস ও মাছ মিলিয়ে প্রাণিজ আমিষের দামও কিছুটা কমে। কিন্তু নির্বাচন শেষে গরু সরবরাহ সংকটের কথা বলে ব্যবসায়ীরা মাংসের দাম আবার বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই যখন অবস্থা তখন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর স্মার্ট ব্যবস্থাপনা কী হয় সেটা দেখার অপেক্ষায় সবাই।

বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের অনেক সমস্যা। তবে যে সমস্যা এই মুহূর্তে রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, তার নাম হলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। সামগ্রিকভাবে মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না, কিন্তু তার প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। শুধু খাদ্যপণ্য নয়, কাগজের খরচ বাড়ায় লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে। জ্বালানি পণ্যের দাম না নামায় সব ধরনের পরিবহন খরচ বেড়েই রয়েছে যা পণ্যের দামও বাড়াচ্ছে। ঔষধ ও চিকিৎসা খরচও ঊর্ধ্বগতিতে ছুটছে। মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারটা অনেকদিন ধরেই খারাপ অবস্থায় আছে। পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়ায়, টাকার অঙ্কে মানুষের আয় অপরিবর্তিত থাকলেও তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আবার করোনাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ব্যক্তিখাতে অনেক ছাঁটাই হয়েছে। বেতন কর্তনের ঘটনা ঘটেছে, ডলার সংকটে ব্যবসা কমেছে, ক্ষুদ্র ব্যবসা চরম সংকটে পড়েছে। বেশির ভাগ মানুষের আয়ের হার মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। এটা ঠিক যে, দাম সবসময় কমিয়ে রাখা যায় না, দেশের অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে নিয়ন্ত্রিত মাপে মূল্যবৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন। এই নিয়ন্ত্রণটাই নেই কোথাও নেই।

গুটি কয়েক কোম্পানির হাতে জিম্মি পুরো পণ্যবাজার। এদের মুনাফা খাওয়ার মনোবৃত্তি, বাজারে একচেটিয় আধিপত্ব এবং এদের প্রতি নীতিনির্ধারনী জায়গা থেকে নানা প্রশ্রয় বাজারকে অস্থির করে রেখেছে। সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা খোদ সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীও অস্বীকার করেননি। সরকারের নীতির জায়গা থেকে দেখলে আসল কাজ হবে জ্বালানি তেলের দাম কমানো। ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে, যার প্রভাব বাজারে পড়বে। সরকার কি তা করবে? মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জ্বালানি তেলের দাম কমাতেই হবে। কিন্তু সরকার তা করছে না। সরকার বলছে, সে চলছে বাজার অর্থনীতির পদ্ধতিতে। কিন্তু জ্বালানি তেল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে। আমদানি করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সরকার যে দাম ঠিক করে দেয়, সেই দামেই ভোক্তাদের তা কিনতে হয়। অর্থাৎ তেলের দাম নির্ধারিত হয় সরকারি সিদ্ধান্তে, বাজারে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়। বিপিসির অদক্ষতা আর লোকসানের খেসারত দিচ্ছে জনগণ।

২০২১ সালের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৮৪ মার্কিন ডলার। সরকার গত বছরের আগস্টে পণ্যটির দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ায়। তখন বৈশ্বিক বাজারে প্রতি ব্যারেল প্রতি দাম ছিল ৯৪ ডলার। দাম বাড়ানোর পর সরকার বারবারই বলেছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করা হবে। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে দাম কমানোর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এটি দ্রব্যমূল্যে বড় প্রভাব রেখে চলেছে। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আর অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি এদিকে কীভাবে যায় সেটা দেখতে হবে।

পণ্য যদি ব্যাপক হারে আমদানি করা যায় তাহলেও বাজারে পণ্যমূল্য কমে, এটি নানা সময় আমরা দেখেছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমদানি করার মতো প্রয়োজনীয় ডলার নেই এবং ডলারের দামও বেশি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়াবে কি না বা বাজেট ব্যয় কমানোর মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিবে কি না আমরা জানিনা। এটুকু বুঝতে পারছি যে, দ্রব্যমূল্য এক নম্বর মাথাব্যথা হলেও দাওয়াই সময় সাপেক্ষ।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিন দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 − 17 =