দোতারার কবি কানাই লাল শীল

অলকানন্দা মালা

১৮৯৫ সালে ফরিদপুর জেলা নগরকান্দা থানার শাকরাইল ইউনিয়নের লস্করপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কানাই লাল। কানাই লালের হাত দোতারায় পাকা হয়ে উঠেছিল চান সরকারের কাছে। ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন  সুরসাধক কানাই লাল। মৃত্যুর এক দশক পর ১৯৮৭ সালে সংগীতে অবদান রাখায় এবং আধুনিক দোতারার রূপকার হিসেবে সরকার একুশে পদকে ভূষিত করে কানাই লালকে।

সংগীতের সঙ্গে আধ্যাত্মবাদের যোগসূত্র রয়েছে। গল্পটি সেরকমই। একবার এক দোতারা বাদক যুবক গিয়েছেন বিক্রমপুরে আধ্যাত্মিক পুরুষ দীপু সাহেবের মাজারে। সেখানে গিয়ে দেখতে পান, কাফনে মোড়ানো এক লোক বসে দোতারা বাজাচ্ছেন। পাগল করা সে সুর। যুবকের মনে হচ্ছিল পৃথিবী না, স্বর্গ থেকে আসছে এ সুর। তার সঙ্গে মাজারের আতর গোলাপ খুশবু মিলেমিশে এক ঘোর লাগা আবহ তৈরি করেছে। যুবকটি মনে মনে ভাবেন, তিনিও যদি দোতারায় এমন সুরের সন্ধান পেতেন! আর দেরি করেন না। মাজারে হাঁটু গেড়ে বসে হাত তোলেন স্রষ্টার দরবারে। আর্জি জানান, হে প্রভু, আমার দোতারায়ও এমন সুর দাও যে সুরের প্রতিধ্বনি সর্বপ্রাণে আলোড়ন তৈরি করে, ধাবিত হয় ঊর্ধ্বলোকে।

স্রষ্টা যুবকের প্রার্থনা কবুল করেছিলেন। তার হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল দোতারা। তার আঙুল বুঝতে শিখেছিল তারের ভাষা। যুবকের দোতারার সুরে মাতোয়ারা হয়েছিলেন কবি জসীমউদদীন, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দিনের মতো কিংবদন্তিরা। বলছিলাম দোতারার যাদুকর বিখ্যাত গীতিকার সুরকার কানাই লাল শীলের কথা। যার নাম শুনলেই মনে পড়ে ‘শোন গো রূপসী কন্যা গো’, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’ ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি’, ‘প্রাণ সখিরে ওই শোন কদম্ব তলায় বংশি বাজায় কে’র মতো কালজয়ী সব লোকসংগীত। বিখ্যাত এই মানুষটির রচনা এই গানগুলো।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

কানাই লালের জন্ম ফরিদপুর জেলায়। তিনি ১৮৯৫ সালে নগরকান্দা থানার শাকরাইল ইউনিয়নের লস্করপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ। লস্করপুর গ্রাম অবশ্য এখন কড়াইল নামে পরিচিত। রক্তে সংগীত ছিল কানাই লালের। তার পিতা আনন্দ চন্দ্র শীল ছিলেন নৃত্যশিল্পী ও সংগীত পিপাসু। কিন্তু সংস্কৃতিমনা বাবার সান্নিধ্য বেশিদিন কপালে জোটেনি কানাইয়ের। কানাইয়ের বয়স যখন আড়াই বছর তখন পরপারে যাত্রা করেন আনন্দ চন্দ্র। কানাইয়ের মা সৌদামিনী শীল ছিলেন গৃহিণী। পিতার মৃত্যুর পর কানাই মানুষ হন মা ও কাকিমার কাছে।

সুরের সাথে সখ্যতা

শৈশবে কানাই লাল ছিলেন বন্ধনহীন, দুরন্ত। তবে ডানপিটে হলেও সুরের কাছে বাঁধা পড়তেন বালক কানাই। তিনি সংগীত শিক্ষা শুরু বেহালার মাধ্যমে। সেসময় নগরকান্দা গ্রামে বাস করতেন বেহালা বাদক বসন্ত কুমার। চারদিকে নামডাক ছিল তার। মাত্র ৮ বছর বয়সে তার বেহালা শিক্ষা শুরু করেন কানাই। বসন্ত কুমার বেহালা বাজানো শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন কানাইয়ের সুরের সাথে হৃদ্যতা গড়ে উঠবে। ফলে অল্প দিনেই প্রিয় শিষ্য করে নিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু ৩ বছরের বেশি কানাইকে বেহালার পাঠ দিতে পারেননি। বসন্ত কুমারের পর কানাই বেহালা শেখেন নতুন গুরু মতিলাল ধুপীর কাছে। বসন্ত কুমারের মতো ধুপীও ছিলেন বিখ্যাত বেহালাবাদক।

জন্ম যাযাবর কানাই

মতিলাল ধুপীর কাছে বেহালার পাঠ যখন সম্পন্ন হয় তখন কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে কানাই। তার বয়সী অনেকেই শুরু করেছেন কর্মজীবন। কানাইও পেট চালাতে বেরিয়ে পড়েন কর্মক্ষেত্রে। যোগ দেন এক যাত্রা দলে। কানাই ছিলেন আজন্ম যাযাবর। যাত্রা দলের বেহালাবাদক হিসেবে বেশিদিন পাওয়া যায়নি তাকে। এরপর তিনি কীর্তনিয়া নামের এক গানের দলে নাম লেখান বেহালা বাদক হিসেবে। সে দলের সঙ্গে থাকেন বেশ কিছুদিন। ওই সময়টায় বেহালায় সুর তুলে দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান হাওড় অঞ্চল। গাজীর গানের সদস্য ছিলেন কানাই। তবে মন টেকেনি তার কোনো জায়গায়। পেটের টানে থিতু হওয়া মন মুহূর্তেই সব ভুলে হয়ে উঠতো দলছুট। ঘুরে বেড়াতো এখানে সেখানে।

দোতারার সাথে সখ্যতা

কানাই লালের হাত দোতারায় পাকা হয়ে উঠেছিল চান সরকারের কাছে। চান সরকার ও কানাই লাল দুজনেরই বাড়ি ফরিদপুর। চান সরকারের সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়, দোতারা কথা শুনতো তার। মেধাবী কানাইকে পেয়ে চান সরকারও বেশ প্রসন্ন ছিলেন। নিজের কাছে যে বিদ্যা ছিল সবটাই ঢেলে দিয়েছিলেন শিষ্যকে। ফলে অল্প দিনেই দোতারায় হাত শাণিত হয় কানাইয়ের। গুরুর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ পূর্ণ হলে তিনি যোগ দেন এক কৃষ্ণ লীলা দলে। ওই দলের হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন ডাক পড়ে ফরিদপুরে রাধিকা মোহন সাহার বাড়ি। সেসময় ওই বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন পল্লীকবি জসীমউদদীন।

পল্লীকবির হাত ধরে নগরে কানাই

কানাই যেখানেই অনুষ্ঠান করতেন, বেহালা বা দোতারা বাজাতেন তা শ্রোতাদের মন কেড়ে নিত। সেদিন রাধিকা মোহনের বাড়িতে কানাইয়ের দোতারার সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন জসীমউদদীন। তিনি কানাইকে বলেন, সবাই তোমার দোতারা বাদ্যের প্রশংসা করছে। তাহলে আমাকে একদিন শুনাও। উত্তরে দোতারা বাদক কানাই জানান, আজ রাতেই যাত্রা শেষ হবে। আগামীকাল সন্ধ্যার পর কবিকে তিনি গান ও দোতারা বাজিয়ে শোনাবেন।

কথামতো পরদিন রাতে গানের আসর বসে। পল্লীকবির উপস্থিতিতে দোতারা হাতে প্রস্তুত কানাই। তাকে সঙ্গ দিতে খমক ও জুড়ি হাতে আনন্দ ও হরি। দোতারা বাজিয়ে গান ধরেন কানাই। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে গানেও আসে গভীরতা। রাধা কৃষ্ণের বিচ্ছেদ কণ্ঠে তুলে কাতর হন কানাই। গান থামিয়ে দোতারা বাজিয়ে নেন কিছুক্ষণ। নীরব রাতে সুর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সে সুরে পাগল পল্লীকবির মন। তিনিও রাধা কৃষ্ণ বিচ্ছেদে ডুব দিয়ে বসে থাকেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো।

জসীমউদদীন লিখেছেন, ‘গান শুনিতে শুনিতে কোন সাত সাগরের কান্নায় বুক ভাসিয়ে যায়। কোথা দিয়া যে রাত ভোর হইয়া গেল টের পাইলাম না।’ সে রাতে গান শোনার পর জসীমউদদীনও বুঝেছিলেন কানাই অমূল্য। তাকে পরিচয় করিয়ে দেন কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিনিধি হেমচন্দ্রের সাথে। পাশাপাশি মেগাফোন কোম্পানির জিএন ঘোষের সাথেও পরিচয় হয় তার। কানাই লালের সংগীত জীবনের পট পরিবর্তনের কৃতিত্ব যদি কাউকে দিতে হয় তবে সেটি পাবেন জসীমউদদীন।

আব্বাসউদ্দিন ও বিদ্রোহী কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ

পল্লীকবির মাধ্যমেই আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গে পরিচিত হন কানাই। আব্বাসউদ্দিনের হাত ধরে কানাই লাল প্রবেশ করেন কলকাতার সংগীতাঙ্গনে। আব্বাসউদ্দিন তাকে পরিচয় করিয়ে দেন বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সাথে। ফলে কাজ জুটে যায়। দোতারা বাদক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এই কাজের সুবাদেই কানাই লালের পরিচয় হয় দ্রোহ ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। একদিন দোতারা বাজাচ্ছিলের কানাই। ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল। সে বাজনা কবিকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে কানাইকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নেন। প্রায় পাঁচ বছর নজরুলের সঙ্গে দোতারা বাজান কানাই। একই সময় তিনি যুক্ত হন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে। সেখানে দোতারা শিল্পী হিসেবে নিয়মিত কাজ করতে থাকেন।

গীতিকার ও সুরকার কানাই লাল

কানাই লাল শীল শুরুতে দোতারা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তার ভেতরের গীতিকবি ও সুরকার সত্তা জাগিয়ে তোলেন আব্বাসউদ্দিন। তিনি মাঝে মাঝেই গান লেখার তাগাদা দিতেন তাকে। গায়কের এই তাগাদা থেকেই গান বাঁধা ও সুর করা শুরু করেন কানাই। দোতারার মতো কানাই লালের গানেও ছিল এক যাদুকরী শক্তি। অল্পদিনেই তিনি গীতিকার-সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার গান কদর পেয়েছে আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, শচীন দেব বর্মন, আবদুল আলীমের কাছে। এছাড়া তার গান কণ্ঠে তুলেছেন আবদুল হালিম চৌধুরী, কুমুদিনী সাহা, অনন্ত বালা বৈষ্ণবী, ফেরদৌসী রহমান, বেদারউদ্দিন আহামেদ, ফরিদা ইয়াসমিন, নীনা হামিদ, সরদার আলাউদ্দিন, কানন বালা সরকার, এম এ খালেকের মতো গুণী গায়ক-গায়িকারা। আজ এই শিল্পীদের অনেকেই নেই। নেই কানাইও। কিন্তু গানগুলো সেদিনের মতোই সমাদৃত হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।

দোতারার রূপকার

কানাই লালকে দুহাত ভরে দিয়েছে দোতারা। তিনিও দোতারায় এনেছেন নতুন প্রাণ। তখনকার দিনে দোতারায় দুইটি তার ছিল। তিনি এতে ৪ তার যুক্ত করেন। তারপর থেকেই ৪ তার যুক্ত দোতারার প্রচলন শুরু হয়।

ব্যক্তিজীবন ও মৃত্যু

কানাই লাল যখন ২৩ বছরের যুবক তখন বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। গাঁটছড়া বাঁধেন ফরিদপুরের মুন্সীচর গ্রামের মেয়ে কিশোরী বালার সঙ্গে। কানাই-কিশোরী দম্পতির ৭ ছেলেমেয়ে। তিন পুত্রই পেয়েছেন বাবার দোতারা বাজানোর গুণ। ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মারা যান এ সুরসাধক কানাই লাল। মৃত্যুর এক দশক পর ১৯৮৭ সালে সংগীতে অবদান রাখায় এবং আধুনিক দোতারার রূপকার হিসেবে সরকার একুশে পদকে ভূষিত করে তাকে। দোতরার কবি কানাই লাল তার সুর-সংগীতে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সংগীতকে। পেয়েছেন সংগীতপ্রেমীদের ভালোবাসা। তার এ ঋণ শোধ করার না। মাসটি তাকে হারানোর। তার প্রতি রইল অভিনন্দন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্চনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × two =