দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ: বার্লিন পতন ও হিটলারের আত্মহত্যা

মাহবুব আলম

অনেকটা নিরবেই চলে গেল ৯ মে’র ঐতিহাসিক ভিক্টোরি ডে। জার্মান ফ্যাসিবাদী যুদ্ধজয়ের ৭৮তম বার্ষিকী। ১৯৪৫ সালের এই দিনে সোভিয়েত তথা মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক জোসেফ স্ট্যালিন-এর কাছে আত্মসমর্পণ করে হিটলারের জার্মান বাহিনী। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে প্রায় ছয় বছরব্যাপী মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী ও প্রাণঘাতি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই আত্মসমর্পণের কয়েকদিন আগে ১ মে সোভিয়েত লাল ফৌজ জার্মানির রাজধানীতে ঢুকে পড়ে এবং ২ মে বার্লিনের পতন ঘটায়। আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে যা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বার্লিন পতনের পরপরই সোভিয়েত নেতৃত্ব নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। কারণ ততক্ষণে হিটলার আত্মহত্যা করে ফেলেন। লাল ফৌজের বার্লিনে ঢোকার আগের দিন ৩০ এপ্রিল তিনি প্রথমে প্রেমিকা ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন, তারপর বাংকারে ঢুকে সায়ানাইড বিষ খেয়ে ও মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর বিধ্বংসী ও প্রাণঘাতি যুদ্ধ এই জন্য বলা হচ্ছে যে, ইতিপূর্বে কোনো যুদ্ধে এত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। এই যুদ্ধে ছয় কোটিরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নেই নিহত হয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। অবশ্য এর কারণও আছে তা হলো; প্রায় ৬ বছরব্যাপী এই যুদ্ধের শুরুর দিকে দেড় দুই বছর বাদ দিলে বাদবাকি সময়ে পুরোটাই এককভাবে লড়তে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে। তাও আবার তাদের মাটিতে। অন্যদিকে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ হিটলারের রণহুঙ্কারে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে যায়। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো; ফ্রান্স ও পোল্যান্ড। ফ্রান্স সেই সময় ব্রিটিশ সম্রাজ্যের পর দ্বিতীয় বৃহত্তর সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিল। দুনিয়া জোড়া ছিল তাদের উপনিবেশ। সেই ফ্রান্সকে জার্মান সেনারা দখল করে মাত্র দুই সপ্তাহের যুদ্ধে। আর ১৭ দিনের যুদ্ধে পরাজিত হয় পোল্যান্ড। যুদ্ধের ১৭তম দিনে পোল্যান্ডের সরকার রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যায়। যে পোল্যান্ড ছিল ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। হিটলারের ইউরোপ দখলের ঘটনা কমবেশি একই। এমনকি অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশতো বিনা যুদ্ধে দখল করে হিটলার বাহিনী। কিন্তু সোভিয়েতের ক্ষেত্রে ঘটে ভিন্ন ঘটনা। সোভিয়েত লাল ফৌজ আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হলেও পরক্ষণে তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লেলিনগ্রাদ ও স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ও বিভিন্ন জনপদে জানবাজি লড়াই করে। সেখানে প্রতিটি মানুষ যুদ্ধ করেছে। প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি ঘরে যুদ্ধ হয়েছে।

রড, সাবল, ছুরি, গরম পানি, রাইফেল; হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই দিয়ে জনগণ প্রতিরোধ করেছে। তাইতো জার্মান সেনারা দীর্ঘ আড়াই বছর লেলিনগ্রাদ ঘেরাও করে রাখার পরও দখল করতে পারেনি। আর দীর্ঘ লড়াইয়ের পর স্তালিনগ্রাদে হিটলারের বাহিনী পরাজিত হয়। জার্মানদের প্রথম পরাজয়। এই পরাজয়ে শেষ হয়ে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৬ লাখ জার্মান সৈন্য। তারপর সোভিয়েত সৈনিকদের এগিয়ে যাওয়ার পালা। এই পালায় লাল ফৌজ হিটলার বাহিনীকে সোভিয়েত ভূপৃষ্ঠ থেকে হটিয়ে বার্লিন পর্যন্ত তাড়া করে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েতের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি অনেক বেশি। নিহত ২ কোটি ৭০ লাখ। গৃহহারা আড়াই কোটি নর-নারী। সতেরশ নগর ও ২৭ হাজার গ্রাম সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। ৩৮ হাজার ৫০০ মাইল রেলপথ ধ্বংস। ধ্বংস হাজার হাজার শিল্প কলকারখানা। বিধ্বস্ত হয় বিশাল কৃষিক্ষেত্র। সেই সাথে লাখ লাখ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। শুধু তাই নয়, লেলিনগ্রাদসহ বিভিন্ন অবরুদ্ধ শহরে সরবরাহ সংকটে খাদ্যভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে অনেক।

১৬ এপ্রিল ১৯৪৫। শুরু হয় চূড়ান্ত লড়াই। এদিন মার্শাল ঝুকভের নেতৃত্বে লাল ফৌজ সাঁড়াশি আক্রমণ করে ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে জার্মানির রাজধানী বার্লিন ঘিরে ফেলে। তারপর এলো ২০ এপ্রিল। দিনটি ছিল অ্যাডলফ হিটলারের জন্মদিন। এদিন সকাল থেকে বার্লিনের কেন্দ্রস্থলে কামানের গোলাবর্ষণ করে হিটলারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান ঝুকভ বাহিনী। এ সময় মার্শাল ইভান কোনাভের নেতৃত্বে লাল ফৌজের অপর এক বাহিনী বার্লিন শহরতলীর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিটলার তার সেনা পরিচালনার নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটান। ২৩ এপ্রিল তিনি শেষরক্ষার দায়িত্ব দেন জেনারেল হেলমথ উইডলিংকে।

জেনারেল উইডলিং ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫০ জন সৈন্য ও ৯ হাজার ৩০৩টি আর্টিলারি নিয়ে বার্লিনের ডিফেন্স লাইন তৈরি করেন। এ সময় তার হাতে ছিল ২ হাজার ২২৪টি এয়ারক্রাফট। জেনারেল ইউডলিং শহরের মুখে ডিফেন্স লাইনে দাঁড় করান ৪৫ হাজার সেনা। সেই সাথে পুলিশ ও হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর যুবকদের শহর রক্ষার দায়িত্ব দেন। তাদের সংখ্যাও ছিল ৪০ হাজারের অধিক।

শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ। মুহর্মূর্হূ ট্যাংক ও কামানের গোলাবর্ষণ আর আকাশের ফাইটার বিমানের বোমাবর্ষণ। ১৬ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল। মাত্র ১৫ দিন। এই ১৫ দিনে যুদ্ধেই ভেঙে পড়ে বার্লিনের প্রতিরক্ষা ব্যুহ। ১ মে লাল ফৌজ ঢুকে পড়ে শহরে। ২ মে দখল করে নেয় শহরের প্রধান প্রধান কেন্দ্রস্থল। ঐদিন লাল ফৌজ রাইঘস্টাগ দখল করে ওই ভবনের শীর্ষে উড়িয়ে দেয় কাস্তে হাতুড়ি খচিত রক্তলাল পতাকা। বিজয় পতাকা। সোভিয়েত পতাকা। আর ওই ঘটনার পরপরই বার্লিন রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল হেলমথ ইউডলিং অনুষ্ঠানিকভাবে বার্লিন নগরীকে সমর্পণ করেন লাল ফৌজের হাতে। মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধেই বার্লিনের পতন ঘটে।

১৭ দিনের এই যুদ্ধে নিহত হয় ১ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি সৈনিক। এর মধ্যে জার্মানির এক লাখ, আর সোভিয়েতের ৮১ হাজার ১১৬ জন। আহত হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার জার্মান সেনা। আর লাল ফৌজের আহতের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার ২৫১ জন। এছাড়াও নিখোঁজ হন অনেকেই।

এই যুদ্ধে ধ্বংস হয় ইউরোপের সেই সময়ের সবচেয়ে সুন্দর ও প্রযুক্তিবিদ্যার সর্বাধুনিক শহর বার্লিন। আর এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পড়ে ন্যূনতম ৩ লাখ বার্লিনবাসী আর ৮০ হাজার লাল ফৌজ। এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই শুরু হয় জার্মান সৈন্যদের দলে দলে আত্মসমর্পণ। আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে আরো কয়েকদিন পরে ৮ মে রাত ১১টা ১ মিনিটে। এ সময় মস্কোয় ৯ তারিখ শুরু হয়ে গেছে। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ৯ তারিখেই যুদ্ধের সমাপ্তি হিসেবে গণ্য করে। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিপদ থেকে বিশ্ব রক্ষা পায়। আর ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানা নামের এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন। সেই সাথে বিশ্বের মানুষ যুদ্ধের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে মুক্তির নিঃশ্বাস নেয়।

এখানে আরও দু’একটি কথা বলার দরকার তাহলো; আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের আগে জার্মান সেনাপ্রধান জেনারেল আলফ্রেড জোডাল ৭ মে রাত ২টা ৪১ মিনিটে ফ্রান্সের রাইমসে মিত্রবাহিনীর সদর দপ্তরে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। ওই দলিলে বলা হয়, ৮ মে থেকে জার্মান বাহিনীর সকল কার্যক্রম বন্ধ হবে। এরপর ৮ মে মাঝরাতের আগমুহূর্তে ফিল্ড মার্শাল ইউলহেল কাইটেক বার্লিনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মার্শাল ঝুকব সদর দপ্তরে গিয়ে অনুরূপ একটি দলিলে স্বাক্ষর করেন। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জার্মান বাহিনীর পরাজয় ও সোভিয়েত তথা মিত্রবাহিনীর বিজয় অর্জিত হয়। সেই থেকে ৯ মে তারিখটি এক ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল দিন।

এই দিনটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে ও আজকের রাশিয়ার জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস হিসাবে গণ্য করা হয়। এই উপলক্ষ্যে ৮ ও ৯ মে দুই দিন সরকারি ছুটি থাকে। এবং মস্কোর রেড স্কোয়ারে ৯ মে সেনাবাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। শুধু রাশিয়ায় নয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোতে দিনটি সরকারি ছুটির দিন এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই বিজয় দিবস পালিত হয়।

এই উপলক্ষ্যে মস্কোর রেড স্কোয়ারে কাকডাকা ভোরে এসে জড়ো হয় ২০/২৫ লাখ মানুষ। তারপর ধীর লয়ে মিছিল করে। লাখ লাখ হাতে শোভা পায় যুদ্ধাহত সেই সব বীরদের ছবি। কারো ভাই, কারো ছেলে, কারো বাবা, কারো চাচা; লাখ লাখ বেদনাভরা মুখ। অথচ কি এক অপরূপ স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত। দু’বছর আগেও গত বছরও সাড়ে সাত-আট কিলোমিটারব্যাপী মার্চ পাস্ট চলেছিল। কোথাও কোনো অনিয়ম নেই। বিশৃঙ্খলা নেই, নেই হুড়াহুড়ি, শোরগোলও নেই। কারণ সমাজতন্ত্র সাময়িক সরে গেলেও কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক প্রজন্ম তৈরি হয়েছিল পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নে। তারা এখনো সমাজতন্ত্রের ঐক্য, শৃঙ্খলা আর পূর্ব পুরুষদের দায় বয়ে চলে। সমাজতান্ত্রিক মানুষ রাষ্ট্র হারাতে পারে, চেতনা নয়। ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল সেই বিজয়ের মাত্র চার বছরের মাথায় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিশ্ব আসরে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। স্তালিনের হাতে গড়া সেই রুশ জাতি আজও বিশ্বের রাষ্ট্র এবং জাতি সমূহের আলোকবর্তিকা।

আজও আমরা নয়, আমাদের মন্ত্রদীক্ষিত রুশ জাতি মানবেতিহাসের অনন্য শ্রেষ্ঠ বীর জাতি। আজ তাদের তথা সারা বিশ্বে দখলমুক্ত মানুষের বিজয়ের দিন। এই বিজয়ের দিনটি এবার অনেকটা নীরবেই পার হয়ে গেল।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন:নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen − 12 =