সংশপ্তক হাসান
দেশের টেলিভিশন মাধ্যমের অগ্রযাত্রার শুরুতে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তাদের মধ্যে অন্যতম নওয়াজীশ আলী খান। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে গল্পটা হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো, হয়তো সে গল্প এতটা রঙিন হতো না যদি বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া না পেত।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
নওয়াজীশ আলী খানের জন্ম ১৯৪২ সালের ১৬ অক্টোবর। তার বাবার নাম মোহাম্মদ মাজেদ আলী আর মা জোবাইদা খানম। নওয়াজীশ আলী খানের ছোটবেলা কেটেছে আর দশজন গ্রাম্য বালকের মতো। গ্রামের সবুজ প্রকৃতি ছুঁয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। মাঠ-ঘাট দাবড়ে বেড়িয়েছেন। বর্ষার নতুন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দল বেঁধে মাছ ধরেছেন। তার ছোটবেলা কেটেছে একান্নবর্তী পরিবারে। তবে পিতৃভাগ্য ভালো ছিল না তার। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবা হারান তিনি। তবে মায়ের অগাধ স্নেহ ও চাচাদের ভালোবাসার কারণে বাবার অভাবটুকু সেভাবে ছুঁয়ে যায়নি তাকে।
নওয়াজীশ আলী খান চেয়েছিলেন শিক্ষক হতে। এর পেছনে একটি গল্প রয়েছে। ছোটবেলা তিনি তার কয়েকজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরমধ্যে একজন আরজ আলী মাস্টার। তিনি ভেবেছিলেন বড় হয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হবেন। স্কুলে পড়াকালীনই সৃজনশীল কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন নওয়াজীশ। বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ সবকিছুতেই তার ছিল সরব উপস্থিতি। বেড়ে ওঠার সময় থেকেই শিল্পের প্রতি আগ্রহ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার।
টেলিভশনের সাথে সম্পৃক্ততা
নওয়াজীশ আলীর টেলিভিশনের সাথে সম্পৃক্ততা ষাটের দশকে। সেসময় করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনি। ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৯৬৭ সাল। পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় এক বিজ্ঞাপনে দেখলেন টিভিতে লোক নেওয়া হবে। কিন্তু টিভিতে কাজের অভিজ্ঞতা নেই নওয়াজীশ আলী খানের। তবুও চাকরিপ্রার্থী হিসেবে আবেদন করে কিছুদিন পর পেলেন চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের চিঠি। পরপর তিনবার সাক্ষাৎকার দিয়ে চাকরিদাতাদের মন জয় করেন তিনি। একদিন তার ঠিকানায় এসে পৌঁছায় নিয়োগপত্র। নওয়াজীশকে বলা হয় রাওয়ালপিন্ডি ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রে অবস্থিত সেন্ট্রাল অব টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নিতে। তবে ওই ইনস্টিটিউটে যাওয়া হয়নি তার। কেননা প্রথম চিঠির কয়েক দিন পর দ্বিতীয় চিঠিটি হাতে আসে। সেখানে জানানো হয়, রাওয়ালপিন্ডি নয় লাহোর টেলিভিশনে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে তাকে। লাহোর চলে যান নওয়াজীশ। লাহোরে তিন মাস প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর তাকে পাঠানো হয় রাওয়ালপিন্ডির চাকলালায় অবস্থিত সেন্ট্রাল টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষ করে প্রযোজক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। তার প্রথম পোস্টিং ছিল করাচিতে। দিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ২৬ নভেম্বর। করাচি টেলিভিশনে ‘বাংলা বলুন’ নামের একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্ব পান। এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা বলা শেখানো। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতেন নাজির আহমেদ।
১৯৭০ পূর্ব পাকিস্তান এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। সেবছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেসময় টেলিভিশনে পরিবেশনা শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণ দিতে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয় নওয়াজীশ আলীকে। সেবারই প্রথম ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে আসেন তিনি। দেশের মাটিতে এসে টেলিভিশনের দারিদ্র্য নজরে আসে তার। করাচিতে যেখানে টেলিভিশনের নিজস্ব ভবন রয়েছে, মেকআপম্যান থেকে শুরু সবার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা কক্ষ; সেখানে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র চলছে ভাড়া করা ভবনে। না আছে কর্মকর্তাদের বসার ব্যবস্থা, না আছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। আর স্টুডিও বলতে তো ছোট একটি ভাড়া করা কক্ষ। অব্যবস্থাপনা দেখে তখনই নওয়াজেশ আলীর মনে হয় এ অবিচার। যদিও আশ্চর্য হন ঢাকা টেলিভিশনে কর্মরতদের আন্তরিকতা দেখে। ওই একটি মাত্র কক্ষ থেকেই নির্মাণ হতো খবর, শিশুতোষ অনুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, সংগীতানুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠান, সাক্ষাতকারমূলক অনুষ্ঠান। ছোট্ট একটি কক্ষে বসে এই সৃজনশীল কাজগুলো করা হয় দেখে অবাক হন তিনি। এখান থেকেই প্রচারিত হতো শিল্পী মুস্তফা মনোয়ারের ঋতুর রঙে আঁকা আলীবাবার মতো অনুষ্ঠান। এছাড়া ভাড়া করা ওই ফ্লোরের বারান্দার ছোট্ট কক্ষ থেকে তৈরি হতো নাটক মুখরা রমনী বশীকরণ।
বিটিভিতে যোগদান
১৯৭১ সালে সংগঠিত স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানেই ছিলেন নওয়াজীশ আলী। কিন্তু মন পড়েছিল দেশের মাটিতে। স্বাধীনতা অর্জনের পর আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি তিনি। স্বাধীনতার সুবাতাস বুক ভরে নিতে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন তিনি। আফগানিস্তান দিয়ে ১৯৭২ সালে ঢোকেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ততদিনে সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। টেলিভিশন কেন্দ্রটিও যুক্ত হয়েছে সেই তালিকায়। দেশের নাম অনুসারে তার নাম হয়েছে বাংলাদেশ টেলিভশন। নওয়াজীশ আলী খান এসে যোগ দেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। ডিআইটি ভবনের ছোট কক্ষে বসেই দেশ-বিদেশের শিল্পীদের নিয়ে বানাতে থাকেন সৃষ্টিশীল সব অনুষ্ঠান। ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠান ও বার্তা সম্প্রচারের জন্য প্রয়োগ করা হয় আধুনিক সব যন্ত্র। নওয়াজীশ আলীর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল এই অগ্রযাত্রা।
হুমায়ূন আহমেদকে এনেছিলেন তিনি
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের টেলিভিশন জীবনের বড় একটি অংশ বিটিভিতে কাটিয়েছেন। ফলে টেলিভিশন চ্যানেলটির উত্থানে অবদান রয়েছে এই প্রযোজক ও নির্মাতার। আশির দশককে টেলিভিশনের স্বর্ণযুগ বলা হয়। আর এই স্বর্ণযুগের সোনালি কনটেন্ট ছিল নাটক। বিটিভিতে প্রচারিত হতে থাকে একক, ধারাবাহিকসহ সব ধরনের নাটক। এখানে নওয়াজীশ আলীর অবদান অনস্বীকার্য। তার মাধ্যমে শুধু ভালো ভালো নাটকই যুক্ত হয়নি বরং টিভি নাটকের ধারা বদলে দেওয়ার কারিগর হুমায়ূন আহমেদকেও নাটকে যুক্ত করেছিলেন তিনি-ই।
তবে তাদের পরিচয়ের প্রথম পর্ব অতটা সুখকর ছিল না। ১৯৮৩ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর গল্প পাখির বিদায় অবলম্বনে নাটক নির্মিত হচ্ছিল। শুটিং চলছিল ইব্রাহীম খাঁর বাড়ি দখিন হাওয়ায়। নওয়াজীশ আলী তখন বিটিভিতে কর্মরত। শুটিংয়ের তদারকিতে তিনিও গিয়েছিলেন। শুটিং চলছে। এমন সময় নওয়াজেশ মনিটরে চোখ রেখে দেখলেন, নাটকের পাত্র-পাত্রী ছাড়া আরও এক যুবক বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছেন সেখানে। মাথা বিগড়ে গেল তার। পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে সহকারী পরিচালক সরিয়ে দিলেন যুবকটিকে। পরে ইব্রাহীম খাঁর বড় ছেলে হাবিবুর রহমান নওয়াজীশ আলীকে জানালেন, ওই যুবক তার বড় মেয়ের বর। সদ্য বিদেশ থেকে ডক্টরেট করে ফিরেছেন। লেখকও তিনি। নাম হুমায়ূন আহমেদ। নাম শুনেই নওয়াজেশ আলী খানের মনে পড়ে যায় ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ও ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস দুটির কথা। বই দুটি পড়া ছিল তার। এ তো সেই বই দুটির লেখক হুমায়ূন আহমেদ!
এরপরই তাকে টিভি নাটক লেখার প্রস্তাব দেন নওয়াজীশ। কিন্তু রাজি হন না হুমায়ূন। ওদিকে নওয়াজীশও নাছোড়বান্দা। নানাভাবে হুমায়ূন আহমেদকে রাজি করানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। অবশেষে স্ত্রী গুলতেকিন খানের মাধ্যমে রাজি করান হুমায়ূনকে। বিটিভির জন্য হুমায়ূনের লেখা প্রথম নাটকটি ছিল ‘প্রথম প্রহর’। সে নাটকটির জন্যও কম জ্বালাতন করেননি হুমায়ূনকে। একাধিকবার স্ক্রিপ্ট পাল্টিয়ে নিয়েছিলেন তাকে দিয়ে; তারপরই নাটকটি প্রচারে এসেছিল। তাই হুমায়ূন আহমেদকে যদি বাংলা নাটকের ধারা বদলে দেওয়ার কারিগর বলা হয় তবে নওয়াজীশ আলীকে বলা উচিত তার নেপথ্য আয়োজক। সেদিন নাটক লেখা শুরু না করলে বহুব্রীহি, অয়োময়, নক্ষত্রের রাতের মতো নাটক পেত না দর্শক। হয়তো উপন্যাসে বন্দি থেকে যেত কোথাও কেউ নেই। তৈরি হতো না বাংলা নাটকের কালজয়ী চরিত্র বাকের ভাই।
শিল্পী তৈরির কারিগর
নওয়াজীশ আলী খান বিটিভিতে তার দীর্ঘ কর্মজীবনে নাটক প্রযোজনার বাইরে গানের অনুষ্ঠান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানও করেছেন। রেখেছেন কৃতিত্বের ছাপ। তিনি ফেরদৌসী রহমানকে দিয়ে গানের অনুষ্ঠান করিয়েছেন। অধ্যাপক আবু সায়ীদ, যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে দিয়ে করিয়েছেন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলা’র উপস্থাপনা। সেসব অনুষ্ঠান আলোচিতও হয়েছে বেশ। অসংখ্য শিল্পী তৈরি হয়েছে তার হাত দিয়ে।
তার স্বপ্নপূরণ
১৯৯৮ সালে এই কর্মবীর বিটিভির মহাব্যবস্থাপক থাকাকালীন অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি কর্মরত আছেন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে। দীর্ঘ ৫৪ বছরের কর্মজীবনে মেধা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে টেলিভিশনকে সমৃদ্ধ করেছেন নওয়াজেশ আলী। এই অবদানের কারণে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন তার কাছে ঋণী। চলতি বছর কর্মবীর পেয়েছেন তার উপযুক্ত সম্মাননা। শিল্পকলায় অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করেছে। এ আনন্দ ভাগ করতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমার সবসময় মনে হয়েছে আমি একজন অ্যাভারেজ মানুষ। কী এতো পাওয়ার আছে। যা পাওয়ার সেটা পেয়েছি। যথেষ্ট সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছি। তবে সবসময় আমার ভেতর একটা অনুচ্চারিত চাওয়া ছিল। যদি কখনও একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতাম! সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি আনন্দিত ও গর্বিত।
কর্মজীবনে সত্তরের দশকে সেরা প্রযোজক হিসেবে দুবার পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক শাসন থাকায় কোনো গেজেট নেই। পুরস্কার বিষয়ক এই আক্ষেপটিও ছিল তার। একুশে পদক প্রাপ্তিতে যেন সে আক্ষেপও ঘুঁচেছে। অগণিত শিল্পী গড়ার কারিগর হয়েছেন তৃপ্ত।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্যক্তিত্ব