নতুন করে মৃণালকে দেখা

পরিচালক মৃণাল সেনের জন্মবার্ষিকী আজ। ফরিদপুরে জন্ম তাঁর। দেশভাগের আগে আগে চলে যান কলকাতায়। নতুন দেশ, বিচিত্র পরিবেশ আর টিকে থাকার সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সেরা নির্মাতা। মৃণালের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁকে ট্রিবিউট করে ‘চালচিত্র এখন’ বানিয়েছেন অভিনেতা-গায়ক-নির্মাতা অঞ্জন দত্ত। সিনেমাটি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে হইচইয়ে।

‘চালচিত্র’ আশির দশকের সিনেমা। মৃণাল সেনের বয়স তখন প্রায় ষাট। তত দিনে মৃণাল বানিয়ে ফেলেছেন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করা—‘ভুবন সোম’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘কোরাস’, ‘মৃগয়া’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’। যেগুলো প্রকৃত অর্থেই বদলে দিয়েছে ভারতীয় সিনেমার খোলনলচে। সিনেমার যে নিটোল রূপ, পরিপাটি গল্প, গোছানো, সুন্দর—মৃণালের হাতে সেই ব্যাকরণ ভেঙেচুরে গেল। পৃথিবীর এক প্রান্তে তখন ‘নিউ ওয়েভ মুভমেন্ট’-এর রমরমা। গল্প, চিত্রগ্রহণ, সংলাপ, চিত্রনাট্য, অভিনয়, সম্পাদনা নিয়ে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট চলছে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে মৃণালই প্রথম, যিনি সিনেমার প্রচলিত ব্যাকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তৈরি করেছেন নতুন আঙ্গিক। গল্পকে টেনে নামিয়ে এনেছেন পাশের বাড়ির উঠোনে। দেখিয়েছেন অতিসাধারণ মানুষকে, শহরকে। ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে পড়েছেন ঘিঞ্জি, নোংরা গলিঘুপচিতে। তার মধ্য থেকেই খুঁজে এনেছেন মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্বপ্ন, আনন্দ আর প্রতিবাদ। এসবই মৃণালের সিনেমার উপকরণ।

চালচিত্রে মৃণালের প্রধান চরিত্র দীপু নামের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক যুবক, যে কাজ খুঁজছে। সে লিখতে জানে, তাই পত্রিকায় লেখার প্রস্তাব পায়। একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয় তাকে, যার ওপর নির্ভর করছে মোটা মাইনের চাকরি। দীপু বাড়ি ফিরে স্টোরি খুঁজতে থাকে। এই অতিসাধারণ প্লট কীভাবে ছেলেটির পরিবার, বাড়ির উঠোন, পাড়া ডিঙিয়ে একটা গোটা সমাজের, দেশের ক্রাইসিস তুলে আনে; চালচিত্রে আছে সেই চিত্র। আশির দশকের চালচিত্রে অপুর চরিত্রে অভিনয় করা অঞ্জন দত্ত ২০২৪-এ এসে তৈরি করলেন ‘চালচিত্র এখন’। তাতে অঞ্জন নিজেই মৃণালের ভূমিকায়। মৃণাল সেনের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিলেন অঞ্জন। তাঁর গুরু, মেন্টর, বন্ধু—সবই। মৃণাল সেনের জন্মশতবার্ষিকীতে এ সিনেমা তাঁর প্রতি অঞ্জনের ট্রিবিউট।

চালচিত্র এখন-এ অঞ্জন দেখিয়েছেন চালচিত্রের নেপথ্যের গল্প। কীভাবে মৃণালের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, অভিনয়ের প্রস্তাব এবং শুটিংয়ের দিনলিপি। তারপর চালচিত্রের শুটিং শেষের মধ্য দিয়ে এ সিনেমারও সমাপ্তি। এই দেড় ঘণ্টার জার্নিতে ধরা আছে একটা অন্য মৃণালনামা। যিনি লাগামছাড়া, বেপরোয়া, কিছুটা দায়িত্বহীন; কিন্তু সিনেমার জন্য আদ্যোপান্ত নিবেদিতপ্রাণ। তবে প্রচলিত বায়োপিক এটি নয়।

চালচিত্র এখন-এ অঞ্জন সরাসরি চরিত্রের নাম উল্লেখ করেননি। অঞ্জন হয়ে গেছে রঞ্জন, মৃণাল সেন বদলেছে কুণাল সেনে, গীতা হয়েছে নীতা, কে কে মহাজন বদলে গেছে মাধবনে। তাতে সিনেমাটি বায়োপিকের খোলস পেরিয়ে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। চালচিত্র এখন শেষ পর্যন্ত এক নবীন ও প্রবীণের বন্ধুত্বের কাহিনি।  এটা সেই সময়ের গল্প, যখন যুবক অঞ্জন নতুন শহর ও পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না, দিন দিন হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ত্রাণকর্তা হয়ে আসেন মৃণাল সেন। বন্ধুর মতো তাঁকে পথ দেখান। ঠিক সেভাবেই ২০২৪-এ এসে আরও বহু দিগ্‌ভ্রান্ত স্বপ্নবাজ তরুণকে পথ দেখাবে ‘চালচিত্র এখন’।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × four =