নান্দনিক দেয়াল

ময়ূরাক্ষী সেন

ঘরে ঢুকলেই যেন প্রথমেই চোখ আটকে যায় রুমের দেয়ালে। ঘরের প্রতিটা আসবাবপত্র নিয়ে ভাবলেও আলাদা করে ঘরের দেয়াল নিয়ে ভাবা হয় না। কিন্তু শুধু এই দেয়াল সাজিয়েই ঘরকে করে তোলা যায় অনেক বেশি নান্দনিক। তাই তো আজকাল অনেকেই ঘরে সাজানোর পাশাপাশি মনোযোগ দিচ্ছে ঘরের দেয়াল সাজানো নিয়ে। একটা সময় ছিল যখন ঘরের দেয়ার সাজানো বলতে শুধু ছিল দেয়াল জুড়ে ফ্রেম বন্দি ছবি। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে অন্য সব কিছুর সাথে বদলে গেছে দেয়াল সাজানোর ধরনও। দেয়ালকে ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করে বাড়িয়ে তোলা যায় ঘরের রূপ। কারও পছন্দ আটপৌরে তো কারও আবার মিশ্রিত; কেউবা আবার পছন্দ করেন আভিজাত্য। ঘরের দেয়াল সাজাতে এমন অনেক ধারণাই আছে, যা চাইলে দেয়ালসজ্জায় ব্যবহার করতে পারেন। দেয়াল সাজানো হরেক রকমের ধরন নিয়ে রঙ বেরঙ এর আয়োজন।

বইয়ের তাক: দেয়াল সাজাতে পারেন ভিন্নধর্মী বইয়ের তাক দিয়ে। তাই নান্দনিকতার আলোকে আপনার ঘরে থাকা বইয়ের তাকটি হওয়া চাই ঠিক আপনার মনের মতো। ছোট বাড়ি হলে এরকম বাড়িতে দেয়ালই শেষ ভরসা। তবে বর্তমানে রেডিমেড বইয়ের তাক পাওয়া যায়। যা আপনি অনায়াসে ব্যবহার করতে পারবেন। এর বাইরে আপনি যদি মনের মতো করে বইয়ের তাক বানাতে চান তবে কারিগরের সাহায্য নিয়ে ডিজাইন করে নিতে পারেন। কাঠের তাক বানাতে বা কিনতে চাইলে খরচ একটু বেশি পড়বে। ছোট মাপের বইয়ের তাকেরই দাম পড়বে প্রায় আট-নয় হাজার টাকার মতো। আর বড় মাপের বানাতে গেলে বার হাজার টাকার নিচে হবে না। তবে প্লাইউডের বানালে ছোট বইয়ের তাক তিন-চার হাজার টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন। পছন্দ এবং স্থানভেদে এ খরচের তারতম্য হতে পারে।

হাতে আঁকা ছবি: অনেকেই শিল্পীদের কাছে থেকে হাতে আঁকা ছবি কিনে দেয়াল সাজিয়ে থাকে। কিংবা বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে হরকে রকমের পেইন্টিং। এছাড়া নিজের পছন্দ অনুযায়ী ছবি কাস্টমাইজড করে নেওয়া যেতে পারে ছবি। এইসব ছবি ঢাকা নিউ মার্কেট সহ অনেক ধরনের অনলাইন পেইজে পাওয়া যাচ্ছে। ছবি পছন্দ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই দেয়ালের রঙের কথা মাথায় রাখতে হবে।

ওয়াল পেইন্টিং: চাইলে নিজেদের দেয়ালের উপরে পেইন্টিং করে নেওয়া যেতে পারে। তবে ওয়াল পেইন্টগুলিকে নিরাপদ হতে হবে কারণ এটি ঘরে থাকা লোকেদের স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। আপনি ঘরের বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে দেয়াল পেইন্টের অনিরাপদ উপাদান শ্বাস নেওয়া বা স্পর্শ করার ফলে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হতে পারে। আপনার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য, সিলভার আয়ন প্রযুক্তি আছে এমন দেয়ালের জন্য পেইন্ট বেছে নিন কারণ এইসব ঘরকে জীবাণুমুক্ত রাখে। দেয়ালের উপর লতাপাতা, ফুল কিংবা চাঁদ তারার ছবি আঁকা যেতে পারে। এছাড়া চাইলে দেয়ালে করে নেওয়া যেতে পারে ভিন্নধর্মী কোনো রং যেমন হলুদ, নীল, লাল কিংবা সবুজ। এসব উজ্জ্বল রং দেয়ালের সৌন্দর্য বেড়িয়ে তোলে আর মুডকেও রাখে ভালো।

আয়না: যেকোন ঘরকে তাৎক্ষণিকভাবে বড় ও উজ্জ্বল দেখাতে হরেক রকমের আয়না ব্যবহারের জুড়ি নেই। শূন্য বড় দেয়ালগুলোতে কেবল আয়না ব্যবহার করেই দেয়ালের চেহারা বদলে ফেলতে পারেন। নতুনত্ব আনতে আপনি যেটা করতে পারেন, আয়না ঝুলিয়ে না দিয়ে বরং হেলান দিয়ে রাখুন। বড় সাইজের আয়না গুলোকে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখতে পারেন। এতে করে ঘরে বড় একটা আউটলুক তো আসলোই সেই সাথে আপনি চাইলে বাসার অন্য স্থানেও এই আয়নাগুলো ব্যবহার করতে পারছেন। প্রয়োজন বা ডেকোর অনুযায়ী বাসার হলওয়ে থেকে শুরু করে বড় আয়না ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়া আয়না রাখলে আপনার দেয়াল সাজানোর কাজ অর্ধেকটাই কমে যাবে। আয়নার পাশাপাশি মিনি কোনো উপকরণ যেমন, ছোট ফ্রেম, পেইন্টিং রেখে দিলেই বড় দেয়াল সাজানোর কাজ অর্ধেকটা শেষ হয়ে যায়। তবে, আয়নাই যথেষ্ট আপনার দেয়ালকে ভিন্ন দেখাতে!

ওয়ালপেপার: বড় দেয়াল সাজানোর টিপস হিসেবে ইলিউশন বা ওয়ালপেপার বেশ কার্যকরী একটি আইডিয়া। বড় দেয়ালকে ইলিউশন বা ওয়ালপেপার দিয়ে ভরিয়ে ফেললে ঘরটা কিন্তু দেখতে বেশ অন্যরকম লাগবে। ইলিউশন নাকি ওয়ালপেপার, এর মধ্যে ডিজাইনের অপশন বেশি ওয়ালপেপারে থাকলেও, রঙের পছন্দ এবং ভিন্নতা আনতে ইলিউশন বেশি কার্যকরী। কাস্টমাইজড শেড এ একটি নির্দিষ্ট ডিজাইনে পার্থক্য আনা সম্ভব ইলিউশনে। তবে ওয়ালপেপার এর ক্ষেত্রে ডিজাইনের সংখ্যা আরও বেশি পাচ্ছেন। জ্যামিতিক থেকে শুরু করে ফ্লোরাল, মোটিফ এবং প্যাটার্নের মাধ্যমে এই ভিন্নতাগুলো আনা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে ইলিউশন এর সুবিধা হলো যেহেতু আপনি কাস্টমাইজড শেডে দেয়ালে ইলিউশন করাতে পারছেন, তাই করার সময়ই ঘরের বাকি অংশের রঙের সাথে মিল রেখেই ডিজাইন এবং রঙ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যেখানে খুব চাকচিক্য যেমন থাকে না, তেমনি ঘরে একটা শৈল্পিক ভাব ফুটিয়ে তুলে, যা ট্রেন্ডের সাথে পরিবর্তন করা জরুরি নয়। তাই ঐতিহ্য এবং শৈল্পিক আবেশ ফুটিয়ে তুলতে ইলিউশন হতে পারে বেস্ট সলিউশন।

হ্যাংগিং প্লেটস: ঘরের দেয়াল সাজানোর জন্য এই আইডিয়া কিছুটা ভিন্ন। সাধারণত খাবার পরিবেশনের জন্য আমরা প্লেটস ব্যবহার করে থাকি। তবে গতানুগতিক ডিজাইন থেকে কিছুটা ভিন্নতা আনতে ঘরের দেয়াল সাজানোর আইডিয়া হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন সিরামিক কিংবা কাঁসার প্লেটস। যারা টার্কিশ সিরামিক কেনার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী থাকেন, তারা টার্কিশ ল্যাম্প দিয়ে যেমন সিলিং ডেকোরেশন করতে পারবেন। তেমনি চমৎকার ডিজাইনের রঙিন টার্কিশ প্লেটসগুলো দিয়ে দেয়াল ও সাজাতে পারেন। হ্যাংগিং ফ্রেমের মধ্যে ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের প্লেটস বসিয়ে তা দিয়ে খুব সহজেই সাজিয়ে নিতে পারেন ডাইনিং কিংবা লিভিং রুমের যেকোনো দেয়াল।

ঘর সাজানোর জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের আসবাব কেনা ছাড়াও, ঘরের বিভিন্ন কর্নার, দেয়াল সাজানোর জন্য রয়েছে দারুণ সব আইডিয়া। একেক রুমে একেক ধরনের ডিজাইন করার মাধ্যমে ঘরের সৌন্দর্য যেমন বাড়বে, তেমনি তা দেখতেও বেশ ইউনিক মনে হবে। আর তাই আপনিও যদি ঘরের দেয়াল সাজানোর কথা ভেবে থাকেন, তবে উপরের আইডিয়াগুলো থেকে বেছে নিতে আপনার পছন্দের যেকোনোটি এবং ক্রিয়েটিভ ডিজাইনে সাজিয়ে নিতে পারেন ঘরের প্রতিটি দেয়াল।

দেয়াল সাজান দেশীয়ভাবে: ঘরের এককোণে করেন ফেলুন দেয়াল বাগান। দেশি উপকরণ যেমন টেরাকোটার পট, মুখোশ ছাড়াও দেয়ালসজ্জায় তালপাতার বা নকশিকাঁথার পাখা ব্যবহার বেশ নান্দনিকতার প্রকাশ পায়। এ ছাড়া বাঁশ, বেত বা পাটের ছোট ছোট ঝুড়িতে রং করে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলে আসবে ভিন্নতা। ঝুড়ির মাঝে মাঝে কৃত্রিম মোম বসিয়ে দিতে পারেন। রাতে মোমের আলোয় দেয়ালের সৌন্দর্যে ভিন্নমাত্রা যোগ হবে। যাদের হালকা রঙের দেয়াল পছন্দ, তারা নীল, সাদা, বাদামি বা ক্রিম রঙের সিরামিকের প্লেট বসাতে পারেন। এতে ঘরে ক্ল্যাসিক একটা লুক আসবে।

মনে রাখবেন, ঘর আপনার রুচির প্রকাশ করে। তাই ঘর ও দেয়াল সাজানো আগে আপনার ব্যক্তিত্ব ও ঘরের ধরন বুঝে সাজাবেন। কারণ সব দেয়ালের সাথে সব ধরনের সজ্জা মানানসই হয় না। দেয়ালের রং, দেয়ালের মাপ, যে রুমের দেয়াল সাজাবেন তার সাইজ সব কিছু মাথায় রাখতে হবে। অন্যের ঘর সাজানো দেখে সেটা কখনো নিজের বাড়িতে করতে যাবেন না। কারণ দিন শেষে আমাদের সকলের ঘরে ঠাঁই নিতে হয়। এই আশ্রয়ের স্থান যদি ছিমছাম ও প্রশান্তি না দেয় তবে শান্তি পাওয়া যাবে না। তাই কীভাবে দেয়াল সাজাবেন তার আগে খেয়াল রাখবেন সেই সজ্জা যেন বাড়ি সদস্যদের অস্বস্তি কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। যেকোনো সজ্জায় যেন দেয় চোখের প্রশান্তি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টেরিয়র

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine − 6 =