নারী যখন চল্লিশের কোঠায়

ময়ূরাক্ষী সেন

শৈশব থেকে বৃদ্ধ প্রতিটি বয়সেরই রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। তাই সবার উচিত সে সৌন্দর্য ও বাস্তবতাকে গ্রহণ করে নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা।

দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের সমাজে নারীরা মধ্য বয়স কিংবা ৪০ এর পরে নিজেদেরকে ছেড়ে দেয়। তারা মনে করে তাদের বয়স হয়ে গেছে। এখন নতুন করে কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। মধ্য বয়সে নারীদের কিছু শারীরিক পরিবর্তনও আসে। যা অনেকে মেনে নিতে পারে না এবং নিজেকে ভালোবাসা কমিয়ে দেয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পাওয়ার সময় হলো মধ্য বয়স। কুড়িতেই বুড়ি এই প্রথা ভেঙে দিয়ে এখন নারীরা নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে চল্লিশের পর। কিছু নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বরং চল্লিশের পরে তারা নিজেকে নতুন করে সময় দিতে পারছেন। এর আগে চাকরি পড়াশোনা সন্তান সব কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু এখন জীবন যেন নতুন একটি ঘাটে এসে পৌঁছেছে। চলার পথে অবিরাম ছুটে বেড়ানো থেকে একটু রেহাই নিয়ে শান্ত পরিবেশে নিজেকে নতুন করে চেনার নাম যেন মধ্য বয়স। ক্যারিয়ার হোক কিংবা সংসার এই সময়ে এসে সব কিছুই নারীরা গুছিয়ে নেয়। তাই চল্লিশের কোঠায় পা দেওয়ার পর নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার সময়।

নতুন কিছু শেখা 

শেখার কোনো বয়স নেই, প্রতিটি বয়সে নতুন করে সব শেখা যায়। নতুন করে নিজের কোনো একটি শখ তৈরি করা যায়। তাই চল্লিশ বছরের বেশি হয়ে গেছে বলে শেখা বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। এই বয়সে এসে নতুন করে কিছু শেখার চেষ্টা করতে হবে। নতুন করে ছবি আঁকা, বাগান করা, নতুন আইটেম রান্না করা শেখা, গান শেখা, আবৃত্তি করা কিংবা নতুন কোনো ভাষা শেখা। যেকোনো কাজই আবার শুরু করা যায়। শুধু থাকা প্রয়োজন ইচ্ছা শক্তি। অনেকেরই  অনেক কিছু করতে না পারার আফসোস থাকে। সে কাজটিও নতুন করে শুরু করা যেতে পারে, যা অল্প বয়সে করা সম্ভব হয়নি। আবার ক্যারিয়ার গোছাতে গিয়ে কিংবা সংসার সামলাতে গিয়ে অনেক সখের কাজ দীর্ঘদিন করা যায় না। সেই শখের কাজও নতুন করে শুরু করা যেতে পারে।

নিজের জন্য সময় বের করা

নারীদের নিজস্ব সময় বলতে যেন কিছুই নেই। পুরো সময় কাটে অফিসে, সংসার এবং সন্তানকে দিয়ে। হাজারো দায়িত্ব সামলেও নারীর উচিত নিজের জন্য একান্ত কিছু সময় রাখা। নিজেকে সময় দিলে এবং সখের চর্চা করলে নারী নতুন করে আবার বাঁচতে শিখবে। সেজন্য পছন্দের বই পড়া যেতে পারে, গান শোনা যেতে পারে। কিংবা হালকা ব্যায়াম কিংবা হাটাহাটি করা যেতে পারে।

মনের যত্ন নেওয়া

চল্লিশের পর নারীদের অনেক সময় নতুন করে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এ সময়ের জীবনে পরিবর্তন আসা শুরু করে, অনেকে সেই পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। ফলে দেখা দেয় হতাশা, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যাসহ আরো নানা ধরনের মানসিক সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যাগুলো নারী কিংবা তার পরিবার কেউই তেমন আমলে নেয় না। তখন ধীরে ধীরে একজন নারী সমাজ এবং পরিবার থেকে একা হয়ে যেতে থাকে এবং একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরে। পত্রিকার পাতায় মধ্যবয়সি নারীদের অজানা কারণে আত্মহত্যার ঘটনাও কিন্তু বিরল নয়। এসব আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মনের সঠিক যত্ন না নেওয়া এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দেওয়া। এ সময় এসে কোনো মানসিক সমস্যার লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে এবং খোলামেলাভাবে সকলের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

নিজেকে গুরুত্ব দেওয়া

মধ্য বয়সে এসে অনেক নারীরা নিজেকে প্রচণ্ড অবহেলার পাত্র হিসেবে গণ্য করেন। অনেকের বিভিন্ন ধরনের আফসোস থাকে। হয়তো কেউ ভালো মতো পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে সুযোগ পাননি। কিংবা কোনো শখের চর্চা করতে চেয়েছিলেন, সন্তান হয়ে যাওয়ার কারণে তা আর পারেননি। দীর্ঘদিনের এসব আফসোস মনে রেখে অনেক নারীরা হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন। নারীরা মনে করে থাকেন, সারাজীবনে তাদের কোনো অর্জন নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে যোগ্যতা এবং গুণ রয়েছে বলেই তিনি তার জীবনের এতগুলো বছর এক একা পাড়ি দিতে পেরেছেন। চলার পথটা হয়তো সহজ ছিল না; কিন্তু প্রতিটি পথ, প্রতিটি সমস্যা তিনি অতিক্রম করে এসেছেন। নিজেকে কখনোই গুরুত্বহীন কিংবা যোগ্যতাহীন মনে করা যাবে না। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কোনো বিশেষ গুণ রয়েছে তা খুঁজে বের করা জরুরি। সবার আগে নিজেকে ভালবাসতে হবে, তবেই সবাইকে ভালো রাখা যাবে। যে নারী নিজেকে প্রাধান্য দিতে জানেন, পুরো পৃথিবী তাকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু নিজেকে ছোট মনে করলে, সকলের চোখে ছোট হয়ে থাকতে হয়।

আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে

মানুষের আসল সৌন্দর্য তার আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস মানুষকে বহু গুণে এগিয়ে রাখে। কিন্তু এই মধ্য বয়সে এসে অনেক নারী নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। যা তাকে আরও বেশি হীনমন্যতা এবং একাকিত্বে ভোগায়। তাই নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলার জন্য নতুন কাজ শিখতে হবে, বেশি  মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। নতুন করে এই সময়ে এসে কোনো কাজ আয়ত্ত করতে পারলে বা শিখতে পারলে নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং নিজেকে ভালোবাসার পরিমাণ বহু গুণে বেড়ে যায়।

জীবনের চলার পথে হাজারো যোগ্যতা থাকার পরেও শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসের অভাবে অনেকে পিছিয়ে পড়ে। জীবনে এতগুলো বছর পাড়ি দিয়ে এই স্থানে আসতে গিয়ে অনেকে নানা ধরনের ভুল করে ফেলে। কিন্তু মধ্য বয়সে গিয়ে অনেকে সেই ভুল নিয়ে আফসোস করে। কিন্তু আফসোস না করে ভুল জীবনের একটি অংশ তা মেনে নিয়ে, নিজেকে ক্ষমা করে দিয়ে আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে হবে।

নিজেকে ভালোবাসা

বয়স যখন চল্লিশ তখন নিজেকে যেন কেউ আর ভালবাসতে চায় না। নিজের কাছেই যেন নিজেকে মনে হয় বোঝা। কিন্তু নতুন করে এসময় এসে নিজেকে ভালোবাসা শুরু করতে হবে। অনেকে বয়স হয়ে গেছে মনে করে নতুন পোশাক পরতে চান না, সাজতে চান না, কোনো উৎসব আয়োজনে যেতে চান না। কিন্তু নিজেকে ভালোবাসার প্রথম ধাপে নিজের পছন্দের কাজকে গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন পোশাক পরতে হবে, নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে। সিনেমা দেখতে যাওয়া, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাওয়া এমন প্রিয় কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে হবে। তবেই মানসিকভাবে ভালো থাকা যাবে।

স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া

চল্লিশের পর নারীদের নতুন করে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ওজন বেড়ে যাওয়া, ক্যালসিয়াম ও নানা ধরনের ভিটামিনের অভাব ইত্যাদি। এছাড়া চল্লিশের পর থেকেই নারীদের মেনোপজের সময় শুরু হয়। মেনোপজের পরেও আসে নানা ধরনের মানসিক ও শারিরীক  সমস্যা। তাই নারী মধ্য বয়সে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। নিয়মিত শারীরিক চেকআপ করতে হবে। চল্লিশের পর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হবে ও রুটিন মেনে খাওয়া দাওয়া করতে হবে। প্রতিদিনের রুটিনে অবশ্যই শারীরিক পরিশ্রম কিংবা ব্যায়াম রাখতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অঙ্গনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen + 6 =