মাহবুব আলম
বিশ্বের প্রাচীনতম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের ৮২২ বছর পর ২০১৫ সালে আবারো নতুন করে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়েছে। নালন্দার ধ্বংসস্তূপের ১২ কিলোমিটার অদূরে রাজগিরিতে বিহারের পাটনার নিকটবর্তী স্থানে ৪৫০ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত নবনির্মিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে ২০২৪ সালের ১৭ জুন। উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী।
ভারতের ইতিহাস ঐতিহ্য গর্বের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পুনর্গঠনের প্রথম প্রস্তাব করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি এই প্রস্তাব করেন। তার এই প্রস্তাব তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আনন্দচিত্তে গ্রহণ করেন। এবং ২০১০ সালে পার্লামেন্টে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস করেন। এই অ্যাক্ট পাস করে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের জন্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেন। এই কমিটির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় নালন্দার ইতিহাস ঐতিহ্য ধারণ করে আধুনিককালের বিজ্ঞান প্রযুক্তি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার। এই দায়িত্ব নিয়ে অমর্ত্য সেন অত্যান্ত দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করে নালন্দার ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি কোথাও এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের সুপারিশ করেন। সেই সাথে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে সম্পৃক্ত করে একে একটি বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
অমর্ত্য সেনের এই আহ্বানে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এশিয়ার একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার অর্থাৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আবারো পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠনের ঘোষণা দেন। এবং এ বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট সকল দেশের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেন। মনমোহন সিংয়ের এই প্রস্তাবে চীন, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়। এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সংশ্লিষ্ট সকল দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো অর্থাৎ বিল্ডিং নির্মাণের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এ সময় তিনি অমর্ত্য সেনকে উপাচার্য নিয়োগ দেন। তারপর তিনি অবকাঠামো নির্মাণ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে ২০১৫ সালে বাড়ি ভাড়া করে স্বল্প সংখ্যক ছাত্র নিয়ে ক্লাস শুরু করেন। তারপর ১৭টি দেশের অংশগ্রহণে ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সর্বশেষ এ বছর জুনে (২০২৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। নিঃসন্দেহে একটি বড় কাজ। মহৎ কাজ। আর এই মহৎ কাজ, বড় কাজের উদ্বোধনের জন্য নরেন্দ্র মোদীর গর্বিত হওয়ার কথা। হয়েছেনও। তা তিনি তার উদ্বোধনী ভাষণে প্রকাশ্যেই বলেছেন। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যত্র, তাহলো এই পুনর্নির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর থেকে হঠাৎ করে ‘কে নালন্দা ধ্বংস করেছিল? কেন করেছিল?’ সেই চর্চা শুরু হয়েছে। যেখানে চর্চা হবার কথা; নবনির্মিত নালন্দা কী ফিরিয়ে আনতে পারবে অতীতের গৌরব, ফিরিয়ে আনতে পারবে বিনা বেতনে ১০ হাজার ছাত্রের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে?
উল্লেখ্য, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পুরোপুরি অবৈতনিক। চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, আফগানিস্তান, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্য এমনকি ইউরোপ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীসহ ভারতবর্ষের ১০ সহস্রাধিক ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করত। তাদের পাঠদানের জন্য ছিল দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষক।
না এ নিয়ে চর্চার বদলে চর্চা শুরু হয়েছে ৮০০ বছর আগে কে এই নালন্দা ধ্বংস করেন। কিভাবে করেন। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, না ঘোড়ার পায়ে মাড়িয়ে। তখন বুলডোজার বা ট্রাক্টর ছিল না। তাই ওরা বুলডোজার বা বোম্বিং করে ধ্বংসের কথা বলছে না।
এটাতো সত্যি যে নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই এ নিয়ে চর্চা হতেই পারে। কিন্তু হঠাৎ করে এই সময়ে কেন? আবার কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই হিন্দুত্ববাদী সবাই একবাক্যে বলছে, এর জন্য দায়ী কুতুব উদ্দিন আইবেকের সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি।
নবনির্মিত নালন্দার নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধনের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে নালন্দার ধ্বংসের জন্য বখতিয়ার খিলজিকে দায়ী করে কিভাবে ধ্বংস করেছেন রসিয়ে রসিয়ে তার লোমহর্ষক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
ভারতের এক শ্রেণির হিন্দুত্ববাদীরা এই বর্ণনা প্রচার প্রোপাগান্ডায় মেতে উঠেছে গোয়েবলসীয় কায়দায়। সেই সাথে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদী বর্বর উগ্র সম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ। এরা ভারতের বর্বরদের পোস্ট ইউটিউবে, ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে ও বন্ধুদের কাছে বিশেষভাবে পৌঁছে দিয়ে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। মুসলিম বিদ্বেষ বলছি এজন্য কারণ যে ধ্বংসকাণ্ডের সঙ্গে বখতিয়ার খিলজির কোনো যোগাযোগ নেই সেই বখতিয়ার খিলজিকে দায়ী করে বলা হচ্ছে মুসলিম তুর্কি অসভ্যরা হিন্দুদের শ্রেষ্ঠত্বে হিংসা করে নালন্দা ধ্বংস করেছে। হিন্দুত্ববাদীরা তাদের প্রোপাগান্ডায় বলেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধ্বংস করতে অনুপ্রবেশকারী মুসলিম তুর্কিরা নালন্দা ধ্বংস করে।
একটা কথা আছে যখন যেখানে কোনো অপরাধ ঘটে তখন অপরাধী কোনো না কোনো প্রমাণ ছেড়ে যায়। ঠিক তেমনি এক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক উগ্র হিন্দু গোষ্ঠীগুলো অপপ্রচারে এমন সব কথা বলেছেন তাতে তাদের হীনমন্যতা ও অসৎ উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়। যেমন বলেছেন, হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্বকে হিংসা করে, সনাতন ধর্মলম্বীদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ নালন্দা কি হিন্দুদের ঐতিহ্য বহন করে? সনাতন ধর্মালম্বীদের ইতিহাস বহন করে? নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বৌদ্ধ মহাবিহার। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান অর্জনের চর্চা হতো। এর সাথে হিন্দুদের হিন্দুত্বের কি সম্পর্ক? হিন্দু রাজারা এটা প্রতিষ্ঠা করেনি। না হিন্দুরা এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। নালন্দা বৌদ্ধ বিহারের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে মৌর্য সম্প্রাটরা। পরে অন্যান্য বৌদ্ধ সম্প্রাটরা। অন্যদিকে, হিন্দুরা তো প্রকাশ্যেই বৌদ্ধদের হত্যা করতো। বৌদ্ধদের ঘৃণা করতো। বাংলার শাসক শশাঙ্ক প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, বৌদ্ধ ভিক্ষুর ছিন্ন মস্তক আনতে পারলে একশ স্বর্ণ মুদ্রা পুরস্কার। তিনি একবার নালন্দা আক্রমণ করে নালন্দার বিপুল ক্ষতি সাধন করেন। পরে তিনি বা তার মতো হিন্দু বিদ্বেষী গোঁড়া হিন্দুরাই নালন্দা ধ্বংস করেছেন বলে অভিযোগ আছে। তবে নালন্দা ধ্বংসের জন্য কে দায়ী এ বিষয়ে ইতিহাসবিদগণ দ্বিধাবিভক্ত। তবে এজন্য যে কুতুবউদ্দিন আইবেকের সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি দায়ী এই অভিযোগকে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ খারিজ করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমার বর্ধমানের এক বন্ধু কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইমানুল হকের বক্তব্য তুলে দিয়ে আমার এই লেখা শেষ করছি। লেখাটি নিম্নরূপ:
নালন্দা নিয়ে এটাই সর্বশেষ পোস্ট। কারণ প্রমাণের চেয়ে ক্ষমতা আর চাপার জোর বেশি বুঝলাম প্রমাণ দিয়ে অন্ধদের কোনো কাজ নেই। তাই তাদের জন্য এটি না, এটা আমার সেসব বন্ধুদের জন্য যারা আসলে জানতে চান।
বঙ্গবিজেতা বখতিয়ার খিলজি মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে বঙ্গবিজয় করেছিলেন ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন বাংলায় সেন বংশের শাসক লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকাল। সেন বংশের শাসন নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধদের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। এরকম পরিস্থিতিতে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ ঘটে আর লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে যান। পরে এই আক্রমণের উপরেই ভিত্তি করে বহু ঐতিহাসিক মনমতো করে বখতিয়ার খিলজির উপর বেশকিছু অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তার মধ্যে মূল অভিযোগ হলো নালন্দা ধ্বংস।
যাইহোক বখতিয়ার খিলজির উপর বড়জোর উদন্তপুরী আক্রমণের অভিযোগ চাপানো যায়, যেটা নালন্দা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মগধে অবস্থিত। তার বেশি কিছু না। যদিও এই উদন্তপুরী আক্রমণ হয়েছিল ভুল তথ্যের কারণে। বখতিয়ার খিলজি উদন্তপুরীকে সেনাশিবির ভেবে আক্রমণ করেছিলেন।
তবে মজাদার বিষয় হলোÑ বখতিয়ারকে উদন্তপুরী আক্রমণ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো স্থানীয়রা। পণ্ডিত কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রী তাঁর ‘ভাদ্র কল্পদ্রুম’ এ লিখেন “বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পণ্ডিতদের মধ্যে কলহ ও বিবাদ চলছিলো।তা এমনই তীব্র ছিলো যে, তাদের এক পক্ষ তুর্কী আক্রমণকারীদেরকে তাদের ওখানে আক্রমণ চালাতে প্রতিনিধি পাঠায়।”[১]
এমনকি বখতিয়ার খিলজির হয়ে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু নদীয়া আক্রমণের সময় গুপ্তচরবৃত্তিও করেছিল।[২]
যাইহোক, ঐতিহাসিক মিনহাজের বিবরণে জানা যায় উদন্তপুরী একটা শিক্ষাপীঠ ছিল। আর বখতিয়ার সেটা জানতেন না।
তবে আরো কথা আছে। এই মিনহাজের বিবরণটাও সন্দেহজনক। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে উদন্তপুরী বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে, অন্যান্য গবেষকদের মতে ১১৯১-৯৩ এর মধ্যে। আর বখতিয়ার খিলজি আক্রমণ ঘটে ১২০৪ সালে। আর এই মিনহাজের বিবরণকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বানোয়াটও বলেছেন। [৩]
এবার আসা যাক নালন্দা আক্রমণ নিয়ে। নালন্দা আক্রমণ নিয়ে বললে বলতে হয় বখতিয়ার খিলজি কখনো নালন্দাতেই যাননি।
প্রফেসর ডি এন ঝাঁ তার বই অমধরহংঃ ঞযব এৎধরহ: ঘড়ঃবং ঙহ ওফবহঃরভু তে বলেছেন বখতিয়ার খিলজি কখনো নালন্দায় যাননি।
গবেষক লেখক অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেন, “বখতিয়ারের বিরুদ্ধে নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার নিরঙ্কুশ অপবাদ বহুল প্রচারিত। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ সালে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ জানিয়েছেন ১১০০ সাল। অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার উদন্তপুরী আক্রমণ করেছেন ১১৯৩ সালে। আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ সাল। সবচাইতে মজার যে, বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০ মে। স্যার যদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ সাল। অন্যদিকে, অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ সালে। যে লোকটি ১২০৪ সালে বঙ্গে প্রবেশ করেন, সে কীভাবে ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংস করেন?”[৪]
তাহলে দেখা যাচ্ছে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের আগেই নালন্দা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
তিনি আরো লিখেন “সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ধ্বংস করা তো দূরের কথা, বখতিয়ার নালন্দার ধারেকাছেই যাননি।” [৫]
যদুনাথ সরকার অবশ্য চেষ্টা করেছেন বখতিয়ার খিলজির আক্রমণকে ১২০৪ থেকে পিছিয়ে ১১৯৯ আনার, কিন্তু তাতেও ধ্বংসের দায় তার উপর চাপে না।
শরৎচন্দ্র দাশ তার অহঃরয়ঁরঃু ড়ভ ঈযরঃঃধমড়হম প্রবন্ধে লিখেছেন, “বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল ১২০২ সালে।”
এই তালিকায় কিন্তু নালন্দার উল্লেখ নেই।
লামা তারানাথ এবিষয়ে তার বই ‘ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ (১৬০৮খ্রি.) – এ পরিস্কারভাবে বলেছেন। তিনি কেবল উদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা মহাবিহারে আক্রমণের উল্লেখ করেছেন,নালন্দার পর্যন্ত নাম নেননি। তিনি বলেন,
“ঞযবহ পধসব ঃযব ঞঁৎঁংশধ শরহম পধষষবফ ঃযব গড়ড়হ ঃড় ঃযব ৎবমরড়হ ড়ভ অহঃধৎাবফর রহ-নবঃবিবহ ঃযব এধহমধ ধহফ ঃযব ণধসঁহধ. ঝড়সব ড়ভ ঃযব সড়হশং ধপঃবফ ধং ঃযব সবংংবহমবৎং ভড়ৎ ঃযরং শরহম. অং ধ ৎবংঁষঃ, ঃযব ঢ়বঃঃু ঞঁৎঁংশধ ৎঁষবৎং ড়ভ ইযধহমধষধ ধহফ ড়ঃযবৎ ঢ়ষধপবং ঁহরঃবফ, ৎধহ ড়াবৎ যিড়ষব ড়ভ গধমধফযধধহফ সধংংধপৎবফ সধহু ড়ৎফধরহবফ সড়হশং রহ ঙফধহঃধঢ়ঁৎর. ঞযবু ফবংঃৎড়ুবফ ঃযরং ধহফ ধষংড় ঠরশৎধসধংরষধ. ঞযব চবৎংরধহং ধঃ ষধংঃ নঁরষঃ ধ ভড়ৎঃ ড়হ ঃযব ৎঁরহং ড়ভ ঃযব ঙফধহঃধ-ারযধৎধ.”
১২৩৪-৩৬ সাল নাগাদ, অর্থাৎ বখতিয়ারের (মৃত্যু হয় ১২০৬ সালে) বিহার জয়ের ৩১ বছর পরও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠন চালু ছিল। সেসময়ে তিব্বত থেকে ধর্মস্বামী এসে নালন্দা বিহারকে চালু অবস্থাতেই দেখেছেন। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় ৭০ জন সাধু পড়াশোনা করেছেন।[৬]
এবার কথা হলো ধ্বংসের কথা বারবার লেখা হয়, বলা হয় তাহলে যদি ধরেই নি ধ্বংস হয়েছিল, তাহলে সেটা করেছিলো কে বা কারা?
স্বামী বিবেকানন্দের বড় ভাই ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, নালন্দার লাইব্রেরি কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়। চ. ধষ. ঔড়ৎ-এর তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে যে, “ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরি তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযোগে তাহা ধ্বংস হয়। মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনাকতক তরুণ ভিক্ষু দুজন তীর্থিক ভিক্ষুদের গায়ে নোংরা জল ছিটিয়ে দেয়। তার ফলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নধনুক’ এবং নয়তলাযুক্ত ‘রত্নদধি’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।”[৭]
চ. ধষ. ঔড়ৎ :ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব জরংব, চৎড়মৎবংং ধহফ উড়হিভধষষ ড়ভ ইঁফফযরংস রহ ওহফরধ গ্রন্থটা পড়ে দেখতে পারেন।
বুদ্ধপ্রকাশ তাঁর অংঢ়বপঃং ড়ভ ওহফরধহ ঐরংঃড়ৎু ধহফ ঈরারষরংধঃরড়হ’ গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন, “নালন্দায় অগ্নিসংযোগের জন্য হিন্দুরাই দায়ী।”
বাংলাদেশে ‘বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ ভিক্ষু’ গ্রন্থে ভিক্ষু সুনীথানন্দ বলেন “এজন্য কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই দায়ী।”
মুসলিমবিদ্বেষী লেখক আর্নেস্ট হ্যাভেল লিখেছেন “মুসলমান রাজনৈতিক মতবাদ শুদ্রকে দিয়েছে মুক্ত মানুষের অধিকার, আর ব্রাহ্মণদের ওপরে প্রভুত্ব করার ক্ষমতা। ইউরোপের পুনর্জাগরণের মতো চিন্তাজগতে এও তুলেছে তরঙ্গাভিঘাত, জন্ম দিয়েছে অগণিত দৃঢ় মানুষের আর অনেক অত্যোদ্ভুত মৌলিক প্রতিভার। পুনর্জাগরণের মতোই এও ছিল মূলত এক পৌঢ় আদর্শ।… এরই ফলে গড়ে উঠল বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা। সেই মানবতার দ্বার উন্মোচনে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয় ছিল প্রশ্নহীন এক মাইলফলক। বৌদ্ধদের জন্য সেটা ছিল অনেক বেশি গ্লানিমুক্তি। অনেকটা নবজীবন। মুসলিম বিজয় তাদের কোনো কিছু ধ্বংস করেনি, বিপন্ন করেনি তাদের; বরং খুলে দিয়েছে মুক্তির সদর দরজা।”[৮]
এবং দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়, ‘মুসলমানগণ কর্তৃক বঙ্গবিজয়কে বৌদ্ধরা ভগবানের দানরূপে মেনে নিয়েছিল।’
নালন্দার ধ্বংস মুসলিমদের হাতে হলে মুসলিম বিজয়কে কেন বৌদ্ধরা ভগবানের অনুদান মনে করবেন?
ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধদের সহ্য করতে পারতেন না। তিনি যখন পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন তখন সম্ভবত তখনই নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত
এইচ হিরাস এ বিষয়ে লিখেছেন
ঘধষধহফধ টহরাবৎংরঃু ধিং হড়ঃ ভধৎ ভৎড়স ঃযব পধঢ়রঃধষ, চধঃধষরঢ়ঁঃৎধ ধহফ রঃং ভধসব যধফ ধষংড় ৎবধপযবফ গরযরৎধশঁষধ’ং বধৎং. ঞযব নঁরষফরহমং ড়ভ ঘধষধহফধ বিৎব ঃযবহ ঢ়ৎড়নধনষু
ফবংঃৎড়ুবফ ভড়ৎ ঃযব ভরৎংঃ ঃরসব, ধহফ রঃং ঢ়ৎরবংঃং ধহফ ংঃঁফবহঃং ফরং-ঢ়বৎংবফ ধহফ ঢ়বৎযধঢ়ং শরষষবফ.[৯]
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় নালন্দা প্রথমবার আক্রমণের স্বীকার হয় শৈব রাজা মিহিরকুলের দ্বারা, এরপর গৌড়রাজ শশাঙ্কের দ্বারা দ্বিতীয়বার, এরপর তিরহুতের রাজা অর্জুনের একদল ব্রাহ্মণের হাতে আবারও নালন্দা আক্রান্ত হয়।
ঐতিহাসিক এস, সদাশিবন অবশ্য নালন্দা ধ্বংসের জন্য মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।[১০]
পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণরা যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে ও বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।[১১]
তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং’-এ ‘ব্রাহ্মণরা নালন্দার লাইব্রেরি পুড়িয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।’[১২]
ঐতিহাসিক ডি আর পাটিল পরিস্কারভাবে বলেছেন “ওটা ধ্বংস করেছে শৈবরা।”
তিনি এ-ও বলেছেন নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের আগেই। [১৩]
শৈবরাই নালন্দা ধ্বংস করেছে এই বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন আর এস শর্মা ও কে এম শ্রীমালি।[১৪]
বখতিয়ার খিলজিকে দায়ী করার অপচেষ্টা অধিকাংশ ঐতিহাসিক নাকচ করে দিয়েছেন। এবিষয়ে দেখতে পারেন
ঞৎঁংপযশব, অ. ২০১৮. ঞযব চড়বিৎ ড়ভ ঞযব রংষধসরপ ঝড়িৎফ রহ ঘধৎৎধঃরহম ঞযব উবধঃয ড়ভ ওহফরধহ ইঁফফযরংস , ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঞযব ঐরংঃড়ৎু ড়ভ জবষরমরড়হ , ঈযরপধমড় টহরাবৎংরঃু ঢ়ৎবংং.
রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী লিপিতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন যে, নালন্দা ধ্বংসের সাথে বিজয় সেনের সম্পর্ক আছে।
এবিষয়ে দেখতে পারেন ঈযধঁফযধৎু, জ. ১৯৭৮. উবপষরহব ড়ভ ঃযব টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঠরশৎধসধংরষধ, ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব ওহফরধহ ঐরংঃড়ৎু.
রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী নালন্দায় ১৯৬০-৭২ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের উপর ভিত্তি করে উবপষরহব ড়ভ ঞযব টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঠরশৎধসধংরষধ প্রবন্ধ লিখে সুন্দর করে দেখিয়েছেন যে বখতিয়ার খিলজির বাংলায় আগমনের সাথে নালন্দার ধ্বংসের কোনো সম্পর্কই নেই।
তা কি বোঝা গেলো?
আর বাংলায় মুসলিম শাসন বৌদ্ধরা কি হিসেবে দেখেছিলো এবিষয়ে জানতে চাইলে বিশদভাবে লেখা সম্ভব।
এবিষয়ে দেখতে পারেন ঈযধঁফযধৎু, জ. ১৯৭৮. উবপষরহব ড়ভ ঃযব টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঠরশৎধসধংরষধ, ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব ওহফরধহ ঐরংঃড়ৎু.
রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী নালন্দায় ১৯৬০-৭২ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের উপর ভিত্তি করে উবপষরহব ড়ভ ঞযব টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঠরশৎধসধংরষধ প্রবন্ধ লিখে সুন্দর করে দেখিয়েছেন যে বখতিয়ার খিলজির বাংলায় আগমনের সাথে নালন্দার ধ্বংসের কোনো সম্পর্কই নেই।
তা কি বোঝা গেলো?
আর বাংলায় মুসলিম শাসন বৌদ্ধরা কি হিসেবে দেখেছিলো এবিষয়ে জানতে চাইলে বিশদভাবে লেখা সম্ভব।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক