নিরাময় অযোগ্য রোগীদের জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ার

অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ

মানুষের জন্মের পর জীবনের শেষ পরিণতি হচ্ছে অবধারিত মৃত্যু। মৃত্যু অবধারিত হলেও সকল মানুষের প্রত্যাশা থাকে সে, মৃত্যু যেন বেদনাহীন, যন্ত্রণাহীন, মর্যাদাপূর্ণ এবং নিরাপদ হয়। কিন্তু অনেক সময় সেটা হয়ে ওঠেনা, নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। ফলে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে মানুষ। চিকিৎসাব্যবস্থায় নিরাময় অযোগ্য জীবন সীমিত হয়ে আসা রোগীদের সর্বাত্মক পরিচর্যা প্রদানের জন্য তৈরি হয়েছে এক বিশেষ ব্যবস্থা। যার নাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি।

প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমনমূলক সেবা হলো সর্বাত্মক, বহুমুখী নিয়মানুবর্তিতামূলক চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে গুরুতর অসুস্থ মানুষের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা হয়। ক্যান্সার, ফুঁসফুঁসের কিডনী বৈকল্য ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা, যকৃতের রোগ বা অন্য কোনো দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণা থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্যে প্রশমন সেবার প্রয়োজন হয়। প্রশমনমূলক সেবা হচ্ছে নিরাময় অযোগ্য রোগীদের সবচেয়ে বড়ো ওষুধ। এই সেবায় রোগীদের অসহ্য যন্ত্রণার অনেকাংশে প্রশমিত হয়। নিরাময় অযোগ্য রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা বা উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন- প্রচন্ড মাথাব্যথা বা অসহ্য যন্ত্রণা। চিকিৎসার পাশাপাশি এই সেবার মূল উদ্দেশ্য জীবনের মান বাড়ানো।

আমাদের দেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ার শব্দটি এখনো অপরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে যারা জড়িত, তারা ছাড়া অনেকেই এই শব্দটির সাথে অপরিচিত। প্যালিয়েটিভ মেজর পার্ট হলো ব্যাথা নিরাময় করা। এর সংগে আরও অনেক কিছু রয়েছে। যেমন-শ্বাসকষ্ট, খেতে না পারা, এবং মানসিক সমস্যা। একজন মানুষের শেষ সময়ে এটা খুবই প্রয়োজন। এর পরও যদি রোগী মারা যায়, সেই পরিবারের জন্য যে সাপোর্ট সেটাও কিন্তু প্যালেয়েটিভ কেয়ারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ার শুরু হয ২০০৬ সালে। বাচ্চাদের প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিয়ে শুরু হয়। এরপর বড়ো আকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ার শুরু হয়। এর পর থেকে সবাই এই সম্পর্কে ধারণা নিতে শুরু করে। উল্লেখ্য শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ, হোমকেয়ার ও কমিউনিটিভিত্তিক তিন ধরনের প্যালিয়েটিভ সেবা দিয়ে আসছে। ২০০৮ সাল থেকে হোম বেইসড প্যালিয়েটিভ সেবা প্রদান করা হয়। প্যালিয়েটিভ কেয়ার দল চিকিৎসা ও নার্সদের সহায়তায় বিএসএমএমইউ’র ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী নিরাময় অযোগ্য রোগীদের বাড়িতে গিয়ে হোম বেইসড প্যালিয়েটিভ সেবা প্রদান করে থাকেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের এক গবেষণা দেখা গেছে, নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা কম এমন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকাদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি রোগীই ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর মাঝে বেশির ভাগ রোগীরই প্রধান লক্ষণ ছিল ব্যথা। জীবন সীমিত ও নিরাময় অযোগ্য রোগী এবং তার পরিবারের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক সেবা প্রদানের একটি সার্বিক প্রচেষ্টা প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবা। এটি গুরুতর বা নিরাময় অযোগ্য অসুস্থ রোগীদের জন্যে এক ধরনের বিশেষ সেবা। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ নিরাময় অযোগ্য বা দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়। গবেষণায় জানানো হয়, প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকাদের মধ্যে ৬২ শতাংশ রোগী চিকিৎসা বা হাসপাতাল দ্বারা রেফার হয়ে হোম কেয়ারের জন্য এসেছেন। আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই লিম্ফিডিমা কেয়ার প্রয়োজন হয়। এছাড়াও এই রোগীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা ও দুশ্চিন্তার লক্ষণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তাদের মধ্যে ১৮ শতাংশ রোগী মনোসামাজিক ও আধ্যত্মিক সেবা পেয়েছেন। গবেষণা ফলাফলে আরও বলা হয় রোগীদের অর্ধেকেরও বেশির বয়স ৫০-৮০ বছরের মধ্যে ছিল। ৮৭ শতাংশ রোগী মহিলা। ৮৩ শতাংশ রোগী বিবাহিত। ৬৬ শতাংশ রোগী গৃহিনী/গৃহকর্তা। ৫২ শতাংশ রোগীদের জন্য চিকিৎসার খবর নিজের এবং বন্ধুদের ও পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে  অর্থায়ন করা হয়।

যে কারও পরিবারে যেকোন সদস্যেরও সেবা যে কোনো সময়ে প্রয়োজন হতে পারে। দেশের সরকার স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট উন্নয়ন অর্জন করেছে। যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে।  তথাপি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের মতো স্বল্প ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা সর্বস্তরে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছেনা। যা করা খুবই জরুরি।

লেখক: উপাচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

পিআইডি ফিচার

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

thirteen − nine =