নির্মল বায়ু নিশ্চিতে প্রয়োজন জ্বালানি নীতিমালার পুনর্মূল্যায়ন পলিসি ব্রেকফাস্ট এ বক্তারা

ঢাকা, ১৫ মে ২০২৫ (পিআর) – পলিসি ব্রেকফাস্ট আয়োজনে বক্তারা নির্মল বায়ু নিশ্চিত করার জন্য জ্বালানি নীতি পূর্নমূ‍ল্যায়ন করার দাবি জানিয়েছেন।  আজ বিআইপি এর কনফারেন্স হল এ বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এবং সেন্টার ফর পারটিসিপেটোরি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) এর যৌথ আয়োজনে “Revisiting Energy Policies for Ensuring Clean Air” শীর্ষক একটি পলিসি ব্রেকফাস্ট অনুষ্ঠিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম. শহীদুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে পলিসি ব্রেকফাস্টে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স – বিআইপি এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।

মূল প্রবন্ধে ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি বাস্তবমুখী জ্বালানি পরিকল্পনা, নির্মল বায়ু আইন প্রণয়ন, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০২২) এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে নিঃসরিত বায়ুদূষক নিয়ন্ত্রনে কঠোর মানদন্ড। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্থায়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব সহ জবাবদিহিতা ও শক্তিশালী প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, নির্মল বায়ু কোনো বিলাসিতা নয়—এটি আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। জ্বালানি নীতি কেবল মেগাওয়াটের হিসাব নয়—এর উপর নির্ভর করছে মানব স্বাস্থ্য, প্রাণ প্রকৃতির সুরক্ষা এবং সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ইতোপূর্বে প্রায় ৭টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, প্রতিটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জন্য প্রায় ৭০০-১০০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, যার বেশিরভাগই কৃষি জমি ছিল। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুধু বায়ুদূষণ করছে না, এগুলো কৃষি ও প্রান প্রকৃতির জন্যও ক্ষতিকর। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রচুর বিদ্যুৎ চাহিদা রয়েছে এবং ততপ্রেক্ষিত উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়ানো সম্ভব, কিন্তু ট্রান্সমিশন ক্যাপাসিটি খুবই দুর্বল যার ফলে বেশী চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না, অপরদিকে প্রচুর পাওয়ার অপচয়ও হয়ে থাকে। বিদুৎখাতের উন্নয়নের জন্য এই তিনের সমন্বয় জরুরী।

ঢাকাস্থ সুইডেন দূতাবাসের ফাস্ট সেক্রেটারী ও ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেইঞ্জের ডেপুটি হেড নায়োকা মার্টিনেজ-ব্যাকস্ট্রোম বলেন, অনেক ইউরোপীয় অংশীদার ক্লিন ও ন্যায়সঙ্গত জ্বালানি শক্তি রূপান্তরকে সমর্থন করছে, যা শক্তি দক্ষতা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির (RE) ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের মাধ্যমে, সংযোগ, বিতরণ এবং সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। যদি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (FDI) জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা যায় এবং সিস্টেমভিত্তিক সমাধান প্রয়োগের সুযোগ সহজলভ্য করা যায়, তবে আরও অনেক অংশীদার এই খাতে আসবে। তিনি আরো বলেন, জ্বালানি খাতে সমন্বয় ব্যবস্থাগুলো নাগরিক সমাজ সংগঠন (CSO), গবেষক, চিন্তাবিদ প্রতিষ্ঠান, যুব সমাজ এবং শিল্পখাতের অংশীজনদের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হবে।

ইউএনডিপি বাংলাদেশের গ্রিন গ্রোথ প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট মিঃ জ্যাকব ফার্ডিনান্ড বলেন, জ্বালানি নীতিগুলোতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা না করে পরিবেশগত দিকও বিবেচনা করা উচিত। জ্বালানির উৎসগুলোর সাথে পরিবেশ দূষণ বা বায়ু দূষণ গভীরভাবে সম্পর্কিত। তিনি আরো বলেন, জ্বালানি পরিকল্পনার মাধ্যমে বায়ু দূষণ কমাতে হবে তবেই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব, ড. মোঃ সাইফুর রহমান বলেন, গ্রীন ডেভলপমেন্টের জন্য রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি অনেক জরুরী। আমাদের অনেক আইন ও নীতিমালা আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, এগুলো বাস্তবায়ন করতে আমাদের উদ্যেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে টুলস ডেভলপমেন্ট করতে। পাশাপাশি গ্রীন ফাইন্যান্স, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয় বাড়াতে হবে। সম্প্রতি সরকার এনডিসি সহ অন্যান্য পলিসি গুলোকে রিভিশনের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও তিনি জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা করে ফলাফল সরকারকে জানানোর আহ্বান জানান।

বিআইপি এর প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমরা চাহিদা অনুযায়ী যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করছি তার বেশিরভাগই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন হচ্ছে। তবে শহরগুলোতে গণপরিবহন বৃদ্ধির পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের এই শক্তির চাহিদা কমাতে পারি। এটি আমাদের শহর গুলোর বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

সেন্টার ফর পারটিসিপেটোরি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) এর প্রধান নির্বাহী জনাব মোঃ শামসুদ্দোহা বলেন, আমরা যখন পলিসি প্রনয়ন করি তা শুধু আমাদের দেশের একক চিন্তা করে নয়, এটি বৈশ্বিক উন্নয়নের সজ্ঞার সাথে সামঞ্জ্যস্য রেখে প্রনয়ন করা উচিত। উন্নয়ন পরিকল্পনা করার সময় নীতি নির্ধারকরা পরিবেশ বান্ধব উন্নয়নের বিষয়টি উপেক্ষা করেন। প্যারিস চুক্তির শর্ত পূরণের জন্য আমাদেরকে ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো ইমিশনে যেতে হবে, যা আমাদের জ্বালানি নীতিতে অনুপস্থিত। জাতীয় পর্যায়ের পলিসি গুলো প্রনয়ন এর সময় সুশীল সমাজের উপস্থিতি নিশ্চিত করার উপর তিনি জোরারোপ করেন।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর উপদেষ্টা বোর্ডের আহ্বায়ক মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রুফটপ ম্যানেজমেন্ট হতে পারে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের অন্যতম উৎস। শুধু দূষণ নিয়ে কথা বলে, সরকারের উপর এর নিয়ন্ত্রণের দায়ভার চাপিয়ে দিলে চলবে না। আমরা যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করি তাহলে কোন ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেয়া ছাড়াই আমরা একটি সুষ্ঠু ও দূষণমুক্ত শহর গড়ে তুলতে পারবো।

সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ (সিইআর) পরিচালক মোঃ শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, এখন আমরা এমন একটি সময় অতিবাহিত করছি যে সময়টাতে আমাদেরকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তরিত হতে হবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান কিছু নীতি যেমন ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি এন্ড পাওয়ার মাস্টার প্লান (IEPMP), বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২, পরিবেশ সংরক্ষন বিধিমালা ২০২৩, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির খসড়া ২০২৫, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান, ডেল্টা প্লান-২১০০ এবং জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (NDCs) রয়েছে। কিন্তু নীতিগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই, দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর মানদণ্ড নেই এবং বাস্তবায়নে দুর্বলতা রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং নির্মল বায়ুকে আমাদের উন্নয়ন নীতির মূল কেন্দ্রে আনতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশেদুজ্জামান মজুমদার বলেন, অতিতের কোন জ্বালানি নীতি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন টার্গেট পূরণ করতে পারেনি। আমাদের সবগুলো জ্বালানি নীতির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫ এর আলোকে জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ২০২৩ কে সংশোধন করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং ভবিষ্যৎ সরকারকে জ্বালানি নীতিসহ অন্যান্য নীতিগুলো প্রণয়নে বিদেশি কনসালটেন্ট নির্ভর না হয়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাহায্য নেওয়া উচিত। পাশাপাশি তিনি জ্বালানি মহাপরিকল্পনা সংশোধনের উপর জোর দেন।

লয়ার্স ফর এনার্জি এনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট (লিড) এর প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আইইপিএমপি ২০২৩ পরিকল্পনায় স্বচ্ছতা নেই এবং এটি পরিবেশ সুরক্ষা ও জনসম্পৃক্ততার আইনগত মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ। এ ধরনের জাতীয় পরিকল্পনা অবশ্যই সংবিধান ও আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।

উক্ত ডায়ালগে সভাপতির অধ্যাপক ড. এম. শহীদুল ইসলাম বক্তব্যে বলেন, আমাদেরকে এনার্জির ব্যবহার কমিয়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে তার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

উক্ত পলিসি ব্রেকফাস্টে আলোচক হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন, ড. এম সফিউর রহমান, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, ঢাকা; অধ্যাপক ডঃ মোঃ হাফিজুর রহমান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মিসেস সানজিদা হক, গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস কাউন্সিল (জিএসসিসি) এর বাংলাদেশ লিড ফারাহ আঞ্জুম, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের (সিথ্রিইআর) সমন্বয়ক (অপারেশনস) মিসেস রৌফা খানম, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মোঃ নাসির আহমেদ পাটোয়ারী, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর রিসার্চ লিড ইঞ্জি. মারজিয়াত রহমান, সাসটেইনেবল রিসার্চ অ্যান্ড কনসালটেন্সি লিমিটেড (এসআরসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু জুবায়ের, ও. ক্রিডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহাদাত হোসেন, একশন এইডের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ, বারসিক এর সমন্বয়ক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, স্রেডা এর সার্টিফাইড এনার্জি অডিটর ইঞ্জিনিয়ার মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সহ-সভাপতি মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক, মানুষের জনো ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট অফিসার ফাহিম রেজা শোভন, ব্রাইটার্স এর চেয়ার ফারিহা সুলতানা অমি, ইডকলের পরিবেশ বিভাগের প্রধান রায়হান উদ্দিন আহমেদ; বিআইপির বোর্ড মেম্বার পরিকল্পনাবিদ মোঃ আবু নাইম সোহাগ, বাংলাদেশ বায়োগ্যাস ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের মেম্বার শাহেদ ইজরাইল খান, মিশন গ্রিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান রনি, ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের পরিচালক গাউচ পিয়ারী। এছাড়াও সাংবাদিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কেফায়েত শাকিল, জুমাতুল বিদা, আহামেদ রেজা ও হাবিবুর রহমান। উক্ত পলিসি ব্রেকফাস্টে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিভিন্ন পরিবেশবাদী সস্থার প্রতিনিধিগণ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীগণ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 + 17 =