নব্বই দশকে স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছে পাউরুটি ছিল একটি আকর্ষণীয় খাবার। মাত্র ১ টাকায় ঢাউস সাইজের পাউরুটি মিলত। যা দিয়ে টিফিন সারা যেত ভালোভাবে। বড়দের কাছেও খাবারটির বেশ চাহিদা ছিল। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর কাছে অল্প পয়সায় পাওয়া খাবার হিসেবে যেমন ছিল তেমন উচ্চবিত্তের নাস্তার টেবিলেও বেশ কদর ছিল পাউরুটির। যা এখনও চলমান রয়েছে। হাসান নীল এর প্রতিবেদন।
ভ্রান্ত ধারণা ও নামকরণ
রোজ নাস্তার টেবিলে পাউরুটি খেয়ে তৃপ্তি পাই। জ্বর এলে মুখে কিছু না রুচলে পাউরুটি দিয়ে ক্ষুধা মেটাই। এরপর ওই পাউরুটির নামেই কুৎসা রটাই। দুই পা দিয়ে ময়দার খামি ছেনে বানানো রুটিকে পাউরুটি বলা হয় বলে অপবাদ দেই। কিন্তু সত্যি বলতে এ কথার বিন্দুমাত্র ভিত্তি নেই। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক পাউরুটির এমন নামকরণের আসল কারণ কী। পর্তুগিজদের মাধ্যমে পাউরুটি এসেছিল ভারতবর্ষে। একটা সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে এ উপমহাদেশে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাদের। তারা এদেশে এলে তাঁবু ফেলত চট্টগ্রাম ও হুগলিতে। ফলে সেখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে ভাব বিনিময় হতো তাদের। বিনিময় হতো খাবার-দাবার, কৃষ্টির। তারা যেমন এদেশের খাবার সম্পর্কে জ্ঞাত হতো তেমনি এদেশের মানুষও তাদের খাবার সম্পর্কে জানত। মূলত এভাবেই পাউরুটির সঙ্গে আমাদের পরিচয়। পাউরুটি নামকরণের উৎসও এখানটায়। পাউ শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ শব্দ ‘পাও’ থেকে, যার অর্থ গোল রুটি। অন্যদিকে রুটি এসেছে সংস্কৃত ‘রোটিকা’ শব্দ থেকে। এভাবেই সংস্কৃত ও পর্তুগিজ ভাষার মিশেলে উদ্ভব হয় ‘পাউরুটি’ শব্দের।
উৎপত্তি
পাউরুটির উৎপত্তি নিয়ে মতপার্থক্য আছে। একবার তুরস্কে মাটি খুঁড়ে প্রাচীন যুগের কিছু নিদর্শন উঠে আসে। পাউরুটিও ছিল সেসবের মধ্যে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পাওয়া যায় ৯০০ থেকে ১০০০ বছর আগের পাউরুটি এটি। তারপর থেকে হাজার বছরের পুরানো খাবার হিসেবে ধরা হতো পাউরুটিকে। তবে শেষ পর্যন্ত এই ধারণা বহাল থাকেনি। পাউরুটির উৎপত্তি সম্পর্কে নতুন তথ্য উঠে আসে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পুরাতাত্ত্বিকের গবেষণায়। ওই পুরাতাত্ত্বিকগণ জর্ডানের উত্তর অংশে মাটি খুঁড়ে পোড়া পাউরুটির টুকরা পেয়েছিলেন। গবেষণায় বেরিয়ে আসে ওই পাউরুটির টুকরা কম করে হলেও ১৪ হাজার বছর আগের। তৈরি হয়েছে গম বা ভুট্টা দিয়ে। ওই পাউরুটির টুকরা অবাক করেছিল বিজ্ঞানীদের। প্রশ্ন উঠেছিল কৃষি আবিষ্কারের ইতিহাস নিয়েও। গবেষণানুযায়ী চাষাবাদের বয়স ১২ হাজার বছর। অথচ এই পাউরুটির ইতিহাস ১৪ হাজার বছর আগের। যা রীতিমতো বিস্মিত করে বিজ্ঞানীদের। এখন পর্যন্ত ওই পাউরুটিকেই বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো পাউরুটি হিসেবে ধরা হয়। তবে আরেক দলের গবেষণা বলে অন্য কথা। তাদের মতে নরম ও কোমল এই খাদ্যটির প্রচলন শুরু হয়েছিল মিশর থেকে। যার উদ্ভব আজ থেকে ৩৫০০ বছর আগে। পরে সময়ের আবর্তনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাত ধরে ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন দেশে।
ভারতবর্ষে আনে পর্তুগিজরা
উপমহাদেশে এসে বিশ্বের বিভিন্ন খাবারের স্বাদ গন্ধ আকৃতি বদলে গেছে। পাউরুটিও এর ব্যতিক্রম নয়। ভারতবর্ষে এসে পাউরুটি না পেয়ে পর্তুগিজরা তৈরির উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মিলছিল না পাউরুটি তৈরির অন্যতম উপাদান ইস্ট। বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে নিতে সময় নেয়নি পর্তুগিজরা। ময়দার সঙ্গে ইস্টের বিকল্প হিসেবে তাড়ি মিশিয়ে পাউরুটি তৈরি শুরু করে তারা। আর এভাবেই ভারতবর্ষে শুরু হয়েছিল পাউরুটি তৈরি।
যেভাবে স্লাইস হলো
সময়ের সঙ্গে পাউরুটির যেমন উপকরণ ও গুণগত মানে পরিবর্তনে এসেছে তেমন এসেছে আকারে। আজকাল ফালি করে কাটা অর্থাৎ স্লাইস পাউরুটির জনপ্রিয়তা বেশি। একটা সময় কিন্তু এই স্লাইস পাউরুটির চল ছিল না। কেউ চাইলে আস্ত পাউরুটি কিনে বাড়িতে নিয়ে স্লাইস করতে হতো। তবে তা ছিল বাড়তি ঝামেলা। স্লাইস প্রেমীদের এই কষ্ট বুঝেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওটো ফ্রেডেরিক রোহওয়েডার নামক এক ব্যক্তি। পাউরুটিপ্রেমীদের এই উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন একটি মেশিন। যার মাধ্যমে আস্ত পাউরুটি স্লাইস বা টুকরা করা যেত। ১৯২৮ সালের ৭ জুলাই রোহওয়েডার উদ্ভাবন করেছিলেন পাউরুটি স্লাইস করার মেশিনটি। তবে কাজটি মোটেও সহজ ছিল না তার জন্য। সফল হতে বারবার চেষ্টা করতে হয়েছিল তাকে। তবে তার এই মেশিনে আস্থা পাচ্ছিলেন না পাউরুটি কারখানার মালিকরা। মেশিনে কাটা পাউরুটি আদৌ বাজারে চলবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল তাদের। ওয়েডারের এক বন্ধু ছিলেন পাউরুটি কারখানার মালিক। তার দ্বারস্থ হন পাউরুটি মেশিনের উদ্ভাবক ওয়েডার। বন্ধু ফ্র্যাঙ্কবেঞ্চ ফিরিয়ে দেননি বরং বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ান ওয়েডারের। তার কারখানায় এই মেশিনের সাহায্যে প্রথম তৈরি হয় স্লাইস পাউরুটি। পরে মেশিনে আরও কিছুটা উন্নতি সাধন করা হয়। স্লাইস জনিত সমস্যার সমাধান হলেও দেখা দেয় নতুন এক বিপত্তি। ফালি করে কাটা পাউরুটি ছিল অতি দ্রুত পচনশীল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আরও একটি উপায় অবলম্বন করেন ওয়েডার। ফালি করে কাটা পাউরুটিগুলো বিচ্ছিন্ন না করে একসঙ্গে রেখে পিন মেরে বাজারজাতের জন্য প্যাকেট করা হতে থাকে। যাতে করে একসঙ্গে থাকায় দ্রুত পচনের হাত থেকে রক্ষা পায় পাউরুটি। এরপর অল্পদিনেই স্লাইস পাউরুটি ক্রেতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়।
ধনী-গরীব ভেদে ব্যবহার
ধনী গরীব সব শ্রেণির কাছেই পাউরুটির প্রয়োজনীয়তা ও জনপ্রিয়তা সমান। তবে এক সময় পাউরুটি দিয়ে শ্রেণিভেদ করা হতো। ব্রিটিশ মধ্যযুগের ঘটনা এটি। সে সময় সাদা পাউরুটি শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত রোমানদের খাবার টেবিলে রাখা হতো। আর দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ ছিল মোটা পাউরুটি।
যখন মর্যাদার প্রতীক
অনেক দেশে সাধারণ খাবার হিসেবে গণ্য করা হলেও কিছু দেশে আবার মর্যাদার প্রতীক এই পাউরুটি। কোনো জাতি তো শিল্পকর্মের কাতারে নিয়ে গেছে একে। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জার্মানরা। এই দেশে প্রায় ৩০০ রকমের পাউরুটি রয়েছে। খাবার টেবিলের পাশাপাশি সেখানকার শিল্পসাহিত্য ধর্মেও পাউরুটির ব্যবহার রয়েছে। আর অস্ট্রিয়াতে তো ব্রেড মিউজিয়াম নামে পাউরুটি আকারের আস্ত একটি জাদুঘর-ই রয়েছে। এখানে পাউরুটির ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কিত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করা রয়েছে। মিউজিয়ামটির স্থাপত্যশৈলীও বেশ মনোমুগ্ধকর।
উপকরণ ও প্রক্রিয়ায় বদল
সময়ের পরিক্রমায় পাউরুটি তৈরির উপকরণ ও প্রক্রিয়া পাল্টেছে বারবার। ১০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে মেক্সিকানরা ভুট্টা দিয়ে তৈরি করতো পাউরুটি। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে ফরাসিরা উদ্ভাবন করে উইন্ড মিল সিস্টেম। তবে ১৮৩৪ সাল পাউরুটির ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সে বছর পাউরুটি বেকিংয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর আগে শস্য দানা চূর্ণ করতে হতো পাউরুটি তৈরিতে। কিন্তু রোলার সিস্টেমের মাধ্যমে সে বছর শস্য চূর্ণ না করে খোলস ভেঙে আলাদা করা হতো ময়দা ও তুষ। ফলে শস্য চূর্ণের ঝক্কি ছাড়াই তৈরি হতে থাকে পাউরুটি। যা প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ করে তোলে। বিংশ শতাব্দীতে পাউরুটি তৈরিতে আরও একটি বিপ্লব আসে। শুরু হয় পাউরুটিতে রাসায়নিক উপাদান সংযোজন। সেইসঙ্গে ময়দা পুষ্টিকর করে তুলতে ব্যবহার করা হতে থাকে বিভিন্ন খনিজ ও ভিটামিন। রাসায়নিক সংযোজনের পর থেকে পাউরুটি যেমন নরম হতে থাকে তেমনি রঙ হতে থাকে সাদা। যা এই খাবারটিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।
কিছু মজার তথ্য
শুধু খাবার নয় একটা সময় পড়াশোনার উপকরণ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো পাউরুটি। সে অনেক আগের কথা। তখনও ইরেজার আবিষ্কার হয়নি। সে সময় পেন্সিলের লেখা মুছতে ইরেজারের কাজ করা হতো পাউরুটি দিয়ে। পাউরুটির কারণে তো একবার বিদ্রোহ পর্যন্ত হয়েছিল। তখনও ফরাসি বিপ্লব হয়নি। ফ্রান্সে হঠাৎই পাউরুটি চড়া দামে বিক্রি হতে থাকে। এটিই ছিল বিদ্রোহের কারণ। ওই বিদ্রোহ ইতিহাসের পাতায় ময়দা যুদ্ধ নামে পরিচিত। এক সময় খাবার রাখার প্লেট হিসেবেও ব্যবহার করা হতো পাউরুটি। ঘটনাটি দ্বাদশ শতাব্দীর নাইট এবং লর্ডের সময়কার। ওই আমলে মোটা পাউরুটিকে বলা হতো ট্রেঞ্চার্স। যা ব্যবহৃত হতো খাবারের প্লেট হিসেবে। এতে প্লেট ধোয়ার বা রাখার কোনো ঝামেলা ছিল না। খাওয়া শেষে প্লেট হিসেবে ব্যবহৃত পাউরুটিও খেয়ে নেওয়া হতো।
পাউরুটি সম্পর্কে ভয়ংকর কিছু তথ্য
১. ক্ষতিকর রাসায়নিক
বেশির ভাগ পাউরুটি বানাতেই পটাশিয়াম ব্রোমেট বা আয়োডেট নামের ভয়ানক ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এই দুটি রাসায়নিকই মানব স্বাস্থ্য ধ্বংস করে। যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) এর গবেষণায়।
২. অতিরিক্ত শ্লেষ্মা সৃষ্টি করে
পাউরুটি রাসায়নিক এবং কৃত্রিম খাদ্য উপাদানে পূর্ণ থাকে। খাওয়ার পর এর সঙ্গে পানি মিশে তৈরি হয় এক চটচটে ও আঠালো পিণ্ড। যা হজম প্রক্রিয়ায় প্রবেশের পর আমাদের পাকস্থলী একে একটি ক্ষতিকর অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করে। নিজেকে এর ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য শ্লেষ্মার দেয়াল তৈরি করে!
৩. ওজন বাড়ায়
পাউরুটিতে আছে প্রচুর কার্বোহাইড্রেটস, লবণ, পরিশোধিত চিনি এবং প্রিজারভেটিভ যা শুধু আপনার ওজনই বাড়াবে কিন্তু কোনো পুষ্টি সরবরাহ করবে না।
৪. হজম করা কঠিন
পাউরুটিতে কোনো খাদ্য আঁশ নেই। ফলে অন্ত্রে এর চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে এটি হজম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে দেহে বিষ উৎপাদন করতে পারে।
৫. পুষ্টিহীন
পাউরুটি বানানোর জন্য ময়দা পরিশোধিত করার সময় সব ধরনের স্বাস্থ্যকর উপাদান খসে পড়ে। সব ভিটামিন এবং খনিজ পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। ফলে শুধু শ্লেষ্মা উৎপাদক রুটির ফালিই শুধু বাকী থাকে।
৬. রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়ায়
পরিশোধিত ময়দা থেকে তৈরি হওয়ায় এতে থাকে উচ্চ গ্লিকেমিক ইনডেক্স। যার ফলে এটি খেলে রক্তে দ্রুত সুগার নিঃসরিত হয়। যা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার দরজা খুলে দেয়।
৭. বিষাক্ত অ্যাডিটিভস বা কৃত্রিম খাদ্য উপাদান
পরিশোধিত শস্য সব সময়ই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এতে থাকে কার্বন ডাই অক্সাইড বা ব্রোমেন এর মতো বিষাক্ত অ্যাডিটিভস বা কৃত্রিম খাদ্য উপাদান।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন