পোশাকে মোটিফ

নীলাঞ্জনা নীলা

এখন সবাই বেশ ফ্যাশন সচেতন। সবাই এখন নিজের সাজ পোশাকের মধ্যে ভিন্নতা বজায় রাখতে চায়। এই ফ্যাশন সচেতনতা ডিজাইনারদের আরও বেশি আগ্রহী করে তুলছে নতুন ধরনের পোশাক তৈরি করতে। চিরাচরিত নকশা থেকে বের হয়ে ডিজাইনাররা তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের পোশাক। সবার কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে পোশাকে মোটিফ। একটি নির্দিষ্ট মোটিফ ঠিক করে সেই পোশাক তৈরি করা হয়। পোশাকের থিম কেমন হবে তা নির্ভর করছে উৎসব ও সময়ের ওপর। তবে সব থিমের পোশাক সব আয়োজনের জন্য উপযোগী নয়। তাই নিজের জন্য থিমভিত্তিক পোশাক নির্বাচন করতে চাইলে কোন ধরনের অনুষ্ঠান কিংবা কোন সময় পরা হবে তা খেয়াল রাখা জরুরি।

ডিজাইনাররা এখন ঋতুভিত্তিক পোশাকের উপর কাজ করছেন। যেমন বর্ষা কিংবা গ্রীষ্মকাল আসলে তার উপর নির্ভর করে প্রকৃতির ছোঁয়া এনে পোশাকে মোটিফ দেওয়া হয়। বর্ষাকালে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে নীল রঙের পোশাককে। সেই পোশাকের উপর কখনো নিয়ে আসা হয় সমুদ্র কিংবা মেঘ ভরা আকাশ। আবার সামার ফ্রেন্ডলি পোশাকে দেখা যায় তরমুজ, আম, লিচু ইত্যাদির ছবি। যারা সব সময় ট্রেন্ডি লুকে থাকতে পছন্দ করেন তারা এ ধরনের পোশাক বেছে নিচ্ছেন। সামার ফ্রেন্ডলি মোটিফের পোশাকে সাধারণত গাঢ় রঙ বেছে নেওয়া হয়। যেমন লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি। আবার অনেকে গরম থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য সামারে বেছে নেন হালকা রঙের পোশাক যেমন সাদা, আকাশি, নীল ইত্যাদি। সামার ফ্রেন্ডলি হালকা রঙের পোশাকে সুই সুতা দিয়ে কাজ করা হয়। কিংবা যেকোনো হালকা নকশা বেছে নেওয়া হয়।

মোটিফভিত্তিক পোশাকে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ঐতিহাসিক স্থান কিংবা স্থাপনার চিত্র। কেমন হয় যদি আপনি আহসান মঞ্জিল ঘুরতে যান এবং আপনার পোশাকেও থাকে আহসান মঞ্জিলের চিত্র। তাই অনেকে ঘুরতে যাওয়া কিংবা ভ্রমণের জন্য বেছে নেন মোটিফভিত্তিক পোশাক। সাধারণত ভ্রমণের পোশাক এমন হওয়া উচিত যা পরিধান করে ঘুরে বেড়ান সহজ হবে। তাই অনেকে ভ্রমণের জন্য বেছে নিচ্ছেন মোটিভভিত্তিক টি-শার্ট, ফতুয়া ইত্যাদি।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে মোটিফভিত্তিক টি শার্ট বেশ জনপ্রিয়। টি শার্টে ময়ূরের ছবি, রিকশা প্রিন্ট, মানচিত্র ইত্যাদি দেখা যায়। যারা ওয়েস্টার্ন পোশাকের পাশাপাশি দেশীয় ঐতিহ্য বহন করতে চান তারা এ ধরনের মোটিফভিত্তিক ওয়েস্টার্ন পোশাক বেছে নেন। মেয়েদের শার্টে লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন ধরনের ফুল লতাপাতার মোটিফ। এছাড়া স্কার্টে দেখা যায় পটচিত্রের নকশা। জনপ্রিয় আরেকটি মোটিফ হচ্ছে জামদানি মোটিফ। জামদানি বাঙালিয়ানাকে পরিপূর্ণ করে। জামদানি ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় এখন সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া এমনকি গয়নার মধ্যেও। সুতি শাড়ির মধ্যেও জামদানির নকশা করা হয়, যা অনেকের পছন্দের। এছাড়া জামদানির নকশা করা হয় টি শার্ট, শার্ট  ইত্যাদি সব ধরনের পোশাকে।

তরুণীদের কাছে নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য পছন্দ সিঙ্গেল কুর্তি। ক্লাস, অফিস ইত্যাদি সব জায়গার জন্যই এখন তরুণীরা বেছে নেন আরামদায়ক সুতির কুর্তি। তাই নিত্যদিনের পোশাকও যাতে হয় আকর্ষণীয় সেজন্য কুর্তিতে বিভিন্ন ধরনের মোটিফ তুলে ধরা হয়। যেমন নদী, নৌকা, হাতি, মাছ, পুতুল ইত্যাদি। রঙিন সব নকশার কুর্তি রোজকার ব্যবহারের জন্য হয়ে উঠছে আরো আকর্ষণীয়। পোশাকেই বোঝা যায় একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব ও রুচি। সকলেই এখন রুচিশীল ও নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে মানানসই পোশাক বেছে নেন। দেশীয় পোশাক ও মোটিফ একজন মানুষকে আরো বেশি নান্দনিক করে তোলে। তরুণ প্রজন্মের ভিনদেশি পোশাকের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও তারা এখন দেশীয় পোশাকের দিকেও ঝুঁকছেন।

দেশীয় পোশাক পরিধানের প্রতি আগ্রহী করতেই ডিজাইনাররা পোশাকে নিয়ে আসছেন ভিন্নতা। নকশায় আনছেন পরিবর্তন। তরুণ তরুণীরা ওয়েস্টার্ন পোশাক পরিধান করতে পছন্দ করলেও তারা দেশীয় পোশাকের প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানান ডিজাইনাররা। আরেকটি জনপ্রিয় মোটিফ হলো রিকশা প্রিন্ট। রিকশার পেছনে থাকা নকশা এখন চলে এসেছে ফ্যাশন দুনিয়াতে। এই মোটিফ তরুণ তরুণীদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। শুধু যে পোশাকে রিকশা প্রিন্ট করা হয় তা নয় ব্যাগ, গয়না, চশমা, সানগ্লাস এসবেও করা হয়ে থাকে রিকশা প্রিন্ট। যেকোনো সাজের সাথে রিকশা প্রিন্টের অনুষঙ্গ রাখলে সেটি হয়ে উঠে আরও বেশি নান্দনিক। রিকশা যেহেতু বাঙালিয়ানার একটি অংশ তাই এই পোশাক পরিধানের মাধ্যমে ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। আবার পোশাকে কখনো দেখা যায় শহুরে ব্যস্ততা। শহরের বড় বিল্ডিং, যানজট, কাক ইত্যাদি পোশাকে তুলে ধরা হয় পুরো ঢাকা শহরকে।

মোটিফ মূলত একটি গল্প কিংবা নকশা। পোশাকের মাধ্যমে ডিজাইনার চেষ্টা করেন একটি গল্প তুলে ধরার। মোটিফ তুলে ধরা হয় শাড়ির মধ্যেও। শাড়ির আঁচলে কিংবা কুচিতে লক্ষ্য করা যায় গ্রামীণ পরিবেশ। গ্রামের বিল ভরা শাপলা কিংবা কৃষকের কাজ ইত্যাদি তুলে ধরা হয়। দেখা যায় নৌকা চালিয়ে যাচ্ছে মাঝি। একটা সময় পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখ, ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি বিশেষ দিনগুলোতে মানুষ মোটিভভিত্তিক পোশাক বেছে নিতো। কিন্তু এখন মোটিফভিত্তিক পোশাক এতোটা জনপ্রিয় যে নিত্য ব্যবহারের জন্যও মানুষ মোটিফভিত্তিক পোশাক বেছে নিচ্ছে। বিশেষ করে যারা নিজেকে ভিন্নভাবে তুলে ধরতে চান।

ফ্যাশন হাউসগুলো সবচেয়ে বেশি কাজ করে থাকে দেশীয় মোটিফের উপর। যেমন দেশীয় পোশাকের লক্ষ্য করা যায় নকশী কাঁথা। একটা সময় নকশি কাঁথা মোটিফ শুধু শাড়িতে পাওয়া গেলেও এখন সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া সবকিছুতেই রয়েছে। সাধারণত এই নকশাগুলো হাতে করা হয়। তাই প্রতিটি পোশাক যেন এক একটি গল্প তুলে ধরে। পাশাপাশি এ ধরনের মোটিফভিত্তিক পোশাক পরিধান করে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য তুলে ধরা যায়। ডিজাইনাররা বলেন, মোটিফভিত্তিক পোশাকের সবচেয়ে বেশি চাহিদা তরুণ তরুণীদের কাছে। এছাড়া যেসব বাঙালিরা প্রবাসে থাকেন তারাও মোটিফভিত্তিক পোশাক সন্ধান করেন। কারণ এতে তারা বিদেশের বুকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারেন। শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, ওয়েস্টার্ন, টি শার্ট, পাঞ্জাবি যেকোনো ধরনের পোশাকে এখন মোটিফের কাজ করা হয়।

তরুণদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে জেলাভিত্তিক টি শার্ট। টি শার্টে নকশার পাশাপাশি নিজের জেলার নাম লেখা থাকে। এ ধরনের টি শার্ট বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক পেইজ থেকে কাস্টমাইজ করেও বানিয়ে নেওয়া যায়। শাড়ি কিংবা পোশাকে মোটিফ তুলে ধরা হয় হ্যান্ড পেইন্টের মাধ্যমে। শাড়ির আঁচলে সমুদ্র, পাহাড়, পাখি, লতাপাতা ইত্যাদি হ্যান্ড পেইন্ট করা হয়। মোটিফভিত্তিক এসব পোশাক ব্লক প্রিন্ট, বাটিক প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট, ডিজিটাল প্রিন্ট, হাতের কাজ ও এমব্রয়ডারি করে করা হয়। কখনো পোশাকে লক্ষ্য করা যায় ইসলামিক আর্ট, দ্য স্টারি নাইট, সূর্যমুখী ফুল ইত্যাদি। পুতুল নাচ, টেপা পুতুল ইত্যাদি পোশাকে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থান যেমন আহসান মঞ্জিল, বিভিন্ন জমিদার বাড়ি ইত্যাদি পোশাকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।

শুধু যে পোশাকে মোটিফ নিয়ে কাজ করা হয় তা নয়। জুতা, ব্যাগ, গয়না অন্যান্য সাজের মাধ্যমেও বিভিন্ন মোটিফ তুলে ধরা হয়। মোটিফভিত্তিক এসব পোশাক আড়ং, যাত্রা, অঞ্জন, দেশাল, খুঁত ইত্যাদি যেকোনো দেশীয় ব্র্যান্ডের দোকানে পাওয়া যাবে। এছাড়া অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন পেইজও এখন মোটিফভিত্তিক পোশাক নিয়ে কাজ করছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 5 =