ফ্রিল্যান্সিংয়ে ক্যারিয়ার ও টিপস

আশফাক আহমেদ

ফ্রিল্যান্সার, বাংলায় বলা যেতে পারে মুক্ত পেশাজীবী। নয়টা-পাঁচটা চাকরির ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকা নয়। বাসা কিংবা যে কোনো স্থানে, যেকোনো সময় কাজ করতে পারেন ফ্রিল্যান্সাররা। প্রয়োজন নিজের দক্ষতা, বিদ্যুৎ আর গতিশীল ইন্টারনেট সংযোগ। বর্তমানে দেশে প্রায় ১০ লাখ তরুণ ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করেন। ঘরে বসে আয় করেন হাজারো ডলার। লেখাপড়া শেষ দিকে থাকা বা চাকরি খোঁজার কথা তাদের অনেকেই স্বাবলম্বী জীবনযাপন করছেন ফ্রিল্যান্সিং করে। অনেকের মনে প্রশ্ন কীভাবে? যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মী নিলে খরচ বেশি হয়। অনেক সময় চাহিদামতো কর্মী পাওয়া যায় না। তখন তারা বাইরে থেকে (আউটসোর্সিং) নির্দিষ্ট কাজটি করিয়ে নেয়। এতে ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অর্থ সাশ্রয় হয়, তেমনি যেকোনো স্থান থেকে কাজটি করে ওই ব্যক্তিও আয় করেন। বেশির ভাগ কাজ মেলে নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইটে। তথ্যপ্রযুক্তির ভাষায় এগুলো ‘অনলাইন মার্কেটপ্লেস’ বা অনলাইন কাজের বাজার।

দেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। ২০০৫-০৬ সাল থেকে দেশে মূলত ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ আসা শুরু হয়। এখন বাংলাদেশ থেকে ১৫৩টির বেশি মার্কেটপ্লেসে কাজ করা হয়। সব মিলিয়ে বার্ষিক আয় হয় প্রায় ১০০ কোটি ডলার। এই ফ্রিল্যান্সারদের ৫৫ শতাংশেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছর। তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো কম। ফ্রিল্যান্সিংয়ে সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষে ভারত। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। তবে আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের দক্ষতা বাড়াতে ২০১৪ সাল থেকে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পের মাধ্যমে তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে হাজারো ফ্রিল্যান্সারকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে। এসব কার্ডধারী ব্যক্তি ব্যাংক ঋণ সুবিধা পাবেন। ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আয়ের অর্থ আনলে ৪ শতাংশ প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে চাকরির বাজার ছোট হলেও ফ্রিল্যান্সিং কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। এখন ডিজিটাল বিপণন, এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন), গ্রাফিক ডিজাইন ও লোগো তৈরি, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কাজের চাহিদা বেশি। এছাড়া কনটেন্ট রাইটিং (মূলত পণ্য বা সেবার বর্ণনা বা প্রচারণামূলক লেখা), মডার্ন ফটোগ্রাফি, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও হিসাবরক্ষণ বিষয়ের চাহিদা রয়েছে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে আয় হয় দু’ভাবে। একটি অ্যাকটিভ আর্নিং। এটি হচ্ছে সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে কাজ করে আয় করা। আরেকটি প্যাসিভ বা পরোক্ষ আয়। এটি হচ্ছে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেস থেকে কাজ করে আয় করা। বাংলাদেশে জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস হচ্ছে আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার ডটকম, ফাইভার, গুরু ডটকম, টপটাল, পিপলপারআওয়ার ইত্যাদি। মার্কেটপ্লেসে কাজ পেতে পারিশ্রমিক ও সময় জানাতে হয়। কাজদাতা পারিশ্রমিক ও পোর্টফোলিও দেখে যোগ্য ব্যক্তিদের কাজ দেন। নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা থাকলে ফ্রিল্যান্সার হওয়া খুবই সহজ। তবে ফ্রিল্যান্সিং করার আগে আপনি কোন বিষয়ে (গ্রাফিক ডিজাইন, মার্কেটিং, ওয়েব ডিজাইন ইত্যাদি) দক্ষ, তা ভালোভাবে জানতে হবে। এসব মার্কেটপ্লেসে বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক কাজের সুযোগ রয়েছে। ফলে চাইলেই যেকোনো বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করতে পারেন।
অনলাইন মার্কেটপ্লেসে সঠিক নিয়মে কাজের প্রস্তাব পাঠানোর উপায় জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে কাজ পান না। ক্লায়েন্টের সঙ্গে সঠিকভাবে কাজ নিয়ে আলোচনার পদ্ধতি না জানা বা চাহিদা না বুঝে ভুল বার্তা পাঠানোই এর অন্যতম কারণ। ফ্রিল্যান্সারদের অনেকে শুরুতে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও বেশ কিছু কৌশল কাজে লাগিয়ে ক্লায়েন্টদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব। প্রথমেই সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট যে দেশে বসবাস করেন, সে দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান জানতে হবে। এরপর সেই দেশের সময় অনুযায়ী ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজের প্রস্তাব বা প্রোপোজাল পাঠাতে হবে। ভুল সময়ে কাজের প্রস্তাব পাঠালে ক্লায়েন্ট অনলাইনে না থাকায় সেটি তাৎক্ষণিক পড়তে পারেন না। পরের দিন তিনি যখন কাজ শুরু করবেন, ততক্ষণে আপনার মতো অনেক ফ্রিল্যান্সারের কাজের প্রস্তাব তার কাছে জমা হয়ে যাবে। ফলে আপনার বার্তা ক্লায়েন্টের চোখ এড়িয়েও যেতে পারে। তাই ক্লায়েন্ট যে দেশে বসবাস করেন, সে দেশের কর্মঘণ্টা অনুযায়ী কাজের প্রস্তাব পাঠাতে হবে। কাজের প্রস্তাব পছন্দ হলে ক্লায়েন্টরা সাধারণত ফিরতি বার্তা পাঠান। বেশির ভাগ সময় একাধিক ফ্রিল্যান্সারকে ফিরতি বার্তা পাঠান ক্লায়েন্টরা। ফলে আপনি দেরিতে বার্তার উত্তর পাঠালে ক্লায়েন্ট অন্য কোনো ফ্রিল্যান্সারকে কাজ দিয়ে দেবেন। ক্লায়েন্টের বার্তা আসার পর দ্রুত যোগাযোগ করলে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ৪টি টুল জরুরি। এরমধ্যে ফ্রিল্যান্সিংয়ে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি সবার আগে আলোচনায় আসে। আর তাই ফ্রিল্যান্সিং কাজের জন্য আলাদা একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। ফলে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছ থেকে নগদ বা চেকের মাধ্যমে পারিশ্রমিক সংগ্রহ করার পাশাপাশি হিসাবও রাখা যাবে। ফ্রিল্যান্সিং কাজের ক্ষেত্রে যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে জি-স্যুট বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, এতে জিমেইল, জি-ড্রাইভ, জি-ডক, জি-শিট, জি-স্লাইড ব্যবহার করা যায়। প্রতি মাসে পাঁচ ডলার খরচ করে ক্লাউড স্টোরেজ সুবিধাও ব্যবহার করা যাবে। জিমেইল দিয়ে যোগাযোগের পাশাপাশি জি-ডক এবং জি-শিট ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক মন্তব্য ও রিপ্লাই দেওয়ার সুযোগ থাকায় বিভিন্ন কাজে ক্লায়েন্টদের সহযোগিতা পাওয়া যায়। ফ্রিল্যান্সিংয়ে একটি কাজ করতে কত সময় লাগছে, তা চিহ্নিত করা জরুরি। কাজের দক্ষতা পর্যালোচনার পাশাপাশি কোন ক্লায়েন্টের কোন কাজের জন্য কত সময় ব্যয় হচ্ছে, তা জানার জন্যও ট্র্যাকিং টুল বেশ কার্যকর। টগল ও জিমেইল টাইম ট্র্যাকার এমন দুটি টুল। টগল খুব সহজে ব্যবহার করা যায়। চালু ও বন্ধ করে এর মাধ্যমে সময় ট্র্যাক করা যায়।

জিমেইল টাইম ট্র্যাকার হলো ক্রোমের একটি এক্সটেনশন। এটি বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। ফ্রিল্যান্সিং করার সময় অবশ্যই কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় টুল ব্যবহার করতে হবে। যেমন কনটেন্ট লেখকদের জন্য হেমিংওয়ে, গ্রামারলি বা গুগল ডকের মতো টুল খুবই প্রয়োজনীয়। ফ্রিল্যান্সারদের কাজের ধরন এবং ভিন্নতার ওপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় টুল শনাক্ত করতে হবে।

একবার কাজ করে আজীবন আয়। শুনতে অবাক লাগলেও আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া-নেওয়ার বেশ কিছু ওয়েবসাইট অনলাইন মার্কেটপ্লেস এ সুবিধা দিয়ে থাকে। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদে আয়ের জন্য অবশ্যই নির্দিষ্ট বিষয়ে (ছবি, ডিজাইন, ভেক্টর, আইকন, ছবি বা থিম) দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এরপর মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খুলে কাজ জমা দিতে হবে। কোনো কাজ বিক্রি হলে ক্রিয়েটরকে কমিশনের অর্থ দেবে মার্কেটপ্লেস। মজার বিষয় হলো, কাজ যতবার বিক্রি হবে ততবারই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আয় হবে। ফলে ভালো মানের বিভিন্ন কাজ মার্কেটপ্লেসে জমা রেখে দীর্ঘ মেয়াদে আয় করা যায়। চাইলে কোনো কাজ একবারেও বিক্রি করে দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো ওই কাজ আর কোথাও বিক্রি বা প্রদর্শনের জন্য দেওয়া যাবে না।

দীর্ঘ মেয়াদে আয়ের সুযোগ দেওয়া মার্কেটপ্লেসগুলোর কাজের পদ্ধতি সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। কিছু মার্কেটপ্লেসে কাজ জমা রাখলে, সেই কাজ অন্য কোনো জায়গায় বিক্রি করা যায় না। আবার কিছু মার্কেটপ্লেসে এ ধরনের বিধিনিষেধ নেই। যে মার্কেটপ্লেসেই কাজ করেন না কেন, অন্যের মেধাস্বত্ব আছে এমন কোনো কাজ জমা দেওয়া যাবে না। এবং অবশ্যই মানসম্পন্ন সৃজনশীল কাজ জমা রাখতে হবে। কারণ, কাজের মান ভালো না হলে সেগুলো কেউ কিনবে না। ফলে আয়ও হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে আয়ের সুযোগ দেওয়া জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেসগুলোর মধ্যে অন্যতম এনভারটো। এই মার্কেটপ্লেসে ভিডিও, গ্রাফিকস, টেমপ্লেট, ছবি, ত্রিমাত্রিক ফন্ট, ওয়েবসাইট থিমসহ বিভিন্ন নকশা, কনটেন্ট জমা রাখা যায়। এই মার্কেটপ্লেসে ক্রেতার সংখ্যাও অনেক বেশি। ফলে ভালো মানের কাজ জমা দিয়ে নিয়মিত আয় করা যায়। মার্কেটপ্লেসটি কাজের মানের ভিত্তিতে ১২.৫ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিয়ে থাকে। এনভারটোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হলেও গ্রাফিকরিভার মার্কেটপ্লেসে গ্রাফিকস, প্রেজেন্টেশন, আইকন/ভেক্টর, ছবি, ভিডিও, অডিওসহ বিভিন্ন কাজ জমা রাখা যায়। মার্কেটপ্লেসটি সাধারণত মান যাচাই করে কাজ জমা রাখে। ফলে একবার কাজ জমা রাখতে পারলে নিয়মিত আয় করা যায়। ফ্রিপিক মার্কেটপ্লেসে নকশা, ভেক্টর, আইকন, ছবি বা থিম জমা রেখে আয় করা যায়। মার্কেটপ্লেসটি অর্থের বিনিময়ে বা বিনামূল্যে বিভিন্ন কাজ অন্যদের ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে থাকে। কোনো কাজ এক হাজারবার ডাউনলোড হলেই ন্যূনতম ১৫ ডলার দিয়ে থাকে মার্কেপ্লেসটি। বিক্রি করা কাজগুলো থেকেও কমিশন পাওয়া যায়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ট্রেক টেন্ড

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen − 14 =