বর্ষায় ত্বকের যত্ন

বারো মাস নানা ধরনের ত্বকের সমস্যা থাকলেও বছরের কিছু সময় ত্বকের সমস্যা বেড়ে যায়। যেমন শীতের সময় সবাই নিজের ত্বক নিয়ে বাড়তি সচেতন হয়ে ওঠে। কারণ এ সময় রুক্ষতার পাশাপাশি ত্বকে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু বর্ষাকালে আমাদের ত্বকে দেখা দেয় নানা রকম সমস্যা এমনকি ফাংগাল ইনফেকশনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায় এ সময়। বর্ষার সময় অসচেতন থাকার ফলে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ দেখা দিয়ে থাকে। এ সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। তাই জেনে নেওয়া যাক এই ঋতুতে চর্মরোগ বা ত্বকের যে কোন সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় ।

ছত্রাক সংক্রমণ

বর্ষাকালে বৃষ্টি হবার কারণে আবহাওয়া সাধারণত স্যাঁতস্যাতে থাকে। এমন আবহাওয়ার কারণে মূলত ছত্রাক সংক্রমণের প্রবণতা বেড়ে যায়। দেহের বিভিন্ন স্থানে ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে, বিশেষ করে যে স্থান আলো বাতাস কম পায় সেখানে। একটি পরিচিত ছত্রাকবাহিত রোগ হচ্ছে দাদ। বর্ষাকালে দাদে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্য ঋতু থেকে বেড়ে যায়। সাধারণত তলপেট, পেট, কোমর, পিঠ, মাথা, কুঁচকি ইত্যাদি স্থানে বেশি আক্রান্ত হয়। অনেকের মুখেও দাদ উঠতে দেখা যায়, যা অত্যন্ত বিব্রতকর। আক্রান্ত স্থানে চুলকানোর পর সেই হাত অন্য স্থানে লাগলে সেখানেও দাদ হবার সম্ভাবনা থাকে। দাদ প্রচণ্ড চুলকায় যা মাঝের মধ্যে অসহনীয় হয়ে যায়। এটি হলে চামড়ার ওপর গোলাকার ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় আক্রান্ত স্থান থেকে কষ পড়ে ও ফুলে যায়। দাদ ছোঁয়াচে রোগ, দাদ আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো জিনিস ব্যবহার করলে খুব সহজেই দাদ ছড়িয়ে পড়ে। রোগীর চিরুনি, তোয়ালে, বিছানা ইত্যাদি ব্যবহার করলে বা আক্রান্ত রোগীর জামাকাপড় পরলেও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দাদ হলে সাধারণত চামড়ার ওপর গোলাকার ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এটি দেখতে অনেকটা চাকার মতো, যার কিনার সামান্য উঁচু হয়। যতই দিন যায়, চাকার পরিধি তত বাড়তে থাকে, আর কেন্দ্রের দিকে বা ভেতরের দিকে ভালো হয়ে যেতে থাকে। অনেক সময় মাথার চামড়াতেও দাদ হয়ে থাকে, তখন আক্রান্ত স্থানের চুল পরে যায়। যাদের আগের থেকে এলার্জি সমস্যা রয়েছে তারা দাদে আক্রান্ত হলে এটি অনেক মারাত্মক আকার ধারণ করে।

ঘামাচি

বর্ষাকালে আবহাওয়ার তাপমাত্রা সাধারণত উঠানামা করে। প্রবল বৃষ্টি হলে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে আবার কিছুক্ষণ পর রোদ উঠে আবার গরম হয়ে যায়। বর্ষাকালের তীব্র রোদে ঘর থেকে বের হলে শরীর ঘেমে ঘামাচির সৃষ্টি হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং ওজন বেশি তারা খুব সহজে ত্বকের যেকোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। গরমকালে বর্ষাকালে ঘামাচি অত্যন্ত সাধারণ সমস্যা। শরীরে ঘামাচি উঠলে খুব সহজে তা বোঝা যায়। ছোট ছোট পোস্টার মত হয়ে এটি প্রচণ্ড চুলকায় যা অনেক সময় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রুক্ষ ত্বকে অনেক বেশি চুলকানি হয়, ঘামাচির ফলে ত্বক রুক্ষ হয়ে গিয়ে আরো চুলকানি বেড়ে যায়। ঘামাচি হলে পুরো ত্বক অনেক সময় লাল হয়ে যায়। বগল, পিঠ, কনুই ইত্যাদি স্থানে ঘামাচি উঠতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি পিঠে ঘামাচি উঠতে দেখা যায়, যেখানে ঘাম বেশি হয় সেখানেও ঘামাচির প্রবণতা বেশি থাকে।

ত্বকের লোমকূপে যে ঘর্মগ্রন্থি থাকে, গরম ও ঘামের কারণে তার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে সে জায়গা লাল হয়ে ফুলে ওঠে। এই ফুলে উঠাকেই ঘামাচি বলে। ঘামাচি ভালো হতে ৩ সপ্তাহ থেকে ১ মাস সময় লাগে। ঘামাচির চুলকানোর জন্য অনেকে রাতে ঘুমাতে পারে না। ঘামাচি নিজে থেকে ভালো হয়ে গেলেও এতদিন শরীরে ঘামাচি থাকে অনেক অস্বস্তিকর অনুভূতি দেয় ও বিভ্রান্তকর অবস্থায় ফেলে দেয়। ঘামাচি অতিরিক্ত চুলকাতে চুলকাতে অনেক সময় চামড়া দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। তখন জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি হয়।

ব্রণ

বর্ষাকালে ত্বকে ব্রণের প্রবণতা বেড়ে যেতে দেখা যায়। সেবাসিয়াস গ্রন্থি সেবাম নামে একপ্রকার তৈলাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করে যা ত্বককে মসৃণ রাখে। কোনো কারণে সেবাসিয়াস গ্রন্থির নালির মুখ বন্ধ হয়ে গেলে সেবাম নিঃসরণের বাধার সৃষ্টি হয় এবং তা ভেতরে জমে ফুলে উঠে যা ব্রণ নামে পরিচিত।  ব্রণের সমস্যা সবচেয়ে বেশি মুখে দেখা গেলেও পিঠে, হাতে বিভিন্ন স্থান এটি হতে পারে। বর্ষাকালে ত্বক রুক্ষ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক সময় গরমের কারণে তৈলাক্ত হয়ে যায়। তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বর্ষাকালে অনেকে পানি কম পান করে থাকে এ সমস্যার কারণেও ব্রণ হয়ে থাকে। অনেকে খুব ঘনঘন পানি দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে থাকে এতে মুখের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট হয়ে ত্বক রুক্ষ হয়ে যায় এবং ব্রণের প্রবণতা বেড়ে যায়।

ত্বক সুস্থ রাখতে

সারা বছরই নিজের ত্বকের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন বিশেষ করে যাদের ত্বক সংবেদনশীল। কিন্তু কিছু ঋতুতে ত্বকের বাড়তি যত্ন নেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাই বর্ষাকালের শুরুতেই আমাদের ত্বকের যত্নে রুটিনের কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। অনেকে সারা বছর ধরে একই ত্বকের যত্নের রুটিন ফলো করে এতে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। কারণ ঋতুর পাশাপাশি আমাদের ত্বকও তার ধরন পরিবর্তন করে ফেলে। তাই ত্বকের ধরন বুঝে একটি ত্বকের যত্নের রুটিন তৈরি করা প্রয়োজন। যেহেতু বর্ষাকালে ছত্রাক সংক্রমণে প্রবণতা বেড়ে যায় তাই এক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। যেসব স্থানে ছত্রাক সংক্রমণ হওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে সেসব স্থান পরিষ্কার রাখতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে ভেজা জামাকাপড় যাতে বেশিক্ষণ পড়ে থাকা না হয়। ঘামে দীর্ঘ সময় ভিজে থাকলে সেখানে ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে তাই ঘামে ভেজা পোষাক ও বেশিক্ষণ পরে থাকা যাবে না।

অনেকেই বর্ষাকালে আকাশ মেঘলা দেখলে গোসল এড়িয়ে যায় কিন্তু বর্ষাকালে নিয়মিত গোসল করা উচিত। গোসলের সময় সঠিক সাবান শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে এতে ত্বকের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তোয়ালে, চিরুনি, সাবান ইত্যাদি চেষ্টা করতে হবে অন্য কারোটা ব্যবহার না করার। কারণ ছত্রাক সংক্রমণ সাধারণত ছোঁয়াচে হয়। অন্য কারো থেকে এ রোগ ত্বকে সৃষ্টি হতে পারে। বর্ষাকালে যাদের মুখ অতিরিক্ত তৈলাক্ত হয়ে যায় তাদের ঘরে তৈরি করা বিভিন্ন ধরনের প্যাক ব্যবহার করতে হবে। টোনার ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করে, হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে। সে ক্ষেত্রে শসা এবং টমেটোর রস দিয়ে ঘরে তৈরি করে নিতে পারেন টোনার। বর্ষাকালে প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। চেষ্টা করতে হবে এ সময় পুরানো প্রসাধনী ব্যবহার না করে নতুন করে ত্বকের ধরন অনুযায়ী তা ব্যবহার করা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বিকল্পের কিছুই হতে পারে না তাই যেকোনো ধরনের ত্বকের সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য প্রতিদিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং পরিষ্কার ধোয়া কাপড় পড়তে হবে। ত্বক ভেতর থেকে ভালো রাখার জন্য খাবারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ত্বকের দূষিত পদার্থ দূর করার জন্য প্রতিদিন দেহের চাহিদা অনুযায়ী পানি পান করতে হবে। এছাড়া তাজা ফলের রস, ডাবের পানি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়। তাই যে সব খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় শরীরকে পুষ্টি দেয় ভিটামিন দেয় সে সব খাবার গ্রহণ করতে হবে। ভিটামিন সি যেকোনো ধরনের প্রদাহ দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে, তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন সি জাতীয় খাবার রাখতে হবে। কিছু ত্বকের সমস্যা ঘরোয়া পদ্ধতিতে কিংবা নিজের চেষ্টায় ভালো হতে চায় না সে ক্ষেত্রে অবশ্যই দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আরশী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × two =