বর-বৌ যখন জামাই-বৌ

মাহবুব আলম

আমাদের দেশে, বাঙালি সমাজে শ্বশুর-জামাই, জামাই-শ্বাশুড়ি সম্পর্ক বেশ অম্ল-মধুর সম্পর্ক। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর মেয়ের মা-বাবা কারণে অকারণে মেয়ের স্বামীর বা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির উপর রাগ অভিমান এমনকি খুব ক্ষোভ সত্ত্বেও জামাইকে আদর যত্ন-স্নেহ-ভালোবাসা দেয়। আর এই জন্যই বাংলা ভাষায় বহুল আলোচিত প্রবাদ ‘জামাই আদর’ কথার প্রচলন হয়েছে। জামাইষষ্ঠী এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিজ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে জামাইকে সপ্তব্যাঞ্জনে আপ্যায়ন করে। আধুনিককালে জামাইষষ্ঠীতে রুই-কাতলার পাশাপাশি ইলিশের বিভিন্ন পদ দিয়ে আপ্যায়ন করা একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে জামাইকে নতুন জামা-কাপড় উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। এটা শুধু নতুন জামাইকে নয়, এটা করা হয় বছরের পর বছর ধরে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুল্কা ষষ্টীতে।

হিন্দু সমাজের মতো মুসলিম সমাজে বছরে নির্দিষ্ট দিনে বিশেষ আয়োজন অনুষ্ঠানের রীতি নেই। তার অর্থ এই নয় যে, মুসলিম সমাজে এই জামাই আদর নেই। বরং মুসলিম সমাজেই জামাই আদর আরো বেশি। মুসলিম সমাজে দুই ঈদ, নববর্ষসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে জামাইকে বিশেষভাবে আপ্যায়ন করা হয়। কোরবানির ঈদে যারা কোরবানি দেন তারা সর্বাগ্রে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে অর্থাৎ জামাই বাড়িতে গরুর রানটা পাঠান। এছাড়াও বিভিন্ন পালা-পার্বণে জামাইকে উপহার প্রেরণ করেন।

এবার দেখা যাক জামাই কে বা কী। বাংলা অভিধানে বলা আছে ‘জামাই হচ্ছে, কন্যা বা কন্যাস্থানীয়া (ভাগ্নি ভাতিজি ইত্যাদি) মেয়ের স্বামী’। অর্থাৎ কন্যা বা কন্যাস্থানীয়র সঙ্গে কন্যার মা-বাবা সম্পর্ককে বলা হয় জামাই বা জামাতা। এছাড়াও জামাই নামে আরো একটি মধুর সম্পর্ক আছে তাহলে ‘জামাইবাবু’। এই সম্পর্ক হল শালা ও শ্যালিকার সঙ্গে। কারো বড় বোনের বিয়ে হলে ওই বোনের স্বামীর সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক তার নাম জামাইবাবু। মুসলিম সমাজে যাকে ‘দুলাভাই’ বলা হয়।

এ থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে জামাই একটা আদরের সম্পর্ক, মধুর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক কোনো অবস্থাতেই স্বামী-স্ত্রী অর্থাৎ বর-বৌ সম্পর্ক বুঝায় না। কিন্তু ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে বর-বৌ অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ককে বুঝাতে অনেকেই ‘জামাই-বৌ’ বলছে। তারাই ফলশ্রুতিতে ঢাকায় রিকশা ভ্যানে কোথাও কোথাও যে চানাচুর বিক্রি হয় সেই চানাচুরের নামকরণ করা হচ্ছে ‘জামাই-বৌ চানাচুর’।

চানাচুর বিক্রেতার মতো ভুল করে ইদানিং অনেকেই বলেন জামাই-বৌ। এমনকি অনেক শিক্ষিত স্ত্রীরাও কারো সঙ্গে তার স্বামীর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেন আমার জামাই। শুধু তাই নয়, এই ঢাকা শহরে অনেকেই কন্যার মা তার মেয়েকে বলেন কিরে তুই একা এলি যে তোর জামাই এলো না কেন? লক্ষ্য করুন, বলছে তোর জামাই, তার জামাই নয়।

সম্প্রতি এই বিষয়টা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি। আলোচনা করে বিস্মিত হয়েছি। কারণ অনেকেই বলেছেন জামাই-বৌ এই নিয়ে আলোচনার কি আছে। জামাই তো জামাই। এটা বলার পর আমি যখন বললাম, জামাই মানে কি? তখন অনেকেই এক বাক্যে বলে ওঠেন জামাই মানে হাজবেন্ড, স্বামী। এই নিয়ে আলোচনার কোনো অর্থ নেই। এই জবাব শুনে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়, জামাই-বৌ যদি স্বামী-স্ত্রী হয় তাহলে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সঙ্গে কন্যার স্বামীর সম্পর্ক কি হবে? তা কি কন্যার স্বামী যেমন তার জামাই ঠিক একইভাবে কন্যার বাবা-মা-ও তার স্বামীর জামাই হবে? না অন্য কোনো সম্পর্ক হবে?

দেখে শুনে মনে হচ্ছে চানাচুর ওয়ালারাই আমাদের সম্পর্ক-সংস্কৃতি নির্ধারণ করবে এবং করছেও। এই যদি হয় তাহলে শ্বশুর-জামাই সম্পর্কের কি হবে? জামাইষষ্ঠীরই বা কি পরিণতি হবে। কি পরিণতি হবে জামাই আদরের? সেই সাথে বাংলা অভিধানেও পরিবর্তন আনতে হবে। এইজন্য কি আমরা প্রস্তুত আছি। যদি থাকি তারও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো একটা ভুল আরো নতুন ভুলের জন্ম দিবে। এবং ভুলে ভুলে ভরে যাবে আরো অনেক কিছু। তখন সেই ভুল সামাল দেওয়া বেশ কঠিন হবে। তাই আশা করি এর বিষয়ে এখনই নজর দেওয়া হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seven − 1 =