বাঁশিবাদকই হতে চেয়েছিলেন গাজী আবদুল হাকিম

অলকানন্দা মালা

একবার লন্ডনের এক রেস্তোরাঁয় বাঁশি বাজাচ্ছিলেন বাংলাদেশের এক বংশীবাদক। বড় অদ্ভুত ছিল তার বাঁশির সুর। মুহূর্তেই মোহিত করেছিল ওই রেস্তোরাঁয় উপস্থিত ভিনদেশিদের। তাই তারাও জড়ো হয়ে শুনছিলেন তার বাঁশি। হঠাৎ সে ভিড়ে উপস্থিত ভিনদেশিদের মধ্যে দেখা গেল এক পরিচিত মুখ। ভদ্রলোক সকলের কাছে ম্যাকগাইভার নামে পরিচিত। জনপ্রিয় সিরিজ ম্যাকগাইভারের কেন্দ্রিয় চরিত্রের অভিনেতা রিচার্ড ডিন অ্যান্ডারসনের কথাই বলছিলাম।

বাংলাদেশের সেই বংশীবাদকের সুর তাকে এতটাই মুগ্ধ করল যে তিনি একমনে উপভোগ লাগলেন তার বাঁশি বাজানো। বাঁশিবাদকও খুশি হয়ে ম্যাকগাইভারকে তার বাঁশির একটি অ্যালবাম উপহার দেন। এরপর থেকে রোজই ম্যাকগাইভার আসতে লাগলেন বাঁশি শুনতে। তাই দেখে ম্যাকগাইভারের বান্ধবী তো ওই বাঁশি বাদককে বলেই ফেললেন, তোমার বাঁশিতে কী এমন যাদু আছে যে ওকে আমার থেকে তোমার দিকে নিয়ে যাচ্ছে!

বলছিলাম প্রখ্যাত বাঁশিবাদক গাজী আবদুল হাকিমের কথা। ঘটনাটি অনেক বছর আগের। সেবার লন্ডনে বাংলাদেশি শিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল লন্ডন ফেস্ট অব বাংলাদেশ। সে উৎসবে অংশ নিতে দেশ থেকে লন্ডনের উড়ে গিয়েছিলেন স্বনামধন্য সব শিল্পীগণ। সেই দলেই ছিলেন আবদুল হাকিম। তবে তার বাঁশি সুরে শুধু ম্যাকগাইভার না, পাগল হয়েছিলেন পৃথিবীর নামিদামী অনেক সংগীতজ্ঞরা। বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে তিনি সম্মোহিত করেছেন হাউজ অব কমন্সসহ বিশ্বের নামকরা সব স্থান। সম্প্রতি সংগীতে অসামান্য অবদান রাখার কারণে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে গুণী এই যন্ত্রসংগীত শিল্পীকে।

প্রথম জীবন

১৯৫৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চেচুরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল হাকিম। তার পিতা মো. সাদেক আলী গাজী এবং মাতা সকিনা বেগম। ছোটবেলায় মা তাকে ঘুম পাড়াতেন গান শুনিয়ে। ফলে তখন থেকেই কানের মধ্যে সুর খেলা করত তার। এছাড়া চেচুরী গ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত একটি অঞ্চল। বারো মাসে তের পার্বন লেগেই থাকত সেখানে। ফলে ঢোল ঢাক আর বাঁশির সুর ছিল সে গ্রামের নিত্যদিনের সংগী। আবদুল হাকিমের বাঁশিপ্রেমি হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ ছিল।

বাঁশি শিক্ষা

মাত্র পাঁচ ছয় বছর বয়সে বাঁশি হাতে তুলে নেন আবদুল হাকিম। বাঁশি শিক্ষায় তার হাতেখড়ি হয় পাশের গ্রামেরই এক প্রধান শিক্ষকের কাছে। পরে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাঁশি শিক্ষা গ্রহণ করেন মুকুল বিশ্বাসের কাছে। মুকুল বিশ্বাসের গুরু ছিলেন দুলাল বহর। গুরু-শিষ্য দুজনের নিকটই বাঁশির তালিম নেন আবদুল হাকিম। এছাড়া তখন খুলনা রেডিওর মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন শেখ আলী আহমেদ ও বিনয় রায়। তারাও বাঁশিতে ছিলেন খুব নামকরা। তাদেরকেও গুরু মেনেছিলেন হাকিম।

বাঁশির প্রতি টান ছিল তার

বালক বয়সেই বাঁশির প্রতি জন্মেছিল আবদুল হাকিমের গভীর টান। চেচুরী গ্রামে মেলা লেগেই থাকত। অন্যান্য বালকদের মতো আবদুল হাকিমও বাবার হাত ধরে যেতেন সেসব মেলায়। তবে সমবয়সীরা মেলায় গিয়ে খেলনা কেনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেও হাকিম তা করতেন না। তিনি খুঁজে বেড়াতেন বাঁশির দোকান। মেলা থেকে বাঁশি কিনে তবেই বাড়ি ফিরতেন তিনি।

পেশাদার বাঁশিওয়ালা

পরিবারের সবার আপত্তি উপেক্ষা করে হয়েছিলেন পেশাদার বাঁশিওয়ালা। ১৯৬৬ সালের দিকে নাটকে, যাত্রায় বাঁশি বাজানো দিয়ে পথচলা শুরু হয় তার। সেসময় পারিশ্রমিক হিসেবে পেতেন ১০-১৫ টাকা। এতে মোটেও আফসোস ছিল না তার। বরং বাঁশি বাজি যে আয় হচ্ছে সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। পরে ১৯৭৩ সালে খুলনা বেতারে যোগ দেন তিনি। প্রায় এক দশকের মতো সেখানেই ছিলেন।

ব্যস্ত বাঁশিবাদক

আবদুল হাকিম আশির দশকে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৮৪ সালে ঢাকা বেতারে চাকরি নেন তিনি। যোগ দেন আলাউদ্দিন লিটল অর্কেস্ট্রায়। শুরু করেন চলচ্চিত্র ও অডিও অ্যালবামে বাঁশি বাজনো। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন ব্যস্ত বাঁশি বাদক। এরপর আর পেছনে তাকানোর সময় পাননি তিনি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে দিয়েছেন বাঁশির সুর। অনেক আন্তর্জাতিক উৎসবে বাঁশি বাজিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনে সকলকে সম্মোহিত করেছেন বাঁশির সুরে। ১৯৯৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাঁশি বাজিয়েছিলেন আবদুল। সেদিনের সেই সুখস্মৃতি আজও ভেসে উঠে তার মানসপটে। মনে পড়ে লাভেলো থিয়েটারের কথাও। সেখানে স্ত্রী স্বনামধন্য লালনসংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীন ও তার একটি অনুষ্ঠান ছিল। ওই অনুষ্ঠানে ফরিদা পারভীন যেমন সবাইকে শুনিয়েছিলেন সাইজির বানী তেমনই তিনি বেঁধেছিলেন বাঁশির মায়াজালে। এছাড়া ১৯৯০ সালের ডালাসের কথাও ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে একটি অনুষ্ঠানে তার বাঁশিতে সম্মোহিত হয়েছিলেন দর্শক শ্রোতারা। এরকম আরও বেশকিছু আন্তর্জাতিক উৎসবে বাঁশি পরিবেশনের সুখস্মৃতি নাড়া দিয়ে যায় আবদুল হাকিমে মনে। এরমধ্যে জাপান, প্যারিস, নেদারল্যান্ড, হল্যান্ডের লাইভ প্রোগ্রাম উল্লেখযোগ্য। আবদুল হাকিমের বিশ্বজয়ের ইতিহাস এখানেই শেষ না। তিনিই একমাত্র বাঁশি বাদক যার কারণে বাঁশের বাঁশি সমাদৃত হয়েছে হলিউডে। সেখানকার একটি সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছিল তার বাঁশির সুর।

অর্জন

বাঁশি আবদুল হাকিমের, আবদুল হাকিম বাঁশির। স্বনামধন্য এ বাঁশি বাদক মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন কথাটি। হয়তো স্রষ্টাও এমনটা চেয়েছিলেন। সেকারণে একজীবনে তার যত অর্জন সবটাই এসেছে বাঁশি বাজিয়ে। তার বাঁশির সুর অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে নাটক সিনেমাকে। এর অনন্য উদাহরণ হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমনি সিনেমা। এই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড সংগীতে যে মন ছুঁয়ে যাওয়া বাঁশির সুর তা আবদুল হাকিমের। সিনেমার আবহ সংগীতের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। আরও একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন এই নাগরিক বাঁিিশয়ালা। তবে তার শিল্পীজীবনের সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ স্বীকৃতিটি সম্প্রতি পেয়েছেন তিনি। তা হলো একুশে পদক।

দেশত্ববোধে উদ্বুদ্ধ একজন মানুষ

বাঁশি বাদক আবদুল হাকিম কত গভীরভাবে যে দেশপ্রেম লালন করেন তা বোঝা যায় তার দৈনন্দিন জীবন চিত্রে। তিনি কাবলি পরতে পছন্দ করেন না। খান না রুটিও। এর একটাই কারণ। মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন পাকিস্তানিদের। ওই ঘৃণাবোধ থেকে রুটি ও কাবলি এড়িয়ে চলেন তিনি। অবশ্য দেশের প্রতি এমন গভীর টান আবদুল হাকিমেরই থাকার কথা। তিনি যে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অতন্দ্র প্রহরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা। আবদুল হাকিম তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বাঁশি বাজিয়েই কাটত তার বেলা। এমনই সময় উত্তাল হয়ে ওঠে এ জনপদ। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর আক্রমণে মানবতা বিপন্ন, পরাধীন দেশমাতৃকা। এমন চিত্র দেখে জেগে ওঠে হাকিমের দেশত্ববোধ। যে হাতে এতদিন বাঁশি বাজিয়েছেন সেই হাতে তুলে নেন অস্ত্র। ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে। সম্মুখ সমরের অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন তিনি। অস্ত্রহাতে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর বুক তাক করে তেমনই মৃত সহযোদ্ধার দেহটাও অসম্মানিত হতে দেননি প্রতিপক্ষের কাছে। একবার তার এক সহযোদ্ধা ধরা পড়েছিল পাক বাহিনীর হাতে। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার দেহ থেকে মাথা কেটে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল স্থানীয় বাজারে। এদিকে সহযোদ্ধা হত্যার যে প্রতিশোধ নেবেন সে উপায়ও ছিল না। কেননা চারপাশ থেকে হায়নাদের মুহুর্মুহু আক্রমণে ওই অঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে তাদের। শহীদ সহযোদ্ধার সঙ্গে এমন পাশবিক আচরণ দেখে জেদ চেপে বসে হাকিমের। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন প্রাণের বিনিময়ে হলেও মৃত সহযোদ্ধার লাশ দাফন করে শত্রু অধ্যুষিত অঞ্চলটি ছাড়বেন তিনি। পরে তাই করেছিলেন তিনি।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

একজীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই আবদুল হাকিমের। তিনি মনে করেন বাঁশি বাদক হিসেবে যতটা প্রাপ্য তার চেয়ে অধিক দিয়েছেন সৃৃষ্টিকর্তা। তবে নিজেকে নিয়ে এই বংশী বাদকের অপ্রাপ্তি না থাকলেও সামগ্রিকভাবে একটি আক্ষেপ রয়েছে তার। এই আক্ষেপ দেশের যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে। গান গেয়ে কণ্ঠশিল্পীরা রাতারাতি খ্যাতি ও ঐশ্বর্য পেয়ে গেলেও যন্ত্রশিল্পীদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। তারা অর্থ ও খ্যাতি দুদিক থেকেই রয়ে যান অবহেলিত। ফলে জীবনের একটা সময় এসে করতে হয় মানবেতর জীবনযাপন। এই সংস্কৃতি মানতে পারেন না বরেণ্য এই বাঁশি বাদক। তিনি মনে করেন, যে বাদ্যযন্ত্র কথাকে পরিপূর্ণ সংগীতে রূপ দেয় সেই যন্ত্রের বাদকের অবহেলিত থাকাটা মোটেই ভালো কথা না।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সূরের মূর্চ্ছনা 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

10 + ten =