বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবায়ু অভিযোজন জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ বিশ্বব্যাংকের

সরকার, বেসরকারি খাত ও কমিউনিটির মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু-স্মার্ট সমাধান গ্রহণে গতি বাড়াতে পারে, যা শুধু ঝুঁকি হ্রাস করে না, বরং টেকসই উন্নয়নকেও তরান্বিত করে। খবর বাসস

এই পদক্ষেপগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতায়িত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির পথে স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রগতি হবে।

আজ রাজধানীর একটি হোটেলে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ফ্রম রিস্ক টু রেজিলিয়েন্স: হেল্পিং পিপল অ্যান্ড ফার্মস অ্যাডাপ্ট ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

এতে উল্লেখ করা হয়, জলবায়ু অভিযোজনের চাপ মূলত পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর পড়েছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ সহনশীলতা গড়ে তোলার একটি অনন্য সুযোগ পেয়েছে। আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে বিনিয়োগ বড় ধরনের ঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে সাহায্য করেছে। এটি প্রমাণ করে লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠান স্থানীয় অভিযোজনকে সফলভাবে সম্প্রসারণে সহায়তা করতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যা, উচ্চ তাপমাত্রা এবং ভৌগোলিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি এবং বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

২০৩০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে থাকবে এবং প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে। উপকূলীয় অঞ্চলে পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু সংকট বাংলাদেশে কোটি মানুষের জীবনে কঠোর প্রভাব ফেলছে।

জলবায়ু ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি। কারণ আগামী ১০ বছরে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি পরিবার ও প্রতিষ্ঠান আবহাওয়াজনিত ধাক্কার আশঙ্কা করছে। ৬৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এবং ৮০ শতাংশ পরিবার ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বেশিরভাগই উন্নত প্রযুক্তি ও সরকারি অবকাঠামো ব্যবহার না করে মৌলিক ও স্বল্পব্যয়ী সমাধানের ওপর নির্ভর করছে।

বাংলাদেশের ২৫০টি উপকূলীয় গ্রামে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সবচেয়ে জরুরি অপূর্ণ চাহিদা।

দীর্ঘমেয়াদে ৫৭ শতাংশ পরিবার অপর্যাপ্ত দুর্যোগ-সুরক্ষা অবকাঠামোকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং ৫৬ শতাংশ পরিবার অভিযোজনের জন্য সীমিত আর্থিক সম্পদকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর প্রভাব শুধু পরিবেশগত নয়, বরং মানবিকও। কারণ দরিদ্র ও কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর ওপর এর আঘাত সবচেয়ে বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্বজনীন বিনিয়োগ, যেমন- বাঁধ নির্মাণ ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বহু প্রাণ বাঁচিয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি কমিয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের উদাহরণে দেখা যায়, লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং হালনাগাদ তথ্যের সমন্বয় দ্রুত সম্প্রসারণযোগ্য এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীকে কার্যকর সহায়তা প্রদান করতে পারে।

তবে সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে যেখানে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ সীমিত, সেখানে একটি বিস্তৃত নীতি প্যাকেজের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করা প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটান বিভাগের ডিরেক্টর জ্যঁ পেম বলেন, বাংলাদেশের জলবায়ু সহনশীলতা বারবার নতুনভাবে পরীক্ষিত হচ্ছে। অভিযোজন ব্যাপক হলেও ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে, ফলে আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। দেশের সহনশীলতা গড়ে তুলতে আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা, জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি এবং ঝুঁকিভিত্তিক অর্থায়ন বাড়াতে হবে। শহরাঞ্চলে লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপও জরুরি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি সমন্বিত ও বহুমুখী অভিযোজন কৌশল গ্রহণের তাগিদ দেয়। এতে বলা হয়— আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা, বীমা ও আনুষ্ঠানিক ঋণপ্রাপ্তি সহজ করা গেলে জলবায়ুজনিত ক্ষতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এড়ানো সম্ভব। বেসরকারি খাত যদি প্রয়োজনীয় স্থানে দ্রুত বিনিয়োগ ও সম্পদ স্থানান্তর করতে পারে, তাহলে অভিযোজনের গতি আরও বাড়বে। বাজেট সংকটের মধ্যেও সরকার পরিবহন ও ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থায়নে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি এবং নমনীয় সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো প্রবর্তনের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের উচিত নতুন সহনশীল প্রযুক্তি এবং সড়ক ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মতো জনকল্যাণমূলক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানো। যা কর্মসংস্থানে প্রবেশাধিকার বাড়াবে এবং মানবসম্পদ সুরক্ষায় সহায়তা করবে।

বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও প্রতিবেদনের সহ-লেখক সিদ্ধার্থ শর্মা বলেন, জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভিজ্ঞতার দিক থেকে যেমন উদাহরণ, তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ক্ষেত্রও।

তিনি বলেন, দেশের মানুষ ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অভিযোজন করছে। কিন্তু জলবায়ু সংকটের পরিধি ও জটিলতা বিবেচনায় সরকার ও বেসরকারি খাতের এখনই সমন্বিত ও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 + 12 =