বাংলাদেশের ভাবনায় এখন বিশ্বকাপ

উপল বড়ুয়া
‘ঘরে বাঘ, বাইরে বেড়াল’ বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে এই শব্দবন্ধ জুড়ে বসেছে বহুদিন হয়। বলতে গেলে, যখন থেকে বাংলাদেশ ৫০ ওভারের ক্রিকেটে হয়ে উঠেছে লড়াকু ও পরাক্রমশালী দল। আগে হতো কী, যখন বাইরে বা কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ বাজে পারফর্ম করে ফিরত, তখন সেই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আমন্ত্রণ জানাত জিম্বাবুয়েকে। এরপর মিরপুরে বসত টেস্ট মর্যাদা থাকা দুই কঠিন সময়ের বন্ধুর লড়াই। নিজের দেশে হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ওয়ানডে হোক বা টেস্ট, বাংলাদেশ প্রায় সিরিজ জিতে নিত। কিন্তু গত এক দশকে সেই চিত্র অনেকাংশে পাল্টেছে। এখন বাংলাদেশ বাইরের দেশে যে পারফরম্যান্স করুক না কেন, নিজেদের মাটিতে যেকোনো সংস্করণের সিরিজে যেকোনো দেশকে হারাতে সক্ষম। বাংলাদেশ সফরে এসে হারেনি এমন কোনো দল কি আর বাকি আছে? বা বাংলাদেশের বিপক্ষে অপরাজেয় এমন কেউ?

এই তো গত মার্চে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হারলেও সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে জিতেছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ। কেবল কি সিরিজ জয়! জস বাটলারদের পরাক্রমশালী ইংলিশদের প্রথমবারের মতো বাংলাওয়াশের স্বাদও দিয়েছে টাইগাররা। এরপর এপ্রিলে এসে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ জয়। টানা দুই সিরিজে দুর্দান্ত সাফল্যের ভেলায় ভর করে ভারতের মাটিতে আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে হতে যাওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপের জন্য যেন আত্মবিশ্বাসটাও চাঙা করে নিয়েছেন সাকিব আল হাসান-মুশফিকুর রহিমরা। কিন্তু ঘরের মাটিতে পাওয়া এমন জয়গুলো কি কাজে আসবে বিশ্বমঞ্চে? অতীতেও তো এমন ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে। অন্তত বাঘ হয়ে না গেলেও আত্মবিশ^াস নিয়ে বিশ^কাপে গিয়ে বাংলাদেশ ফিরেছে মাথা নিচু করে। তবে এবার তরুণ ও অভিজ্ঞদের মিশেলে টাইগাররা যেন সত্যিকারের হুংকার ছাড়ছে। এশিয়ার মাটিতে বিশ^কাপ বলে বাড়তি সাফল্যের আশা কি করতে পারে না বাংলাদেশ? দলে এসেছেন তাওহীদ হৃদয়ের মতো ব্যাটার ও হাসান মাহমুদের মতো পেসার। এমনকি জায়গা হারাতে হয়েছে আফিফ হোসেন ধ্রুবর মতো প্রতিশ্রুতিশীল ব্যাটারকেও এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মতো অভিজ্ঞ অলরাউন্ডারও আছেন সেই তালিকায়। বোঝা যাচ্ছে, বিশ^কাপের আগে আগে দলের ভেতরে বিশ্বকাপ স্কোয়াডের জায়গার জন্য একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে দিতে যাচ্ছেন প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাফল্যের হিসেবের তালিকায় এই শ্রীলঙ্কান কোচের নামটা বেশ ওপরের দিকেই থাকবে। দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোকে বিদায় জানানোর পর হাথুরু এসে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েছেন টাইগারদের। প্রথম মেয়াদের সাফল্যের পুনরাবৃত্তিও দেখা গেল শুরুতে। তার প্রমাণ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ জয়। বলতে গেলে, বিশ্বের চতুর্থ ধনী বোর্ড বিসিবি সবক্ষেত্রেই দারুণ দারুণ কোচ নিয়োগ দিয়েছেন তামিম ইকবালাদের জন্য। বিশ^কাপটাও বাংলাদেশ এই বাঁহাতি ওপেনারের নেতৃত্বে খেলবে। প্রধান কোচ হাথুরু তো থাকছেনই। বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড, স্পিন কোচ রঙ্গনা হেরাথ ও ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সকে নিয়ে সাজানো বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ। তার সঙ্গে সাকিব-তামিমদের মতো অভিজ্ঞদের নিয়ে ভরা দল; তাদের সঙ্গে হৃদয়-হাসানদের মতো তরুণেরা আগামী ওয়ানডে বিশ^কাপে বাংলাদেশ সাফল্য না পাওয়াই হবে আশ্চর্যের বিষয়।

বাংলাদেশের ২০২২-২৩ এফটিপির শুরুটাও হয়েছে দারুণভাবে। বছরের শেষদিকে তিন ওয়ানডে ও দুই টেস্ট সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতকে শুরুতেই চমকে দিয়েছিল স্বাগতিকরা। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ৫ রানের রোমাঞ্চকর জয় দিয়ে শুরু। সিরিজ জয়ের আশা দেখালেও ভারত পরের দুই ওয়ানডের সঙ্গে সিরিজটাও জিতে নেয়। তবে চট্টগ্রাম ও ঢাকা টেস্টে কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ অন্যতম শক্তি হলেও এতদিনেও এখনো অন্য দুই সংস্করণে খাপ খাওয়াতে পারেনি।

এরপর প্রায় এক মাসের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) চলল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মিলিয়ে। অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়ে ফ্র্যাঞ্জাইজি ক্রিকেটের ব্যস্ত সময় পার করে মার্চে সাকিবরা নেমে পড়লেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে ও তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে। তবে বেন স্টোকসের মতো বেশ কয়েকজন ইংলিশ তারকা ক্রিকেটার এই সফরে আসেননি। সেটি বড় বিষয় নয়, জাতীয় দল তো জাতীয় দলই। মিরপুরে প্রথম দুই ওয়ানডেতে ব্যাটিং ব্যর্থতায় বাটলারদের বিপক্ষে বাজে হার। এক ম্যাচ হাতে থাকতেই সিরিজ হেরে বসা বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ এড়ায় তৃতীয় ম্যাচে, চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। বলতে গেলে, চট্টগ্রামের মাটি সেভাবে কখনো নিরাশ করেনি টাইগারদের। দুঃখের বিষয়, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের কিউরেটর কয়দিন আগে ভারতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে মারা যান তার স্ত্রী। চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে সাকিব, মুশফিক ও নাজমুল হোসেন শান্তর ফিফটিতে ২৪৭ রানের লক্ষ্য দেয় বাংলাদেশ। অবশ্য পুরো ৫০ ওভারও খেলতে পারেনি তারা। তবে টাইগারদের পেস ও স্পিন আক্রমণের সামনে ৪৩.১ ওভারে ১৯৬ রানে শেষ ইংল্যান্ড। এবারও অলরাউন্ড নৈপুণ্য সাকিবের। ৭১ বলে সর্বোচ্চ ৭৫ রানের পাশাপাশি ১০ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট। ম্যাচসেরাও তিনি। এমন পারফরম্যান্সে আবারও আইসিসি মাচসেরার তিন জনের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।

ইংলিশদের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে জয়ের সফলতা বাংলাদেশ টেনে আনে টি-টোয়েন্টি সিরিজেও। চট্টগ্রামের প্রথম টি-টোয়েন্টি ৬ উইকেটে জয় পাওয়ার পর ঢাকায় ফিরে পরের দুই ম্যাচে যথাক্রমে ৭৭ রান ও ৭ উইকেটে জয়। প্রথমবারের মতো ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির বিশ^চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ধবলধোলাই করল বাংলাদেশ। এই সিরিজ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেন শান্ত। ব্যাট হাতে ‘শান্তর মাস্তানি’ অবশ্য বিপিএলেও দেখা গিয়েছিল আর সেটির ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। দলে পাকাপোক্ত হলো এই বাঁহাতি ব্যাটারের জায়গাটাও। তার সঙ্গে সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্য তো ছিলই। এছাড়া লিটন দাসের কথা বলতেই হয়। গত টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপের পরপর আমূল পাল্টে যাওয়া এই ডানহাতি ওপেনারের বিস্ফোরক ব্যাটিং যেন প্রতিপক্ষের জন্য এখন ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো। গত এশিয়া কাপে সেটির প্রমাণ পেয়েছিল ভারত। আয়ারল্যান্ড সিরিজেও নিজের ব্যাটিং সামর্থ্য দেখিয়েছেন তিনি। টি-টোয়েন্টিতে মোহাম্মদ আশরাফুলের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডটি তিনি কেড়ে নিয়েছেন সম্প্রতি।

আইরিশদের বিপক্ষে সিরিজের প্রাপ্তিও কম নয় বাংলাদেশের জন্য। বিশেষ করে বেশ কয়েকটি ব্যক্তিগত মাইলফলক গড়াও হয়েছে। কিউই পেসার টিম সাউদিকে টপকে টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক হয়েছেন এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। তবে দুর্দান্ত এক সিরিজ কাটালেও সাকিবের মনে এক আফসোস থেকেই গেল। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএলে খেলার কথা থাকলেও আন্তর্জাতিক সূচির কথা মাথায় রেখে ভারতে যাওয়া হয়নি তার। অবশ্য এক্ষেত্রে তার বিসিবির ছাড়পত্র পাওয়াও ছিল বড় বাধা। সাকিবের বয়সও হয়ে গেছে ৩৬। হয়তো পরের আইপিএলে তিনি ডাক না-ও পেতে পারেন। তবে সাকিব না গেলেও কলকাতার হয়ে খেলতে গেছেন লিটন। কিন্তু প্রথমবার আইপিএলে গেলেও সেভাবে সুযোগ পাচ্ছেন না। যতুটুকু ভারতের আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন এই বাংলাদেশি উইকেটরক্ষক-ব্যাটার তা হয়তো আগামী ওয়ানডে বিশ্বকাপে কাজে দেবে তার ক্ষেত্রে। তেমনি মোস্তাফিজুর রহমানের ক্ষেত্রেও। দীর্ঘসময় ধরে আইপিএল খেলছেন তিনি। অবশ্য দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে খেলা এই পেসার ১৬তম আইপিলে সেভাবে নিজের সেরাটা দিতে পারছেন না। দীর্ঘদিন ধরে ফর্মহীন সময় পার করছেন তিনি। তবে লিটনের মতো তারও ভারতে পাওয়া অভিজ্ঞতা কাজে দেবে ওয়ানডে বিশ্বকাপে।

বাংলাদেশের ওয়ানডে বিশ্বকাপ নিশ্চিত গেছে অনেক আগে। র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকা সেরা আট দলের সঙ্গে বাছাই খেলে আসা দুই দল নিয়ে হবে ২০২৩ বিশ^কাপ। ২১ ম্যাচে ১৩ জয় ও ৮ হারে ১৩০ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ আছে চতুর্থ স্থানে।

মে মাসে বাংলাদেশ নতুন মিশনেও নামছে। আইরিশদের বিপক্ষে স্থগিত থাকা তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড সফরে যাবেন সাকিব-তামিমরা। বিশ^কাপের আগে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে এটাই বাংলাদেশের শেষ সিরিজ। টাইগারদের জন্য এই সফর অনেকটা প্রস্তুতির হলেও আইরিশদের জন্য বড় পরীক্ষার। সিরিজ জিতলে তাদের সুযোগ থাকছে সরাসরি বিশ^কাপের টিকিট পাওয়ার। এক্ষেত্রে ৯৮ পয়েন্ট নিয়ে আয়ারল্যান্ড ছুঁয়ে ফেলবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তখন দুই দলের মধ্যে কারা সরাসরি বিশ^কাপে খেলবে সেটি নির্ধারিত হবে নেট রান হিসেব করে। আয়ারল্যান্ড যদি সরাসরি বিশ^কাপে যায় তখন বাছাই খেলতে হবে প্রোটিয়াদের। আর আরেকবার বাছাই খেলতে হবে সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কাকে। তাদের সঙ্গে থাকবে জিম্বাবুয়েও।

ঘরের মাটিতে বাংলাদেশ উড়িয়ে দিয়েছে আয়ারল্যান্ডকে। তবে এবার তারা স্বাগতিক। বাংলাদেশের পরীক্ষাটা হলো, বাইরেও বাঘের পরিচয় দিতে পারে কি না, সেটাই। নয়তো শুরুতেই যে বললাম, ‘ঘরে বাঘ, বাইরে বেড়াল’, সেই অপবাদ ঘুচবে না। তার মধ্যে বিশ্বকাপের আগে আগে জয়ের ধারাটাও ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ হাথুরুর শিষ্যদের জন্য। হয়তো এই সফরে বিশেষ করে তরুণদের ওপরে চোখ থাকবে বাংলাদেশ কোচের। তবে এটাও হতে পারে তামিমের মতো সিনিয়রদের ফর্মে ফেরার মঞ্চ। মুশফিক অবশ্য ফর্মেই আছেন। সিলেটে আইরিশদের বিপক্ষে তার দুর্দান্ত সেঞ্চুরিই সেটার প্রমাণ। তবে বাংলাদেশ দলে এই সিরিজে নেই মাহমুদউল্লাহ। হাথুরুর রাডারে যে এই অলরাউন্ডার নেই সেটি অনেক আগেই বোঝা গেছে। তবে চলতি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) যদি দুর্দান্ত কিছু করতে পারেন তবে সুযোগটা মিলতেও পারে। তেমনি ডিপিএলকে ফেরার মঞ্চ বানাতে পারেন সোহান-আফিফও। তবে ইয়াসির আলী রাব্বি শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকেন কি না শঙ্কা রয়ে গেছে। আইরিশ সফরে জালে উঠতে না পারলে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হতে পারে তাকে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three + 4 =