বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র ঋতুপর্ণ ঘোষ

নীলাঞ্জনা নীলা

বাংলা চলচ্চিত্রের এক নক্ষত্রের নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাকে বেশিরভাগ মানুষ পরিচালক হিসেবে চিনলেও তার রয়েছে আরো পরিচয়; গীতিকার, লেখক, অভিনেতা হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। যত দিন বেঁচেছিলেন চলচ্চিত্র জগতে শুধু আলো ছড়িয়ে গেছেন। তার পরিচালিত অনেক সিনেমা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্মানেও সম্মানিত হয়েছেন ঋতুপর্ণ।

ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্ম কলকাতায় ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট। তার বাবার নাম সুনীল ঘোষ, তিনি ছিলেন একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা। মা-ও ছিলেন চিত্রশিল্পী। ঋতুপর্ণ ঘোষ ছোটবেলা থেকেই প্রতিভাবান ছিলেন, তার প্রতিভাগুলো সবার মাঝে ধরা পড়তে থাকে স্কুল জীবন থেকেই। ১৪ বছর বয়স থেকে বাবার সাথে শুটিং দেখতে যেতেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ তখন থেকেই তার বাবাকে শট বাছাই করতে সাহায্য করতেন। ঋতুপর্ণের লেখাপড়া শুরু হয় সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। এরপর তিনি যাদবপুর থেকে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময় থেকেই তার সিনেমার প্রতি আগ্রহ জন্মায়।

১৯৯২ সালে তার প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’ মুক্তি পায়। হীরের আংটির প্রযোজনা করেছিল চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটি অব ইন্ডিয়া। শিশুতোষ এই সিনেমাটি খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে এই সিনেমা অন্য সব সিনেমা থেকে ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ায় অনেকেই ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রতিভা বুঝতে পেরেছিল। ১৯৯৪ সালে ‘ঊনিশে এপ্রিল’ সিনেমার জন্য তিনি কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। এই সিনেমাটি বেশ সাড়া জাগায়, যার মধ্যে প্রকাশ পায় সম্পর্কের টানাপড়েন ও সম্পর্কের দ্বন্দ্ব। ঋতুপর্ণ ঘোষের তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘দহন’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস দহন।

এছাড়াও তার ঝুড়িতে রয়েছে অনেক পুরস্কার। ২০০৪ সালে ‘চোখের বালি’র জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির পুরস্কার পান। ২০০৫ সালে ‘রেইনকোট’ শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি পুরস্কার পায়। ২০০৯ সালে ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির পুরস্কার পায়। ২০১০ সালে ‘আবহমান’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে পুরস্কার পান ঋতুপর্ণ। ১৯৯৮ সালে ‘দহন’ শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য পুরস্কার পায় আর একই বছর শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির পুরস্কার পায় ‘অসুখ’ সিনেমা। এখানেই শেষ নয়, ‘দহন’ ও ‘রেইনকোট’ ১৯৯৮ সালে কারলোভি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ক্রিস্টাল ক্লাব পুরস্কার পায়। এছাড়া ‘প্রেমের গল্প’ সিনেমা ২০১১ সালে ১৯তম কলাকার পুরস্কার পায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দু’ভাবেই তাকে সম্মান দেওয়া হয়েছে। বাংলার সীমা পেরিয়ে ভিন্ন ভাষার মানুষদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। প্রায় দুই দশকের কর্মজীবনে তিনি ১৯টি সিনেমা নির্মাণ করেন। যার মধ্যে ১২টি সিনেমা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।

সিনেমাতে কাজ করার আগে ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন একজন অ্যাডভারটাইজমেন্ট কপিরাইটার। আশির দশকে বাংলা বিজ্ঞাপনে তিনি ইতিবাচক পরিবর্তন আনেন। সেইসময় কলকাতায় ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার বিজ্ঞাপনগুলো অনুবাদ করে চালানো হতো। কিন্তু তিনি এ ধারার বদলে দেন। তার সৃষ্টি করা বিজ্ঞাপনগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। মূলত মিডিয়াতে সাথে তিনি যুক্ত হোন বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়েই। পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলে তিনি সবার হৃদয় স্পর্শ করেন। তার ‘শারদ সম্মান’ ও ‘বোরোলিন’ বিজ্ঞাপন দুটি তখন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ১৯৯০ সালে তিনি একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করার সুযোগ পান, এরপর থেকেই তিনি সিনেমার সাথে পুরোপুরিভাবে যুক্ত হন। ১৯৯৭ সালে তার ‘দহন’ সিনেমা বেশ সাড়া জাগায়। রাস্তায় শ্লীলতাহানি হওয়া এক নারীকে কেন্দ্র করে সিনেমাটি বানানো হয়। এরপর তিনি একের পর এক অসাধারণ সিনেমা উপহার দিতে থাকেন।

ঋতুপর্ণের ‘বাড়িওয়ালি’ সিনেমায় অভিনয় করেন চিরঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়, রূপা গাঙ্গুলী, কিরন খের প্রমুখেরা। কিরন খের এই ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। পরিচালক হিসেবে ঋতুপর্ণা ঘোষ ২০০০ সালে ‘উৎসব’ সিনেমার জন্য পুরস্কার পান। কেবল পরিচালনা না, তিনি অভিনয়ও করতেন দারুন। ২০০৩ সালে তিনি প্রথম ক্যামেরার সামনে আসেন। ২০১১ সালে তার অভিনীত আরো দুটি সিনেমা মুক্তি পান। তার অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘কথা দেইথিল্লি মা কু’তে’। এছাড়া ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ ছবিতে অভিনয় করেন। ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’ অবলম্বে তিনি সিনেমা নির্মাণ করেন।

বড় পর্দার পাশাপাশি ছোট পর্দার জন্য কাজ করেন। সেই সময়ে জনপ্রিয় টিভি শো ছিল ‘এবং ঋতুপর্ণ’। ‘গানের ওপার’ নামের একটি ধারাবাহিক তিনি লিখেছিলেন। ২০১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর ‘জীবন স্মৃতি’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তার নিজের জীবনের আলোকে তিনি শেষ ছবিটি নির্মাণ করেন যার নাম ‘চিত্রাঙ্গদা: দ্য ক্রাউনিং উইশ’। এই চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি সমাজকে এক অন্য চিত্র দেখিয়েছেন যা হয়তো অনেকের কাছেই অজানা ছিল। ‘চিত্রাঙ্গদা’ তে তিনি অভিনয়ও করেন।

১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল অবধি ‘আনন্দলোক’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সিনেমা জগতে প্রবেশ করার পেছনে তার বড় অনুপ্রেরণা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তার মধ্যে ধারন করতেন। সিনেমাতে নাচ ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি দুর্বলতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া পুরোনো বাড়ি, মধ্যবিত্ত, একাকিত্ব ও প্রেম ফুটে উঠতো তার বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে। কিন্তু প্রতিটা চলচ্চিত্রে তিনি দর্শকদের কোনো না কোনো বার্তা পৌঁছে দিতেন। তার মেকিং স্টাইলে ছিল ভিন্নতা যা চোখ এড়াতো না।

ঋতুপর্ণ ঘোষের ব্যাক্তিজীবন নিয়ে রয়েছে নানা তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা সমালোচনা। তার লিঙ্গ নিয়ে অনেকের অনেক প্রশ্ন ছিল। সে বিষয়ে তিনিই সবসময় খোলাখুলি আলোচনা করেছেন। তিনি কোনো কিছুই গোপন রাখেননি! ‘চিত্রাঙ্গদা’ ঋতুপর্ণ ঘোষের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছবি। এই সিনেমার মধ্যে দিয়েও তিনি অনেকটা নিজের জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন। তিনি নিজেকে কোনো জেন্ডারে আবদ্ধ করতে চাননি। ‘নারী না পুরুষ?’ এই জবাবে তিনি ‘মানুষ’ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তিনি বলেছিলেন ‘শিল্পীকে যে তার জেন্ডার অতিক্রম করে যেতে হয় সেটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি। সামাজিক লিঙ্গ আমার পরিচয় নয়। শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না, এটা বাবা-মা-ই আমাকে শিখিয়েছিলেন। আমি কোনো দিনই নিজেকে পুরোপুরি নারী মনে করতে চাইনি। হতেও চাইনি। বিজ্ঞাপনে যখন কাজ করতাম, এখন যা করি তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা রোজগার করতাম। কিন্তু সচেতনভাবে সেক্স চেঞ্জ করা থেকে দূরে থেকেছি। প্রচলিত জেন্ডার আইডেনটিটি থেকে বের হয়ে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেও পেরেছি আমি।’

তার পোশাক নিয়েও অনেকে অনেক ধরনের প্রশ্ন করতো। কিন্তু কখনো তিনি সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, চলতেন নিজের মতো আত্মবিশ্বাসের সাথে। তিনি নিজেকে মানুষ ভাবতেন ভালোবাসতেন। এর বাইরে তিনি নিজেকে আর কোনো পরিচয়ই দিতে রাজি ছিলেন না। যত দিন বেঁচে ছিলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন, সমাজের হাজারো নিয়মকানুনের মাঝে নিজেকে বেঁধে রাখবার মানুষ তিনি ছিলেন না। ঋতুপর্ণা ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা এমন এক সমাজে বাস করি পুরুষদের নিয়ে সকল মাতামাতি আর নারীরা বরাবর অবহেলার শিকার। এই ব্যাপারটা সবসময় তাকে আঘাত করত। তাই তিনি চেয়েছিলেন নিজের কাজ ও চিন্তাধারা মধ্যে দিয়ে পরিবর্তন নিয়ে আসতে।

ঋতুপর্ণ ঘোষের অনিদ্রা ছিল। তিনি দিনের পর দিন রাতে ঘুমাতে পারতেন না। ঘুমানোর জন্য তাকে চিকিৎসকের পরামর্শে ঘুমের ঔষধ খেতে হতো। এছাড়া তার প্যানক্রিয়াটিস রোগ ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ছিল। ২০১৩ সালের ৩০ মে কলকাতার বাড়িতেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে এপার বাংলা, ওপার বাংলা ও বলিউডে নেমে আসে শোকের ছায়া। কেউ যেন বিশ্বাস করতে চাইছিল না ঋতুপর্ণ ঘোষ আর নেই। অমিতাভ বচ্চন বলেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ একমাত্র পরিচালক যিনি বচ্চন পরিবারের সবার সঙ্গে কাজ করেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ। এবং সামনেও তাদের একসাথে কাজ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনার মাঝে বাধা পড়ে গেল। ঋতুপর্ণ ঘোষ চিরতরে চলে গেলেন সবাইকে রেখে, তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে তার ফেসবুকে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত লাইন, “মনে রেখো আমায়।”

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × 3 =